সম্পাদকীয়

ডেটিং অ্যাপ: আশীর্বাদ না অভিশাপ?

প্রেম, বিশ্বাস, খুন... ডেটিং অ্যাপের অন্ধকার দুনিয়া

বিজ্ঞাপন

ডেটিং অ্যাপস: প্রেমের স্বপ্ন না কি মৃত্যুর ফাঁদ? প্রযুক্তির যুগে প্রেমের খোঁজে নেমে কীভাবে মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনা। মুম্বাই, দিল্লি থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত, টিন্ডার, বাম্বল সহ বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপের অন্ধকার দিক উন্মোচন।

একটা গল্প যা ঘটতে পারতো নিখাদ প্রেমের তা হয়নি, আবার সেটা বিচ্ছেদের গল্প হতে পারতো কিন্তু হয়নি। বরং গল্পটা হয়েছে আতঙ্কের। পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রেমের গল্পের মত যথারীতি এই গল্পের কুশীলবও দুইজন। শ্রাদ্ধা ওয়ালকার ও আফতাব পোনওয়ালা। শ্রদ্ধা ধর্মে হিন্দু ও আফতাব মুসলিম। হিন্দু মুসলিম প্রণয়ের চিরাচরিত রোমাঞ্চের গন্ধ আছে নিশ্চয়ই কিন্তু এই গল্প তার চেয়ে রোমহর্ষক। বাসস্টপে বা কোন ভার্সিটিতে বা কোন বার্থডে পার্টিতে নয়।

শ্রদ্ধা ও আফতাবের পরিচয় হয়েছিল বাম্বেল ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে সেখান থেকে প্রেম সেখান থেকেই কাছাকাছি আসা। যথারীতি এই কাছে আসাই বাঁধ স্বাদে পরিবার। ভালোবাসায় অন্ধ শ্রদ্ধা প্রিয় বাবা মাকে ছেড়ে চলে আসে আফতাবের কাছে। মুম্বাই ছেড়ে দুটো পাখির ঘর বাঁধে দিল্লিতে।

শুরু হয় নতুন সংসার। কেটে যায় বেশ কিছুদিন। বছর গড়াতে না গড়াতে আফতাব এর হাতে নিহত হলো শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধার মৃত্যুতে কাঁপিয়ে দিল প্রেম আর বিশ্বাসের ভিত। কিন্তু কি এমন হলো প্রেমের সম্পর্ক, ভালোবাসার সম্পর্ক এরকম ভয়ানক পরিণতি।

তদন্তে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরেই সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না দুজনের। মাঝে সাজেই হচ্ছিলো ঝগড়া। আফতাব কি লুকিয়ে নতুন এক ডেটে গিয়েছিল শ্রদ্ধা? নতুন এই লোকটার সাথে শ্রদ্ধার পরিচয় ডেটিং অ্যাপসের মাধ্যমে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শ্রদ্ধার বডি খন্ড দ্বিখন্ড করে ফ্রিজে রাখে আফতাব। আর বিভিন্ন বনভূমিতে ফেলে আসতে থাকে লাশের বিচ্ছিন্ন সব টুকরো।

বিজ্ঞাপন

যদিও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এক বাক্যে স্বীকার করে সব। আফতাব শ্রদ্ধার এই ঘটনা বেশ সাড়া পড়েছিলো তখন। ধর্মীয় ব্যবধান প্রেম আর অন্যান্য ব্যাপারগুলোকে পাশ কাটিয়ে একটা প্রশ্ন প্রবলভাবে উঠেছিল, একটা ডেটিং অ্যাপস জীবনকে এতটা বেশি  নিঃশেষ করে দিবে শ্রদ্ধা কি কখনো ভেবেছিলে এই কথা।

তবে দেখা যাক, আর একটা গল্প এবং সত্য ঘটনা। প্রিয়া শেখ নামে এক নারী তার প্রেমিকের সাথে মিলে পরিকল্পনা করে কোন এক ধনী মানুষকে ফাঁসান। টিন্ডার অ্যাপে প্রিয়ার নিজের একটা অ্যাকাউন্ট খুলে সেই একাউন্টের মাধ্যমে কিছু দিনের মাথায় এক ধনী ব্যক্তিকে পেয়ে যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই ধনী ব্যক্তিকে কিডন্যাপ করে। মজার বিষয় হলো, কিডন্যাপ এর পর জানা যায় প্রিয়ার মতো এই লোকটাও একটা ধাপ্পাবাজ। মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মানুষ এবং সে বিবাহিত। বলা বাহুল্য প্ল্যান ভুল হওয়াতে এই লোকের উপর রেগে যায় এবং লোকটাকে খুন করে।

লাশটাকে এক শুটকেছে কেসে ভরে দিল্লির হাইওয়েতে ফেলে দেয়। কিছুদিন পরে প্রিয়া ধরা পড়ে। ধরা পড়ার পর সে নির্বিকার ভাবে স্বীকার করে নিজের অপরাধ। এই দুটো গল্পে বা নির্মল ঘটনার যুগ সূত্র কিন্তু একটি ডেটিং আপ।

প্রযুক্তির উৎকর্ষে যেসব বিষয় ক্রমশ স্বাভাবিক  হয়ে উঠছে তার অন্যতম এই মাধ্যম। যদিও ডেটিং অ্যাপ নব্য কোনো আবিষ্কার এমন বলা যায় না। ৯০ দশক এর মাঝামাঝির সময়ও অনলাইন ডেটিং মেকানিজম কিন্তু বেশ সাড়া ফেলেছিল। সে সময় ম্যাচ ডট কম কিংবা কিস ডটকম এর মত ওয়েবসাইট ছিল সেই মানুষদের জন্য যারা সরাসরি ডেটে যেতে বেশ নার্ভাস থাকতো অথবা অনলাইনের দ্বারস্থ হওয়া বিপরীত প্রান্তের মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে ধীরে ধীরে সব কথা বাড়িয়ে এরপর সরাসরি দেখা করা। সেখান থেকে ক্রমশ অনলাইন ডেটিংয়ের প্ল্যাটফর্ম গুলো বিস্তার।

বিজ্ঞাপন

প্রথমদিকে এই ডেটিং ওয়েবসাইট গুলো বেশ কিছু প্রশ্ন করে ইউজারের রুচি সম্পর্কে জেনে নিয়ে বিপরীত লিঙ্গের অন্য কোন মানুষের সাথে তাকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করতো। যে প্রসঙ্গে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম ইহারমই‌। এই প্লাটফর্ম কুইজের উত্তর দেয়ার মাধ্যমে মানুষের পার্সোনালিটি বের করে সে অনুযায়ী তার বন্ধু নির্বাচন করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তখন।

যদিও ২০১২ সালের দিকে ডেটিং অ্যাপ এর জগতে ঝড় তুলতে এলো টিন্ডার। প্রেম ভালোবাসা কিংবা কাছের মানুষের দেখা পাওয়া যায় এই বিষয়গুলোকেও কমার্শিয়ালাইজ করা যায় সেটাই খুব রুহ ভাবে উঠে এলো টিন্ডারের টেম্পারেটি। টিন্ডারের ইন্টারফেস ঢুকে রাইট লেফট লিখে যেভাবে মানুষ পরিবর্তন করার পদ্ধতি শুরু হলো ক্ষেত্র বিশেষে মানুষকে রূপান্তরিত করল মুদি দোকানের আট প্রহরে কোন বন্ধু।

পাশাপাশি মুদ্রার ওপাশে এলো আরেক জটিল প্রেক্ষাপট। যে প্রেক্ষাপটের নাম ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ডেটিং অ্যাপস’। সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে জানিয়ে রাখি সারা বিশ্বের বিচিত্র সব মানুষের বিচিত্র সব রুচির কথা ভেবে আসে বহু ডেটিং অ্যাপস। যারা অদ্ভুত সব পদ্ধতির প্রয়োগ করে আটকে ভোগ করে রাখতে চাই তাদের ইউজার কে।

স্ন্যাপ বা টিকটক স্টাইলে ভিডিও বানিয়ে তারা ইউজারদের সার্ভ করে। মুজ ডেটিং অ্যাপস মুজ মেসেজ পদ্ধতি ও ঠিক এরকম বাম্বল অ্যাপস এ নারীরা এরকম করতো। এই প্লাটফর্মে যেকোনো মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রথম যোগাযোগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে নারীকে।

আর টিন্ডার তো সর্বজনীন। এই অ্যাপের হট অর নোট ফিচার নিয়ে করচা হয় প্রায় প্রতিদিনই। ডেটিংয়ের সিনারি কে একা হতে পাল্টে দিয়ে এই প্লাটফর্ম পুরো এগিয়ে চলেছে। তবে এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তো হতো ফেক প্রোফাইল বানিয়ে মানুষকে ধোকা ডেটিং এর অত্যাচার গায়ে হাত তোলার যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে ধর্ষণ, খুন ডেটিং অ্যাপস এর বরাতে অপরাধের শাখা-প্রশাখা মাটির ঠিক যতোটুকু গভীরে পৌঁছেছে সেই গভীরতার তল টুকু খুঁজে পেয়েছি কি আমরা?

বিজ্ঞাপন

কয়েকটা সমীকরণ জানানো যাক, ২০২০ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারে সার্ভের বরাতে জানা গিয়েছিল আমেরিকার সাত ভাগ নারী যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ এর মধ্যে তারা কোন না কোন সময় ডেটিংস অ্যাপ থেকে অপ্রত্যাশিত মানুষের বিব্রত আচরণকারী মানুষের মুখোমুখি হয়েছেন। ৫৭% নারী সেক্সচুয়াল পুরুষের সাথে মুখোমুখি ইন-কাউন্টারও হয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ডেটিং অ্যাপস এর তিন চতুর্থ অংশ ব্যবহারকারী কোন না কোন ভাবে সেক্সুয়াল হারাসমেন্ট এর শিকার। এবং এক তৃতীয়াংশ মানুষ এসব অ্যাপের মাধ্যমে ডেটিং এ গিয়ে সেক্সুয়াল সল্ভ এর মুখোমুখি হয়েছেন।

আসা যাক উপমহাদেশে এদেশে সন্তানের বিয়ের দায়িত্ব বরাবরই মা বাবার হাতে। মনে হয় এখানে ছেলে ও মেয়ের বিয়ে হয় না বিয়ে হয় দুই পরিবারের। বাবা-মার সন্তানের জন্য একটি ওয়েবসাইট খুলে এরপরও অনলাইনে খুঁজতে থাকে উপযুক্ত পাত্রীর অনুসন্ধান। নিজের জীবন বাছাই করার কাজ আশঙ্কায় বাবা-মার হাত ফসকে চলে এসে সে সন্তানের হাতে তারাই যাচাই বাছাই করে শুরু করেছে প্রিয় মানুষ খোঁজার কাজ।

যে কাজে ডেটিং অ্যাপ গুলো বড়সড় আশীর্বাদ হয়ে ধরা পড়েছে তাদের কাছে। কিন্তু আশীর্বাদ অভিশাপ হতেও কিন্তু এক বিন্দু সময় লাগেনি। যদিও এর পিছনে বিভিন্ন সেক্স প্যাক ভূমিকা আছে যারা অ্যাপস এর মাধ্যমে ছেলে বা মেয়েকে টার্গেট করে। এরপর প্রলোভন দেখিয়ে ডেটে নিয়ে যায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা এবং সে শারীরিক সম্পর্ককে পুঁজি করে একটা পর্যায়ে ভিকটিমকে ব্ল্যাকমেইল করে।

এসব ছাড়াও আপত্তিকর টেক্সট হ্যারাজমেন্ট কিংবা আফতাব শ্রদ্ধার মত পরিনীতি বরণ করতেই হয়। এই সবই হচ্ছে এখন ডেটিং অ্যাপস এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। মহামারির পর থেকে ভারতে বেশ বিস্তৃত হয়েছে ডেটিং অ্যাপস। টিন্ডার, বাম্বেল তো আছেই রিজনাল পর্যায়ের জন্য বানানো হয়েছে টুলিমডিলির মত লোকাল সব ডেটিং অ্যাপস।

বিজ্ঞাপন

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এটাই ভারতের দেখাদেখি বাংলাদেশের মানুষও ক্রমশ অভ্যস্ত হচ্ছে ডেটিং অ্যাপস এ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে, বাংলাদেশে ডেটিং অ্যাপস এর ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৬৮ লাখেরও বেশি এবং সেই সংখ্যাটা কিন্তু ক্রমশ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যোগাযোগ আর সে সাথে অপরাধ।

যতই কিছু ঘটুক না কেন ডেটিং অ্যাপসের মাধ্যমে কিন্তু অনেক কথাবার্তা বলা হয়। ঠিক মানুষ খোঁজার পিছনে কম সময় লাগা ছাড়াও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে এর স্বপক্ষে। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকার এর মত এই ডেটিং অ্যাপের জগতটাও অনেক বেশি অন্ধকারে ঢাকা।

ছবি: Image by freepik


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

আল-মামুনুর রশিদ সাগর

আমার জীবনের লক্ষ্য হলো পৃথিবীকে এগিয়ে নেয়া। আমি জলবায়ু পরিবর্তন, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, ক্রীড়া উন্নয়ন, প্রকৃতি ও পরিবেশের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বৈষম্য এবং দুর্নীতি রোধে কাজ করতে চাই। সর্বোপরি, আমি আগামীর শিশুদের জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থা রেখে যেতে চাই। আমি পুরুষ, নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গ সবার জন্য সমান গ্রহণযোগ্যতা আনয়নে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি।

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading