সত্য ও মিথ্যার সন্ধানে: দেকার্তের পদ্ধতিগত সন্দেহের আলোকে
কীভাবে আমাদের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতাকে যাচাই করে নিশ্চিত হতে পারি?
আমরা কীভাবে বুঝবো যে, আমরা যা-কিছুই দেখছি বা বলছি সেটাই সত্য বা ঠিক? আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা অকাট্য সত্য কীভাবে? হতেও পারে, আমরা একটি স্বপ্নের মধ্যে আছি এবং এই অলীক স্বপ্নে বিভোর থেকে আমাদের সকল কার্যক্রম এবং পূর্ব অভিজ্ঞতাকে সত্য ও সঠিক বিবেচনায় নিচ্ছি। আমাদের চিন্তাশীল ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে রাখে।
সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য
উদাহরণ: পার্টনারের উপস্থিতি
উদাহরণস্বরূপ, আপনার পার্টনার আপনার পাশে আছে। আপনাকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু আমি যদি বলি যে, তিনি আপনার পাশে নাই। আপনি স্রেফ একটি স্বপ্ন দেখছেন এবং এই বাস্তবতা বাস্তব ও সত্য নয়। না, আমি আপনার পার্টনারকে সন্দেহের চোখে দেখতে বলছি না। আমি বলতে চাইছি, হ্যাঁ, তিনি উপস্থিত আছেন এই সত্যটুকু আপনি দেখতে পাচ্ছেন, অনুভব করতে পারছেন এবং বিশ্বাসও করেন।
সত্য ও মিথ্যার সমস্যা
আমার প্রশ্ন হলো, কেমন হবে যদি এই চরিত্রগুলো মায়ার মত মিথ্যে হয়? বা এই চরিত্রগুলোর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব-ই না থাকে? হড়কে যাবেন নিশ্চয়! কারণ এই একই প্রশ্নে আমাদের আইডেন্টিটি (পরিচয়) সংকট তৈরি হতে বাধ্য। একই সাথে ধর্মের সাথেও সাংঘর্ষিক। কারণ এই একই প্রশ্নে আমাদের স্রষ্টাও উহ্য হয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁকে খুঁজে বের করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। যেহেতু আমরা স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকাটাকে নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছি সেহেতু সোজা বাংলায়, আপনি এখন ‘Existential Crisis’ এ পড়ে গেছেন।
নিশ্চয়তার প্রয়োজনীয়তা
আমাদের যে কোন বিষয়ে ‘নিশ্চয়তা (Certainty)’ অবশ্য প্রয়োজনীয় যাতে করে সে পাটাতনে উঠে আমরা আমাদের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক মতামত, সিদ্ধান্ত, অবস্থান, সত্যতা, বিশ্বাস ইত্যাদি যে সমস্ত সম্ভাব্য পরিকাঠামো আছে সেসমস্ত ঠিকঠাকমতো ফাংশন করতে পারে। এই কথাগুলো কিছুটা হলিউডের ‘The Matrix (1999)’ এবং ‘Inception (2010)’ সিনেমার মত শোনায়। কিন্তু এই দর্শন আমাদের উপহার দিয়েছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ‘রেনে দেকার্তে (René Descartes)’। তিনি তার বই ‘Meditations on First Philosophy (১৬৪১)’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
পদ্ধতিগত সন্দেহ (Methodological Skepticism)
এই বইতে রেনে দেকার্তে বলছেন, “যা কিছুই সন্দেহ করা যায়, তার সবকিছুকেই সন্দেহ করো।” দার্শনিক এই অনুসন্ধানের পদ্ধতিকে ‘কার্টেসিয়ান মেথড’ বা ‘পদ্ধতিগত সন্দেহ’ বলেছেন। আবার এই পদ্ধতিগত সন্দেহের ৩টি ধাপ নিয়ে তিনি আলোচনাও করেছেন।
১. শ্রেণিবদ্ধ করা
প্রথম ধাপে, আমাদের বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস এবং উক্তিগুলি শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে। মানে, আমরা যা জানি বা বিশ্বাস করি, তার সূত্র কী এবং এটি কেমন ধরনের জ্ঞান তা বুঝতে হবে।
উদাহরণ:
- ইন্দ্রিয়জ্ঞান: যা আমরা আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিভ, চামড়া) ব্যবহার করে জানি। যেমন, আগুনের তাপ গরম।
- যুক্তি বা তর্ক: যা আমরা যুক্তি এবং বিশ্লেষণ ব্যবহার করে জানি। যেমন, গণিতের সমীকরণ সঠিক হলে তার ফলাফলও কিন্তু সঠিক হবে।
২. পরীক্ষা করা
দ্বিতীয় ধাপ হলো, আমরা প্রতিটি শ্রেণির উদাহরণ পরীক্ষা করে দেখবো। আমরা দেখবো, সেই বিশ্বাস বা জ্ঞানটি আদৌ সত্য কিনা।
উদাহরণ:
- ইন্দ্রিয়জ্ঞান পরীক্ষার জন্য: আমরা যদি দেখি যে, একটি লাঠি পানির মধ্যে ভেঙ্গে গেছে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা ভেঙ্গে যায়নি। এটা প্রমাণ করে যে আমাদের চোখ কখনও কখনও ধোঁকা দিতে পারে।
- যুক্তির পরীক্ষার জন্য: আমরা গণিতের সমীকরণ পরীক্ষা করে দেখতে পারি। যেমন, ২+২=৪ সব সময়ে সত্য।
৩. মিথ্যা হিসেবে গ্রহণ করা
তৃতীয় ধাপে, যে সমস্ত উক্তি বা জ্ঞানের ধরণ নিঃসন্দেহে সত্য নয়, সেগুলি মিথ্যা হিসেবে গ্রহণ করবো। এই ধাপে, আমরা সমস্ত উক্তি এবং বিশ্বাসকে পরীক্ষা করার পর যা নিঃসন্দেহে সত্য নয়, সেগুলোকে মিথ্যা বলে ধরে নেবো। অর্থাৎ, যা সন্দেহের উর্ধ্বে নয়, তা আমরা সত্য হিসেবে গ্রহণ করবো না।
উদাহরণ:
- ইন্দ্রিয়জ্ঞান: যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয় আমাদের ধোঁকা দিতে পারে, তাই সব ইন্দ্রিয়জ্ঞান আমরা মিথ্যা বলে ধরে নেবো।
- যুক্তি: যুক্তিগতভাবে যা প্রমাণিত তা আমরা সত্য বলে ধরে নেব, যেমন গণিত।
জ্ঞানতাত্ত্বিক পক্ষপাতিত্ব (Cognitive Bias)
পদ্ধতিগত সন্দেহের ৩টি পর্যায় নিয়ে তো আলোচনা করা হলো কিন্তু আমি নিজেই বিল্ট-ইন কিছু বিশ্বাসের সাথে যুক্ত আছি। তাহলে তো চলবে না। নতুন বিশ্বাস সিস্টেম নিজের মধ্যে ইনস্টল করার জন্য প্রথমে আপনাকে আপনার বিল্ট-ইন বিশ্বাসকে সন্দেহ করতে হবে। যেটাকে আমরা বলে থাকি ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক পক্ষপাতিত্ব’।
রেনে দেকার্তে এই জ্ঞানতাত্ত্বিক পক্ষপাতিত্বকে সরাসরি খারিজ করেছেন। আমরা সাধারণভাবে ফেসবুকে ভূয়া খবর নিয়ে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
উদাহরণ: ফেসবুকে ভূয়া খবর
১. সন্দেহ (Methodological Skepticism): আপনি একটি খবর দেখলেন যেখানে বলা হচ্ছে, “পূর্ববর্তী সরকার ১০০ বিলিয়ন ডলারের দূর্নীতি করেন নাই।”
প্রথম কাজ: এই খবরটি সত্যি হিসেবে গ্রহণ না করে সন্দেহ করুন। সন্দেহের কারণ: এটি একটি বড় অংকের দূর্নীতির খবর, যা সাধারণত বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া যায়।
২. বিস্তারিত বিভাজন (Analytical Reduction): এই খবরটির বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করুন।
- খবরটির উৎস: এটি কোন সংবাদ মাধ্যম বা উৎস থেকে এসেছে?
- প্রকাশকাল: খবরটি কবে প্রকাশিত হয়েছে?
- সংযুক্ত তথ্য ও প্রমাণ: দূর্নীতির বিষয়ে কোন প্রমাণ বা যুক্তি দেওয়া হয়েছে কিনা?
৩. পরিপূর্ণ সার্বিকতা (Comprehensive Synthesis): এবার এই তথ্যগুলো যাচাই করে দেখুন।
- বিশ্বস্ত সূত্র যাচাই: অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন দেখে খবরটির সত্যতা যাচাই করুন।
- প্রমাণ পরীক্ষা: দূর্নীতির বিষয়ে উল্লিখিত তথ্যপ্রমাণ যাচাই করুন।
রেনে দেকার্তের সিদ্ধান্ত
রেনে দেকার্ত সত্যতা যাচাইয়ের পর যা বলেছেন তা খুবই গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ। দেকার্তের পদ্ধতিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সত্যতা যাচাই করে তিনি বলছেন, “Cogito, ergo sum” (আমি ভাবছি, তাই আমি আছি)।” মানে হলো ‘আমি নাই’ এই চিন্তাটুকুও তো কোনো ডেমন হোক বা স্রষ্টা তিনি আমাকে জানাচ্ছেন।
যদিও এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা অনেক। কারণ সবকিছু সন্দেহের চোখে দেখলে অনিশ্চয়তা আরো বাড়বে। সব সত্যকে বিচার ও বিশ্লেষণ দিয়ে সত্য প্রমাণ করা অনেক সময়সাপেক্ষ। একেবারে ব্যক্তি পক্ষপাতদুষ্ট থেকে দূরে থাকা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার সবকিছুর জন্য নির্ভরশীল সূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি এক ধরণের জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়।
তবুও, ভয়ানক জটিল পরিস্থিতিতে সবকিছুকেই সন্দেহ করা ছাড়া আমাদের হাতে বিশেষ কোনো চয়েস/অপশন নাও থাকতে পারে। সুতরাং দেকার্ত অনেকদূর পর্যন্ত আজও প্রাসঙ্গিক হতে বাধ্য।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.