বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র: বাংলা সাহিত্যের তিন মহীরুহের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বঙ্কিমচন্দ্র ছাপা উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা। বিদ্যাসুন্দর ও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র যে একশো বছরের তফাৎ ছিল তা পূরণ করেছিল ‘চন্দ্রকান্ত’, ‘কামিনী কুমার’ যা পদ্য রোমান্স। এগুলিও ছাপা বই যা বঙ্কিমচন্দ্র এড়িয়ে যেতে পারেননি।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস প্রথম ভাগে রোমান্সপূর্ণ, দ্বিতীয় ভাগে সামাজিক ব্যবস্থা অনুসারে নীতিকথা যেমন, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও আরও। তৃতীয় ভাগে ঐতিহাসিক ‘রাজসিংহ’, ‘মৃণালিনী’, ‘সীতানাথ’ ও আরও। এ সবও রোমান্টিক উপন্যাসের এদিক-ওদিক আর ঐতিহাসিকও যেমন ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘আনন্দমঠ’।

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য বৈশিষ্ট্য

বঙ্কিমের উপন্যাস ছিল প্রণয় রসে ভরা, আবার থাকত সমাজ রক্ষণের দিকটিও। তাতে থাকত উপদেশ নয়, ধমক, ভর্ৎসনা। থাকত মধুর রস ও অম্ল রস দুই-ই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম সময়কালে গল্প, উপন্যাস লিখে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম

রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস একত্র সমালোচনা করা যায় না, বিচার তো নয়-ই। তাঁর গল্প, উপন্যাসগুলির ধাত মোটেও এক নয়। যেখানে রবীন্দ্রনাথ কাহিনীকার, সেখানে অন্য কাহিনীকাররা কোথায়!

বঙ্কিম ও শরৎচন্দ্রের তুলনা

বঙ্কিম ও শরৎচন্দ্র জীবনকে স্বচোক্ষে অবলোকন করে নিজ মনস্কাতায় তৈরি করেছেন ক্যানভাসের ওপর তুলি দিয়ে চিত্রকার যেমন ছবি আঁকেন, রবীন্দ্রনাথ জীবনকে অনুভব করেছেন ডগা হতে শিকড় অবধি। আর তা যথাযথ বর্ণনা করে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের গল্পের বৈশিষ্ট্য

রবীন্দ্রনাথের গল্প যেন সিনেমার ক্লোজ-আপ। চরিত্রগুলি যেন আগের দৃশ্য সমেত ভেসে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের গল্পে ততো হৃদয়াবেগের স্ফীতি নেই। আছে সহানুভূতি, আছে নীরব এক অনুভব। স্নেহরস খুব বেশি নেই, মনের স্পন্দনই তাঁকে নিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।

ছোট গল্পের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামত

কবি ছোট গল্পের বিষয়ে যা বলেছেন সবাই তা জানে –

“ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা- নিতান্তই সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি; তারি দু’চারিটি অশ্রুজল। নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘন ঘটা নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ, অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে- শেষ হইয়াও হইলো না শেষ…”

  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গল্পগুচ্ছের প্রভাব

একশো বছর পার হয়ে গেলেও ‘গল্পগুচ্ছ’ নিয়ে মনে হয়, এ বড় বিষ্ময়! বাঙালি পাঠক ‘গল্পগুচ্ছ’ কে যথাযথ সমাদর করতে পারেনি। কারণ বাঙালি পাঠক চায় শান্তি, তৃপ্তি, মৃদু বাতাসের মন্দ মন্দ ঘোরে ঘুমিয়ে পড়তে। এমনই মনের গন্ডি যে তাদের! রবীন্দ্রনাথের ঐ উপরিল্লিখিত কবিতায় তা কি আছে!

শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকর্ম

শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্য কালবিভক্ত। প্রথম দিকে তাঁর স্বতঃস্ফুর্ত রচনা, পরে দ্বিতীয় ভাগে তাঁর পরবর্তী রচনা। সে কাহিনিগুলি তাঁর কলকাতা থাকাকালীন সময়ে সাহিত্যগোষ্ঠীর দলপতি রূপে নিজ খুশি নয়, অন্যের মুখ চেয়ে লেখা।

শরৎচন্দ্রের গল্পের বৈশিষ্ট্য

শরৎচন্দ্র তাঁর কাহিনিতে অনুভব অভিজ্ঞতা দ্বারা ছুঁচে সুতো পরিয়েছেন পরে সুতো ছেড়েছেন পাঠকের ভালো লাগার দিকে লক্ষ রেখে। শরৎচন্দ্রের গল্প পড়ে লোক রূপকথার আস্বাদ পায়। শরৎকাহিনী সবই মধুর প্রায়, দৈবাৎ কঠোর!

বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের মিল

বঙ্কিমের উপন্যাস পড়েই শরৎ যেন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বলা ভালো, বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্রের সাহিত্যগুরু। দুজনের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে মিল মিশ ছিল – দুজনের কেউই কবিতা রচনা করেননি, এড়িয়ে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রভাব

শরৎচন্দ্র প্রথম রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়ার সুযোগ পান ১৩০৮/০৯ সালে। যখন রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ বেরুলো গ্রন্থাকারে। রবীন্দ্রনাথের এই লেখা শরৎচন্দ্রের পাথেয় হয়েছিল।

কৃতজ্ঞতা

আনন্দ পাবলিশার্স


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading