ইতিহাস

হযরত শাহ কামাল ইয়েমেনী (রহঃ): ইসলামের মহান প্রচারক ও সুফী সাধক

বাংলাদেশে ইসলামের আলো ছড়ানো এক মহান ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্ম

বিজ্ঞাপন

হযরত শাহ কামাল ইয়েমেনী মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সুফী সাধক, সম্রাট, সুলতানুল আউলিয়া কুতুবুল আলম ছিলেন। চট্টগ্রামে আসা প্রসিদ্ধ বারো আউলিয়াদের মধ্যে তিনি একজন। আমরা আজকে তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

জন্ম

হযরত শাহ কামাল ছিলেন একজন জনহিতৈষী, সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মী। তিনি ১২৯১ সালে তৎকালীন নজদের হিজাজ প্রদেশের মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

বংশ পরিচয়

শাহ কামাল ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বক্করের জেষ্ঠপুত্র আবদুল রহমান ইবনে আবি বক্করের বংশধর ছিলেন। তিনি কুরাইশ বংশের বংশধর ছিলেন।

ইসলামের প্রচার ও প্রভাব

হযরত শাহ কামাল তার নবদম্পতি এবং তার শীর্ষদের নিয়ে আরবের ইয়েমেন প্রদেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে আসেন ইসলাম প্রচারের জন্য। তিনি প্রথমে সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত কামারখন্দের এক জলাবদ্ধ দ্বীপে আস্তানা গড়ে তোলেন। তার ৫ জন পুত্র সন্তান ছিলো। সেখানে পুত্রদের জনবসতি বাড়তে বাড়তে সেটা একটি গ্রামে পরিণত হয়। শাহ কামাল (রহঃ) এর নামানুসারে সেই গ্রামের নামকরণ করা হয় নান্দিনা কামালিয়া। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু জমিদারদের কাছ থেকে প্রচুর জমি লাখেরাজ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ভূঁইয়া উপাধি দেয়।

তার মাজারের পাশে কিছু ফাঁকা জায়গা দেখা যায়, শোনা যায় যে, শাহ কামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে অবস্থান করতেন। তিনি সারাদিন ইসলাম প্রচারের কাজ করতেন এবং রাতে সেখানে ফিরে আসতেন। তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন।

বিজ্ঞাপন

শাহ কামাল (রহঃ) তার পুরো জীবনই ইসলাম প্রচারের কাজে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত নরম স্বভাবের ছিলেন। তার সুন্দর বক্তব্য ও কারামতের ফলে মুগ্ধ হয়ে অনেক হিন্দু তাদের ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যান।

কাদেরিয়া তরিকা

তিনি কাদেরিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিলোনা। তিনি উচ্চ স্তরের কামেল ছিলেন। কেউ তাকে কুতুবুল আকতাব বলেছেন আবার কেউ তাকে কুতুবে মাদার বলেছেন।

শাহ কামাল (রহঃ) তাফসির, হাদীস, ফিকহ ও তাসাউফ শাস্ত্রের উপর বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি জাহেরী শাখায় জ্ঞান অর্জন করার পরে বাতেনী জ্ঞান অর্জনের জন্য কুতুব হযরত শাহ ফোজায়েল (রহঃ) এর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। কঠিন সাধনা, মোরাকাবা, মোশাহাদা ও পূর্ণ সুন্নাতের মাধ্যমে ইলমে মারেফাতের অতি উচ্চতর মাকামে উন্নিত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।

অলৌকিক কাহিনী

প্রতিমার পূজা বন্ধ করা

শাহ কামাল (রহঃ) একদিন তার আস্তানা থেকে কোন একটি এলাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তিনি দেখলেন যে, কিছু লোক মাটির প্রতিমার পূজা করছেন, সেখানে সিদূর, দুধ, কলা ইত্যাদি দিচ্ছেন। এ সকল কার্যকলাপ দেখে তিনি মর্মাহত হলেন এবং তাদেরকে মজাহিদের কন্ঠে বললেন, “হে লোকসকল, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং মুহাম্মদ (স.) কে রাসুল হিসেবে মান”। তখন লোকজন ক্ষীপ্ত হয়ে বললো, আমরা যদি মিথ্যা হই তাহলে তুমি যে সত্য ধর্মের আহ্বানকারী তার প্রমাণ কোথায়? শাহ কামাল (রাহঃ) বললেন, তোমরা যার পূজা করছো সে যদি বলে তাহলে বিশ্বাস করবেতো? তাই বলে তিনি মাটির প্রতিমাকে বললেন, “হে মাটির প্রতিমা, কথা বল”। তখন মাটির প্রতিমা হাত নেড়ে বলল, “আমাদের কোন ক্ষমতা নেই”। এই ঘটনা দেখে দলে দলে লোকজন মুসলমান হয়ে গেলেন।

আল্লাহর প্রেমে মগ্ন

তিনি আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হয়ে দিবারাত্রী বনে-জঙ্গলে, মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়াতেন। অনেক সময় মরুভূমিতে উজ্জ্বল নয়নাভিরাম দেখা যেত। নগরবাসী সাদরে তাকে নিয়ে যেত এবং সারারাত তার খেদমতে কাটিয়ে দিত। অথচ সকালবেলা অধিবাসীসহ নগর উধাও হয়ে যেত।

বিজ্ঞাপন

নবাবের সাথে ঘটনা

প্রায় ৫০০ বছর আগের ঘটনা, হযরত শাহ কামাল তার আস্তানায় ধ্যান মগ্ন অবস্থায় ছিলেন। সেই সময় জৈনক নবাব নৌকা যোগে কালিয়া কান্দাপাড়া কাচারী পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে প্রবল ঝড় তুফানের কারণে পথহারা হয়ে নৌকা একটি জঙ্গলের নিকট গিয়ে আটকে যায়। মাঝিরা খোঁজ নিয়ে দেখেন, চারিদিকে পানি। মাঝখানে একটি দ্বীপের ন্যায় উঁচু জায়গা রয়েছে। সেখানে একটি গাব গাছ রয়েছে এবং সেখানে ছোট্ট একটি ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। মাঝিরা নবাবকে এই খবর জানান। নবাব সেখান থেকে আগুন এনে খাবার প্রস্তুত করতে বললেন। মাঝিরা ওখানে আগুন আনতে যাওয়ার সাথে সাথে ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো, “কে তোমরা?” মাঝিরা বললেন, “আমরা নবাবের লোক, খাবার তৈরী করার জন্য আমরা একটু আগুন নিতে এসেছি”। একথা শুনে শাহ কামাল বললেন, “আগুনের দরকার নেই। আপনাদের সকলের দাওয়াত”। মাঝিগণ কথাটি নবাবকে জানালেন। শাহ কামাল তার কারামতের গাব গাছের পাতায় খাদ্য নিয়ে তাদেরকে দিলেন। নবাব অবাক হয়ে বললেন, “দরবেশ সাহেব, এই সামান্য খাবার সবাব হয় কেমন করে?” শাহ কামাল (রহঃ) বললেন, “আপনারা বিসমিল্লাহ বলে খানা খান”। সকলে খাওয়া শুরু করলেন। সকলে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার পরে ও খাবার আগের ন্যায় রয়ে গেল। নবাব এটা দেখে অবাক হয়ে এই এলাকার সম্পত্তি তাকে দান করে দেন।

মৃত্যু

হযরত শাহ কামাল ১৩৮৫ সালে শাহারপাড়ায় পরলোক গমন করেন। সে সময় তার বয়স হয়েছিলো ৯৫ বছর। তার মৃত্যুর পর তার ৫ পুত্র ও তার ভক্তরা তাকে নান্দিনা কামালিয়া গ্রামের পূর্ব পাশে ৮টি গাব গাছ বিশিষ্ট জায়গায় দাফন করেন।

মাজার ও ওরস শরীফ

গাব গাছ বিশিষ্ট জায়গায় শাহ কামালের মাজার অবস্থিত। প্রতি বছর ফাল্গুনের প্রথম বৃহস্পতিবার এই মাজারে মহা পবিত্র ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে আল্লাহর অলির মাজার জেয়ারত করেন। তবে মূল মাজারে সিজদা করা নিষেধ এবং মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। ওরসে আদায়কৃত টাকা, পণ্য সামগ্রী, পশু ইত্যাদি থেকে মাজারের মেরামত, কবরস্থানের উন্নয়ন, হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ সহ ওরসে আগত মানুষদের খাওয়ানোর কাজে ব্যবহারিত হয়।

তথ্যবহুল টেবিল

বিষয় বিবরণ
জন্ম ১২৯১, মক্কা
বংশ কুরাইশ
প্রচার এলাকা বাংলাদেশ
মৃত্যু ১৩৮৫, শাহারপাড়া
মাজার নান্দিনা কামালিয়া

শেষ কথা

হযরত শাহ কামাল (রহঃ) ইসলামের মহাবাণী পৌঁছানোর জন্যই সুদূর মক্কা শহর ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দেন। তার সদ্ব্যবহার ও কারামতের দরুন মানুষ তাদের ভুল পথ থেকে সত্যের পথে ফিরে আসেন। আমাদেরও উচিত শাহ কামাল (রহঃ) এর মতো একটি আদর্শ জীবন গড়া।

বিজ্ঞাপন


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

নুরুন্নাহার বানু

কন্টেন্ট রাইটার, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading