ইতিহাস

ভক্তি ও প্রেমের অমর কাহিনি: ভক্ত সালেবেগের জীবন

ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে মানবতার এক অনন্য উদাহরণ

বিজ্ঞাপন

পুরী ধামে ভক্ত সালেবেগের কাহিনি

পুরী ধামে চিনা পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ তাঁর চলার পথে একটিও হিন্দু মন্দির দেখতে পাননি। ভাবতে অবাক লাগে, হয়তো ছিল, না হলে এত উত্থান-পতনের কাহিনি এলো কোথা থেকে! সমুদ্রোপকুলের শ্রী চৈতন্য দেবের অন্তিম অবস্থান কালের এক নগর। সময়কাল সপ্তদশ শতাব্দী।

লালবেগের পরিচয়

এই স্থানে বাস করতেন সনাতন ধর্মের সঙ্গে বাসরত এক অন্য ধর্মের সৈনিক, মুঘল সুবেদার লালবেগ। তিনি এক দক্ষ যোদ্ধা, সৎ, নিষ্ঠাবান একজন মুসলমান। তিনি ধার্মিক মনোভাব পোষণ করতেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পালন করতেন। তিনি পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তি ছিলেন।

উষা দেবী ও সালেবেগ

লালবেগের পত্নী ছিলেন হিন্দু ধর্মের উষা দেবী (কাল্পনিক)। তিনি স্ত্রীর ধর্ম পালনে কখনো বাধা দেননি। তাঁদের পুত্র সালেবেগও পিতার মতো সৎ, ধার্মিক, নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। পড়াশোনা ও যুদ্ধক্ষেত্রের রণকৌশলে তিনি পারদর্শী হয়ে উঠছিলেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতি

একদিন লালবেগ তাঁর পত্নী উষা দেবীকে ডেকে বললেন, ‘সম্রাট যুদ্ধ যাত্রা করবেন, আমাকে যুদ্ধ ও সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন।’ উষা দেবী স্বামীর আহারের বন্দোবস্ত করে দিলেন। তাঁদের পাকশালে মুসলমান বাবুর্চি ও হিন্দু পাচক মজুদ ছিলো।

পুত্রের ইচ্ছা

পুত্র সালেবেগ তরবারির ধার পরীক্ষা করছিলো। সে ছুটে এসে বললো, ‘আব্বু, আমিও আপনার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করতে চাই।’ লালবেগ পুত্রকে নিরস্ত করলেন না, বরং উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘যাবে? বেশ তাহলে প্রস্তুত হয়ে নাও পুত্র।’

বিজ্ঞাপন

উষা দেবীর প্রার্থনা

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ আসতো উষা দেবীর নিকট, পুত্র সালেবেগ দক্ষতার সঙ্গে রণভূমিতে পিতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করছে। পক্ষকাল অতিবাহিত হলে এক ভয়ংকর সংবাদ উষা দেবীর নিকট পৌঁছলো। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও পুত্র সালেবেগ গুরুতর আহত হয়েছে। উষা দেবী প্রভু জগন্নাথের নিকট প্রার্থনা করলেন।

সালেবেগের ভক্তি

সালেবেগ মায়ের আদেশে প্রভু জগন্নাথের স্মরণে মগ্ন হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। প্রথমে মায়ের আদেশে জগন্নাথকে স্মরণ করলেও পরে অন্তঃস্থল থেকে এক টান অনুভব করলো। সে জগন্নাথকে ভালোবাসতে শুরু করলো এবং তাঁর স্মরণে পদ রচনা শুরু করলো।

ভক্ত সালেবেগের প্রসিদ্ধি

ক্রমে সে ‘ভক্ত সালেবেগ’ রূপে প্রসিদ্ধি পেতে লাগলো। তাঁর রচিত প্রভুর ভজনে তিনি নিজেই সুর দিতেন। একবার শ্রী মন্দির আক্রমণ কালে জগন্নাথ দেবকে স্থানান্তরিত করার সময় ভক্ত সালেবেগ রচনা করলেন-‘কঁহা লে যা রহে হো মেরে জগন্নাথ জী কো!’

রথযাত্রা ও সালেবেগ

প্রতি বছর যখন জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা হতো, সালেবেগ প্রভু জগন্নাথের রথ দর্শন করে, রথের রশি টেনে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে নয়ন ভরে দেখে মনে অসীম শান্তি লাভ করতেন। মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি না পেলেও তিনি রথযাত্রার পথে একটি কুটির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে সেখানে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

সালেবেগের শেষ দিন

ইংরেজি ১৬৪৬ সালে ভক্ত সালেবেগ স্বর্গ লাভ করেন। গজপতি মহারাজের আদেশে সেই কুটিরের লাগোয়া জমিতে সালেবেগের সমাধি দেওয়া হয়। ভক্ত সালেবেগ আজও অবস্থান করছেন তাঁর সমাধিস্থল বা মাজহার অথবা মাজারে।

বিজ্ঞাপন

তথ্যবহুল টেবিল

বিষয় বিবরণ
নাম ভক্ত সালেবেগ
পিতা লালবেগ
মাতা উষা দেবী
ধর্ম ইসলাম
প্রসিদ্ধি ভক্তি ও পদ রচনা
মৃত্যু ১৬৪৬ ইংরেজি
সমাধি পুরী ধামে

উপসংহার

ভক্ত সালেবেগের জীবন কাহিনি আমাদের শেখায় যে, ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে মানুষ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। সালেবেগের ভক্তি ও প্রভু জগন্নাথের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। তাঁর জীবন কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের ভক্তি ও প্রেম কোনো ধর্মের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়। এটি মানবতার এক অনন্য উদাহরণ, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।

Image Source: Bhakta Kavi Salabeg: A great Muslim devotee of Lord Jagannatha

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading