সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রে চিন্তকদের ভূমিকা: স্বাধীন মতামত বনাম শাসকগোষ্ঠীর প্রভাব

আধুনিক রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব এবং সুস্থ বহুত্ববাদের চ্যালেঞ্জ

একটি রাষ্ট্রের কিছু মানুষের মতামত ঐ রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সবার মতামত অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। এই মানুষগুলো হচ্ছে ঐ শ্রেনীর মানুষ যারা সাধারণত রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীদের সিদ্ধান্ত তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকেন (পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে)। বর্তমান জমানায় গতানুগতিক ধারার বুদ্ধিজীবীদের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেতে পারেন যারা অন্তর্জালে শক্ত অবস্থানে আছেন। অধিক সংখ্যক অনুসারী সংখ্যাও হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।

পুনরায়, শুধুমাত্র অনুসারী সংখ্যা বা জ্ঞানীয় যোগ্যতা থাকলেই যে ঐ রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী আপনার কথা মন দিয়ে শুনবে এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে এমনও নয়। শাসকশ্রেণী তাদের সমর্থিত চিন্তকদের তূলনামূলক বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। কারণ শাসকশ্রেণী যদি তার প্রকৃত চিন্তকদের গুরুত্ব না দেন তাহলে গণতান্ত্রিক মহলে তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে বিপদে পড়বেন। এই চিন্তকদের প্রেসক্রিপশন বারবার প্রয়োজন পড়ে যে কোন রাষ্ট্রের যে কোনো শাসকগোষ্ঠীর। চিন্তকদের কেউ কেউ সরাসরি শাসকগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত থাকেন। বর্তমানে উন্নত মানের টেকনোলজি দ্বারা অন্তর্জালে বিস্তৃত নানান মতামতের একটি ‘সিনথেসিস’ গঠন করতেও সক্ষম হতে পারেন।

চিন্তকদের এই প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য ছাড়াও পরোক্ষ চিন্তকদের একটি দল থাকতে পারে। রাষ্ট্রের ভাড়া করা চিন্তকদের চেয়ে স্বার্থের বাইরে গিয়ে যারা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নিজের মতামত রাখেন তারা একইসাথে ঐ রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক। এই চিন্তকরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারেন এবং নির্দিষ্ট মতামতের উপর একটি ভীড়ও তৈরি করতে পারেন। মোটাদাগে, কোনো রাষ্ট্রে বিপ্লবের চিন্তাও এঁদের থেকেই আসে এবং প্রয়োজনে এঁরা নির্দিষ্ট ভীড়ের সাথে মাঠেও নামেন।

আন্তোনিও গ্রামশির মতে এঁরাই হলেন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা একটি রাষ্ট্রে থাকতে পারে। কিন্তু মুক্তির জন্য কাউকে না কাউকে পুরো বিষয় নিয়ে সামষ্টিক একটি ‘চিন্তা’ হাজির করা জরুরী যেটা বিপ্লব জন্ম দিতে পারে।

গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময় সঠিক কাজ করা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ যা চাইছেন তার সবটুকু না হলেও কিছু না কিছু করে দেখাতে হয়। জনগণের কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য। ফলে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল স্বাধীন চিন্তকদের মতামত কে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। কারণ স্বাধীন চিন্তকদের মধ্যে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার প্রবণতা কম।

আবার অন্তর্জালের কল্যাণে অধিক গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্ক কোন বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেয় না। এখানে জনগণ বলতে বুঝায়, একেকটি প্রোফাইল বা বিশেষ ব্যক্তি (Individual)।

১৯৮০-৯০ সালের পৃথিবী কল্পনায় গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্কে শুধুমাত্র হাতেগোনা কিছু মানুষের হাতে তথ্য থাকতো। আর তাঁরাই তথ্যের দ্বাররক্ষী হয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করতেন। খবরের পাতায় এবং সাদা-কালো টেলিভিশনের পর্দায় তা ভেসে উঠতো। মানুষ সেটাকেই বিশ্বাস করতো এবং ঐ সিদ্ধান্ত কে মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমান সময়ে অত্যাধুনিক টেকনোলজি এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও দ্রুতগামী ব্যবস্থা থাকায় যে কোন রাজনৈতিক দলকে একই বিষয়ে হাজার ধরণ বা রকমের মতামতের মুখোমুখি হতে হয়। এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া একইসাথে আশীর্বাদ ও অভিশাপ হতে পারে।

‘সুস্থ বহুত্ববাদ (Healthy Pluralism)’ হচ্ছে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বা ফ্রেমওয়ার্কে সবার মতামত জানানোর অধিকার থাকতে হবে। মানে হলো, ‘বাক-স্বাধীনতা’। এক্ষুণি রাষ্ট্রের একপ্রান্তে কিছু হলে আরেক প্রান্তের মানুষজন সেটা নিয়ে নিজের মতামত দিতে পারবে। এবং, এই মতামত জানানোর ক্ষেত্রে তাকে কোনো আইনী জটিলতায় ফেলা হবে না। বরং তাকে তার মতামত জানানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হতে পারে। এই ধরণের রাষ্ট্রে শুধু চিন্তকদের মতামত নয়, সাধারণ জনগণের মতামতেরও গুরুত্ব থাকবে। এতে করে সবাই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে সক্ষম হতে পারে।

রাষ্ট্রের নানান গোষ্ঠী বা কমিউনিটি বা নির্দিষ্ট আদর্শের ভীড় নিজ নিজ মতামত জানাবে। সুস্থ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্কে ‘আমি’ গুরুত্বপূর্ণ, ‘আমার’ মতামত গুরুত্বপূর্ণ। শাসকগোষ্ঠী যদি সমস্ত প্রাসঙ্গিক মতামতকে ধারণ করতে পারে, স্বাগত জানাতে পারে তবেই ঐ ‘গণতন্ত্র’ কিছুটা হলেও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রুপ নিতে পারবে। এখানে ‘প্রাসঙ্গিক’ শব্দ বলতে রাষ্ট্রদোহী বা দেশদ্রোহী ব্যতীত যে কোনো মতামত কে বুঝায়। এবং কোন ধরণের মতামত বা আদর্শ বা ধর্ম ধারন করার জন্য তার উপর ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না।

কিন্তু এখানেই শাসকগোষ্ঠী একধরণের বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোন। কারণ এতে করে তিল মানের ঘটনাকে তাল বানানোর যথেষ্ট ক্ষমতা জনগণের হাতে চলে যায়। আর এর ফলে সার্বক্ষণিক অস্থিরতা রাষ্ট্রে বিরাজ করতে পারে। নানান মতামত কে গ্রহণ করে ফয়সালা করতে হিমশিম খেতে পারেন শাসকগোষ্ঠী। অন্যদিকে, ‘The Dictator’ সিনেমার কর্তৃত্ববাদী সরকারের মত এমনটিও হওয়া উচিত নয়, “Do you want Aladdin News or Aladdin News?”

ফলে দেখা যায়, আমরা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কোন নির্দিষ্ট ভীড়ের চিন্তকে পরিণত হতে পারি। এর কারণ হলো, অধিক মতামত একসময় শব্দ দূষণে পরিণত হয়ে পড়তে পারে। ফলে শাসকগোষ্ঠী কোনটা কে ধরে সামনে এগোতে চাইবে তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই একরকম বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট শাসকগোষ্ঠী কিছু স্বাধীন চিন্তকদের চিহ্নিত করে রাখতে পারেন। এই চিন্তকদের প্রোফাইলিং পর্যন্ত করতে পারেন। এছাড়াও অত্যাধুনিক টেকনোলজি যেমন ‘পেগাসাস’ দিয়ে একটি ‘কমন’ এবং মোটামুটি সর্বসম্মতিক্রমে একটি মতামত তারা গ্রহণ করে থাকেন।

‘Saturated’ বা মাত্রাতিরিক্ত মতামত সামনে এলে কোনো স্বাধীন চিন্তকের পক্ষে সেটাকে ব্যবচ্ছেদ করা আর সম্ভব হয় না। কিছুটা ঝিমিয়ে পড়তে পারেন বা ঐ বিষয়ে একেবারে চুপ থাকেন অথবা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চলে যান। এখানে স্বাধীন চিন্তকদের কাজ হলো, তার সমর্থিত ভীড় কে সমর্থন করে একটি ন্যারেটিভ তৈরি করা যেটা একইসাথে জনগণ এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকে। রাষ্ট্রে অস্থিরতা কমে যায় এবং সহনশীলতা বাড়ে।

আবার প্রতিটি স্বাধীন চিন্তক-ই সমাধান কেন্দ্রিক নন, কেউ কেউ তো রীতিমতো নৈরাজ্যবাদী (Anarchist)। সুতরাং এদের মধ্যে এক ধরণের স্নায়ুযুদ্ধ সবসময় লেগেই থাকে।

আর এই নৈরাজ্যবাদী ও নৈরাশ্যবাদী চিন্তকদের জন্য সমাধান কেন্দ্রিক চিন্তকেরা রাষ্ট্রে আরো সৃজনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মনোযোগ দিতে পারেন না। রামকৃষ্ণ বর্তমানে বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, “যত মত, তত পথ নয়”। সব বিষয়ে আমরা সবাই মতামত জানাতে পারি না। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হয় জরুরী নয় যে, ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে আমরা কতটুকু জ্ঞান রাখি বা ঐ মতামত প্রদর্শনে তার ফলাফল ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক হতে পারে সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

ধরে নিলাম শাসকগোষ্ঠী জনগণের স্বার্থ বজায় রেখে রাজনীতি করতে চাইছেন। কিন্তু যখন তাদের স্বাধীন ও নির্দিষ্ট চিন্তকেরাও মিশ্র মতামত জানান তখন তারা সন্দিহান হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্তহীনতা চলে আসে। আর এর ফলে নেতা কে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে যা কারো স্বার্থের সাথেই যাচ্ছে না। আর আমি এটাকে বলি, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।

আমার মনে হয়, মতামত জানানোর জন্য আমাদের কাছে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। খুব সম্ভবত সে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে ঐক্য তো অনেক দূরের বিষয় কখনো আলোচনাও হয় নাই। এই ধরণের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভিত্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য।

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button