হযরত শাহ জালাল (রাহঃ): সিলেটের আধ্যাত্মিক পথিকৃৎ ও ইসলামের প্রচারক
প্রাথমিক জীবন
হযরত শাহ জালাল (রাহঃ) এর পুরো নাম শেখ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররাদ। তিনি ৬৭১ হিজরী এবং ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়, ৭০৩ হিজরী অর্থাৎ ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন। এই বিষয়ে কিছু ভিন্ন মতামত থাকলেও, হযরত শাহ জালাল (রাহঃ) এর সমাধির খাদিমদের প্রাপ্ত ফারসি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লেখিত তারিখই সঠিক বলে ধারণা করা হয়। সেই ফলক লিপিটি এখন ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। হযরত শাহ জালালের মাধ্যমেই সিলেটে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ঘটে। তার সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হযরত শাহ জালালের সংগী-অনুসারীদের মধ্যে থেকে অনেক পীর দরবেশ এবং তাদের পরবর্তী বংশধরগণ সিলেট বিজয়ের পর সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন।
পরিবার ও শৈশব
- পিতার নাম: মাহমুদ বা মোহাম্মাদ
- পিতামহের নাম: ইব্রাহিম
- জন্মস্থান: প্রাচীন আরবের হেজাজ ভূমির ইয়ামিন দেশের কুনিয়া শহর
- মাতৃহীন: তিন মাস বয়সে মাকে হারান
- পিতৃহীন: পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান
- দত্তক: মামা আহম্মদ কবির তাকে দত্তক নেন এবং মক্কায় নিয়ে যান
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
শাহ জালালের মামা ও গুরু সৈয়দ আহম্মদ কবির তাকে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করেন। তিনি শাহ জালালকে ইসলামের শরীয়াহ ও মারিফত উভয় ধারায় শিক্ষা দেন। তার মামা মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দী তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত খানকার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। শাহ জালালকে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। তিনি শাহ জালালকে ইসলামের শরীয়াহ ও মারিফত উভয় ধারায় শিক্ষা দান করেন।
দরবেশী জীবন
শাহ জালাল একটি দরবেশী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ এবং মাতার দিক থেকে তিনি ছিলেন প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ সুরুজ বোখারীর দৌহিত্র। তার মামা আহম্মদ কবিরও তৎকালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন। আহম্মদ কবির যখন শাহ জালালের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন তখন থেকেই তিনি তাকে দরবেশী তর-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালী শিক্ষা দেন।
সিলেট আগমন
শাহ জালাল তার মামা ও শিক্ষাগুরু সৈয়দ আহম্মদ কবিরের সঙ্গে আরবেই ছিলেন। একদিন তিনি ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখেন এবং তা তার মামাকে জানান। তার মামা তাকে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে ভারতবর্ষে যাওয়ার পরামর্শ দেন। শাহ জালালের যাত্রাকালে কবির তার হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বলেনঃ যেখানে এই মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মিল এক হবে সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। তারপর শাহ জালাল ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মক্কা শরীফ থেকে একাই যাত্রা শুরু করেন।
হিন্দুস্থানে প্রবেশ
শাহ জালাল মক্কা হতে বিদায়কালে যে কয়েকজন সঙ্গী তার সাথে যাত্রা করেন, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী খলিল, হাজী ইউসুফ, হাজী দরিয়া এবং আরেকজন সঙ্গীর নাম ছিল চশনী। হিন্দুস্থানে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সমরকান্দ থেকে সৈয়দ ওমর, বাগদাদ থেকে নিজামুদ্দিন, রোম থেকে করিমদাদ, ইরান থেকে জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করেন। এরপর সুলতান থেকে আরিফ, আজমির শরীফ থেকে মুহাম্মদ শরীফ, দক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাশেম প্রমুখ তার মুরীদ হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবেই যখন তিনি দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছালেন তখন তার শীর্ষদের সংখ্যা ছিল ২৪০ জন।
নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাথে সাক্ষাত
দিল্লীতে আসার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জৈনক শীর্ষ গুরুর কাছে শাহ জালালের কুৎসা রটনা করেন। এছাড়া নিজামুদ্দিন অন্যদেরও কুৎসা রটনা করতেন। তাই এই শীর্ষকে উপযুক্ত শাস্তি সরূপ দরবার থেকে তাড়িয়ে দেন এবং দুই শীর্ষকে ডেকে তাদের মারফতে শাহ জালালের কাছে সালাম পাঠান। শাহ জালাল এই সালামের উত্তরে উপহার স্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জ্বলিত আঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে নিজামুদ্দিনের নিকট পাঠান। নিজামুদ্দিন আউলিয়া শাহ জালালের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। যার বংশধর এখনও তার মাজার সংলগ্ন এলাকায় দেখা যায়। এদেরকে জালালি কবুতর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদী পারাপার
শাহ জালাল সোনারগাঁ এসে পৌঁছালে সিকান্দার তাকে সসম্মানে গ্রহণ করেন। শাহ জালাল তার সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ সিকান্দারের শিবিরে সমাগত হন এবং যুদ্ধ বিষয়ে অবগত হন। তারপর সেখান থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এই সময় তার শীর্ষ সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জন হয়। গৌড় গবিন্দ এই সংবাদ পেয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেন। তবে জানা যায় যে, শাহ জালাল সে সময় জায়নামাজের সাহায্যে নদী পার হন।
সিলেট প্রবেশ
খ্রিস্টীয় দশম শতকে শ্রীহট্ট ভূমি লাউড়, জয়ন্তিকা ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে গৌড় ছিল অন্যতম রাজ্য। এই রাজ্যের দক্ষিণ সীমাভূমি নবীগঞ্জের দীনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। শাহ জালাল ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে প্রথমে সেখানে অবস্থান করেন। তবে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা তাদের অগ্নীবাণ দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা তাদের কিছুই করতে পারেনি। এই বিষয়টি রাজা গোবিন্দ জানতে পেরে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেন। কিন্তু শাহ জালাল পূর্বের ন্যায় জায়নামাজে করে নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারের সময় তারা সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর স্থানে রাত্রী যাপন করেন। শাহ জালাল ফতেহপুর থেকে যাত্রা শুরু করে সুরমা নদীর তীরে অবস্থান নেন। এই নদী পার হলেই গৌড়ের রাজধানী। রাজা গোবিন্দ তাদের কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু শাহ জালাল বিসমিল্লাহ বলে তার মুরিদদের নিয়ে অনায়াসে নদীর ওপারে চলে যান। রাজা গৌড় গোবিন্দ যখন দেখলেন যে তার সকল প্রয়াসই বিফল হচ্ছে তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে যাদু মন্ত্র সহ এক প্রকাণ্ড লৌহ ধনুক শাহ জালালের কাছে প্রেরণ করেন। যার শর্ত ছিলো যদি কেউ এই ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তাহলে রাজা গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। তখন শাহ জালাল তার লোকদের ডেকে বললেন; যে ব্যক্তি জীবনে কখনও ফরজ নামাজ কাজা করেনি বা কোনো কারণে বাদ পড়েনি একমাত্র সেই ব্যক্তি এই লৌহ ধনুক জ্যা করতে পারবে। অতঃপর মুসলিম সৈন্যদলের মধ্যে অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিনকে পাওয়া গেলো এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন।
রাজা গোবিন্দের পরাজয়
গোবিন্দ রাজা সে সময় গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি ত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্ত গিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। এরপর আর তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। শাহ জালাল তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর, প্রথমে মীনারের টীলায় অবস্থিত রাজবাড়ি দখল করেন।
সিলেটে অবস্থান ও ইসলাম প্রচার
শাহ জালাল সিলেটে অবস্থানকালে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। তার নেতৃত্বে সিলেট অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তার মুরিদ ও অনুসারীরা সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। শাহ জালালের আধ্যাত্মিক শক্তি ও ধর্মীয় জ্ঞান সিলেটের মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে।
শাহ জালালের মাজার
শাহ জালালের মৃত্যুর পর তার মাজার সিলেট শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মাজার সিলেটের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর অসংখ্য ভক্ত ও পর্যটক তার মাজারে আসেন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তার মাজার সংলগ্ন এলাকায় এখনও তার উপহার দেওয়া সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায়, যাদেরকে জালালি কবুতর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
উপসংহার
হযরত শাহ জালাল (রাহঃ) এর জীবনী আমাদেরকে তার আধ্যাত্মিক শক্তি, ধর্মীয় জ্ঞান এবং ইসলাম প্রচারের জন্য তার অবদান সম্পর্কে জানায়। তার জীবন ও কর্ম আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে এবং তার শিক্ষা আমাদেরকে সঠিক পথে চলার প্রেরণা দেয়। তার জীবনী আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের ধর্মপ্রচারকরা কেবল ধর্ম প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং তারা সমাজের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেন।