বই, অক্ষরে অক্ষরে মারাত্মক বস্তু। সরল, সভ্য, মৃদু। কিন্তু নিরীহ কি? বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চুরি, জালিয়াতি, খুন, ধ্বংস। এডিনবরায় বক্তৃতা দিচ্ছেন আলবার্তো ম্য্যঙ্গুয়েল, যিনি লেখক এবং পাঠক রূপে বিখ্যাত সমগ্র বিশ্বে।
আলবার্তো ম্য্যঙ্গুয়েল এবং তাঁর লাইব্রেরী
নব্বইয়ের দশকে “হিষ্ট্রি অব রিডিং” লিখে সাড়া ফেলেছেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু “পঁয়ত্রিশ হাজার বইয়ের শেষ পরিণাম”। তাঁর লাইব্রেরী নিয়ে বই আছে। তিনি নিজেকে লেখক নয়, পাঠক মনে করতে বেশী ভালোবাসেন।
ফ্রান্সে বিশাল লাইব্রেরী
বিশাল এক বাড়ী ক্রয় করলেন ফ্রান্সে। তাতে আছে ঘোড়া ছাড়া এক বৃহৎ আস্তাবল। তাতে আছে বই, ঘোড়া নয়। অবশ্য গরীবদের জন্য বই কেনা তো এক ঘোড়ারোগই। সেই আস্তাবল মেরামত করে তৈরী হলো এক বড়সর লাইব্রেরী। আছে মাত্র ৩৫ হাজার বই। সব বই দামী ম্য্যাঙ্গুয়েলের কাছে, যা পান তাই আনেন। একদিন হাতে এলো “ভরা বর্ষায় নাইজেরিয়ার চাষবাস পদ্ধতি” – স্থান পেলো “প্রকৃতি” সেকশনে। পুরো লাইব্রেরী সাজিয়ে তিনি সে দিন পুরো রাত কাটালেন। তাঁর মনে হলো শেষ ক’টা দিন এখানে কাটালে হয়!
নিউইয়র্কে কাজের জায়গা
কিন্তু তাঁর কাজের জায়গা তো নিউইয়র্কের ম্য্যানহাটান। সেখানে তো এতো বই আঁটবে না। বইগুলো বাক্সবন্দী হয়ে রয়ে গেলো ফ্রান্সে। কত জায়গা লাগলো! তিন হাজার বর্গফুট। মাটির মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু বাক্স।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসা
ম্যাঙ্গুয়েল বক্তৃতায় বলছেন, এম্পুটেশনের পর রোগীর যেমন মনে থাকে না তার অঙ্গ হানির কথা তেমনি মনে থাকতো না তাঁরও। কাল্পনিক ভাবে হাত চলে যেত কাল্পনিক আলমারির সেই কোণটিতে যেখানে সেই তাঁর পড়বার ইচ্ছার বইটি আছে। কেউ বলে উঠলো, কিছু বই ফেলে দিতে পারতেন তো!
তিনি সজল চোখে উত্তর দিয়েছিলেন, “I would rather kill my children.” আর কি কোনও দিন দেখা হবে সেই বইগুলোর সাথে!
টিম্বাকটু এবং বই পাচার
টিম্বাকটুর ইতিহাস
টিম্বাকটু আফ্রিকার নাইজার নদীর তীরে। চার্লি ইংলিশ বলছেন এক গল্প। তিনি এক বই লিখেছেন “বুক স্মাগলার্স অফ টিম্বাকটু”। জায়গাটি বিখ্যাত কারণ এখানকার বেশীর ভাগ লোকই সংগ্রহ করতো পুরণো দলিল, দস্তাবেজ, আর ইসলামীয় পুঁথি।
জেহাদিদের আক্রমণ
৩১ মার্চ ২০১২ সালে সকাল ছ’টা নাগাদ দখল নিলো জেহাদিরা টিম্বাকটুর। লুঠপাঠ, অরাজকতার এক রাজ!
আব্দুল কাদের হায়দারের প্রচেষ্টা
আব্দুল কাদের হায়দার অন্য অনেকের সাথে আলোচনা করলেন। মানুষের জীবন বিপন্ন, সেখানে পুঁথিপত্রের কি দাম! হায়দার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, যে ভাবে হোক বহুমূল্য পুঁথিগুলোকে বাঁচাতে হবে।
সেই রাত্রে আবার পরের রাত্রে তিনি এই ঐতিহাসিক পুঁথি গুলি সরিয়ে ফেলতে লাগলেন। আবার পরের দিন রাত্রে, এইভাবে স্মাগল করে নিয়ে আসতে লাগলেন মূল্যবান দলিল গুলিকে। ১৯৭৩ সালে টিম্বাকটুতে তৈরী হয়েছিল আহমেদ বাওয়া প্রতিস্থান ও লাইব্রেরী, ইউনেস্কোর সহায়তায় মাত্র ১০০০ পান্ডুলিপি নিয়ে।
পুঁথি পাচারের কৌশল
এগুলো যতো দ্রুত পাচার করে সরিয়ে ফেলা যায় তার চেষ্টায় ট্রাংক ও লড়ি জোগার করা হলো। রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা। তাতে বই তুলবেন কি জেহাদিদের থেকে বাঁচতে গাদা গাদা লোক জড়ো হয়ে গেল, তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে চায়। বই উঠলো চারটে, বাকি লোক।
বই চুরি এবং সংগ্রহ
বই চুরির ঘটনা
বল তো নিজের বই নিজে কি চুরি করা যায়? জনৈক কারু কাছ থেকে এক কাকু নিয়ে গেলেন “আলবার্তো মোরাভিয়া” এর “কম্যান্ড এন্ড আই উইল ওবে ইউ” বইটি কয়েক দিন পরে ফেরত দেওয়ার শর্তে। বহু দিন হয়ে গেলো বই ফেরত পাওয়া গেলো না।
বছর খানেক পর কাকুর বাড়ী নেমতন্ন রক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন বই মালিক সেই বইটি কাকুর আলমারীতে শোভায়মান। তিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে নিজের বই নিজেই চুরি করলেন। বই চুরি কি অপরাধ!
বিখ্যাত বই চুরি
গ্যাব্রিয়েলা গার্সিয়া মার্কেজের একশো বছরের “নিঃসঙ্গতা” প্রথম সংস্করণ চুরি হয়েছে এখনিই। আনুমানিক দাম ষাট হাজার ডলার (বিবিসি এর মতে)। ফেব্রুয়ারী মাসে বোগোটা বই মেলা থেকে উধাও হয়ে যাওয়া। পরে এক সেকেন্ড-হ্যান্ড বইয়ের দোকান থেকে বইটি পেয়ে মার্কেজ সেটি ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে দান করে দিলেন।
বইয়ের বিপজ্জনক দিক
বই বড় বিপজ্জনক জিনিস। মাঝে মাঝেই সরকারি বা ধর্মগুরুদের কোপে পড়ে যায় বই। কত বার কত বই যে পোড়ানো হয়েছে! আর রাজনৈতিক লেখা লিখলে হাজতবাস বা বুলেট। যেমন হয়েছিল সলমন রুশদির বই “স্যাটানিক ভার্সেস” বেরুনোর পর। ১৯৯১ সালে ইতালিয়ান অনুবাদক কের কাছে আততায়ী রুশদির ঠিকানা জানতে চেয়েছিলো।
২০১৮ সালে দেখা যায় রুশদি এডিনবরায়। রুশদি বিশ্বাস করেন, দ্যাট চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজড। কিন্তু ২০১৬ সালে ইরাণের এক সংবাদ সংস্থা তাঁকে মারার পুরস্কার হিসেবে ছ’লক্ষ মার্কিন ডলার ঘোষণা করেছে।
উপসংহার
বই সংগ্রহের ব্যাপারটা রোমান্টিক মনে হলেও নয় তা। বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য দুঃখ, চুরি, খুন। বই নিয়ে এতো অপরাধের ঘটনা ঘটিত হয়েছে যে তাই নিয়ে গোয়েন্দা গল্পের ঘরানা তৈরী হয়ে গেছে।
জন ডানিং লিখেছেন পাঁচটা উপন্যাস, তাঁর “বুকড টু ডাই” ক্লাসিক থ্রিলার বলে পরিগণিত হয়। যাইহোক, কখনোই কোনো বইয়ের ঘটনা বাস্তবের মতো রোমাঞ্চকারী হতেই পারে না।
তথ্যঋণ: শুভায়ু বন্দোপাধ্যায়
ছবি: Designed by FreePik
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.