সম্পাদকীয়

স্বৈরশাসকেরা যান, তাদের মতবাদ থাকে

স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ

বিজ্ঞাপন

স্বৈরশাসক পতনের পরেও মানুষের মধ্যে একধরণের সমঝোতার দরকার পড়ে, একধরণের চুক্তির দরকার পড়ে ও একধরণের অজুহাতের দরকার পড়ে। যখন কেউ মুক্ত এলাকায় নিজেকে একা পায় তখন পুরো ব্যবস্থা তাকে পুনরায় কীভাবে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন করছেন সেটা অতীব জরুরী হয়ে পড়ে। যদি তাকে যথাযথভাবে ‘পুনর্বাসন (Rehabilitation)’ করা না হয়/না যায় তাহলে তিনি নিজেকে ব্যবস্থার বাইরের লোক হিসেবে ভাবতে বাধ্য হবেন। এই বিষয় নিয়ে খুব দ্রুত এবং সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন, এবং এই সংকট কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

কিন্তু এমন কিছু মানুষ পাবেন যারা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে এত মনেপ্রাণে আগলে রেখেছিলেন যে, ব্যবস্থা পরিবর্তন হওয়াটা তাকে স্বস্তি দেয় না বরং মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে যান। তিনি রীতিমতো একধরণের নস্টালজিয়ায় ভোগেন। স্বৈরশাসক পতনের পর উদ্ভূত সমস্ত পরিস্থিতিকে তিনি মনে করেন, “আগেই ভালো ছিলো।” এই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়া মানুষজন সবসময় পুর্বের শর্ত, আদর্শ, ধ্যান-ধারণা, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা, নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো (যা মূলত স্বৈরতান্ত্রিক ছিলো), ইতিহাস, দর্শন এবং চরমপন্থী মনোভাব ও কঠোর শাসন সহ ইত্যাকার আবর্জনাকে প্রচন্ড মিস করতে শুরু করেন।

সাধারণ মানুষ তো বটেই। তারা তো প্রায় নির্দিষ্ট স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলেছেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহলের কিছু মানুষজনও নতুন ব্যবস্থাকে খুব আদরে-সাদরে মোটেই গ্রহণ করতে পারেন না। ইতিহাস সাক্ষী। কারণ আমরা যতই দুর্দান্ত সুরক্ষা-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেদের মনে প্রতিস্থাপন করি না কেন অন্ধ/কালো/দূষিত চিন্তার ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এছাড়াও ক্রমাগত মিথ্যাচার প্রচারের ফলে আমাদের মধ্যে সত্য নির্ণয় করা জটিল ও কঠিন হয়ে উঠেছে, উঠবে। অস্বীকার করার বোধহয় খুব বেশি জায়গা নাই যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি বা আপনি যা লিখছি সেখানের চিন্তার দ্বারাও আমরা প্রভাবিত হই, উক্ত চিন্তার ব্যাপকতা নিয়েও আমরা প্রভাবিত হই।

দুনিয়া ও ‘Absolute Justice’ বিষয়ে সংক্ষিপ্তসার কিছুটা মায়া বা ভ্রম হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ ফেরেশতারা এসে আমাদের শাসনের ভার তো আর কাঁধে নেবেন না। এখন মানুষের তৈরি যেকোনো বিধান হোক সেটা সংবিধান বা আইন তা দিয়ে ‘Absolute Justice’ কায়েম করা সম্ভবপর নহে। ব্যক্তির নিজেকে শোধরানোর বিকল্প নাই। ব্যক্তির নিজেকে সমালোচনা করা, ব্যক্তির নিজের মধ্যে জবাবদিহিতার বিষয়টি সংবিধান বা আইন ঠিক করে দিতে পারবে/পারে না। এই যে নীতি-নৈতিকতার বুলি আওড়াচ্ছেন এতে লাভ হবে না যদি ব্যক্তি নিজেকে প্রশ্নের মধ্যে না নিয়ে এসে তার নস্টালজিয়ায় মধ্যে পড়ে থাকেন।

এই নস্টালজিয়ায় ইতিহাস বিরাট, নিচে সংক্ষিপ্ত তালিকা,

১. মার্টিন হাইডেগার (জার্মান দার্শনিক, নাৎসি পার্টির সদস্য) – আডলফ হিটলার সমর্থক

বিজ্ঞাপন

২. আন্দ্রে মার্লো (ফরাসি লেখক এবং বুদ্ধিজীবী, স্টালিনের সমর্থক) – জোসেফ স্টালিন সমর্থক

৩. আলভিন গুল্ডনার (মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী, মাওবাদে প্রভাবিত) – মাও সেতুং সমর্থক

৪. জিওভান্নি জেন্টিলে (ইতালীয় দার্শনিক, ফ্যাসিবাদের প্রধান তাত্ত্বিক) – বেনিতো মুসোলিনি সমর্থক

৫. ডেভিড পি. চ্যান্ডলার (অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ, খেমার রুজের ইতিহাসবিদ) – পল পট সমর্থক

বিশ্বের সেরা পাঁচজন স্বৈরশাসক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এই বড় বড় দার্শনিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, তাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদরা। তালিকা কিন্তু অনেক বড়। এখন বুঝার সুবিধার্থে আমরা এমন কি সুরক্ষা কবচ নিয়ে আছি যে গত শাসন ও শোষনের খেলাতে আমরা দূষিত বা ‘Corrupt’ হয়ে যাই নাই? আজও উপরোক্ত স্বৈরশাসক মতাদর্শের বহু মানুষ আছে। আজও তাদের হত্যাযজ্ঞ কে প্রশংসা করে এমন কিছু দল পর্যন্ত রয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন, তাদের মত অন্য কেউ-ই সুন্দর ও আদর্শিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম নন।

বিজ্ঞাপন

এর ছোট্ট একটা বিষয় দ্যাখেন, আপনি ‘মৌমিতা দেবনাথ’ এর উপর হয়ে যাওয়া যে নিষ্ঠুরতম ও জঘন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে আপনি বাংলাদেশী হলেও কিন্তু প্রতিবাদ করছেন। এ যেন পুরনো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়! যেখানে হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম চীন নিয়ে আন্দোলন এবং সংঘর্ষ চলছে। পুরো বিষয়টি সুন্দর এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়া উচিত। কিন্তু কিশোরী ‘স্বর্ণা দাস’ হত্যায় আমাদের মুখ বন্ধ। এখানে আমাদের অজুহাত আছে একত্র হবার। কারণ যে নিজের বাড়ির মেয়েকে সুরক্ষা দিতে পারেনা অন্তত তার মুখে অন্য বাড়ির মেয়ের প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায় নিয়ে নীতিবাক্য মানায় না।

আমাদের বাড়ির মেয়ের সুরক্ষা (হোক সেটা খাতুন বা দাস) নিয়ে কথা বলায় আপত্তি থাকা উচিত নয়। এটুকু জাতীয়তাবাদ অন্যায় নয়। আর যারা এটুকুও বিকিয়ে দিয়েছেন তারাই হলেন উপরোক্ত স্বৈরশাসক মতাদর্শের ভক্ত এবং একই সাথে উপনেশবাদের/সাম্রাজ্যবাদের ধারক ও বাহক।

জর্জ অরওয়েলের ‘এনিমেল ফার্ম’ পুনরায় জন্ম নিতে পারে। আমাদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু মির্জা গালিব কে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, প্রথম আলো পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক, মাও সেতুং এর একটি লাইন ভারতীয় গণমাধ্যম (Newslaundry) কে ভদ্রলোক জাভেদ হুসেন এভাবে বলেছেন,

“রেভ্যুলেশন তো কই ডিনার পার্টি নেহি হে, না!

জো এটিকেট ঠিক কারকে কিয়া জায়েগা”

বিজ্ঞাপন


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading