সম্পাদকীয়

ইসকন (ISKCON): আধ্যাত্মিক আন্দোলন নাকি বিতর্কিত সংগঠন?

ইসকনের ইতিহাস, উদ্দেশ্য, এবং সমালোচনা: একটি বিশ্লেষণ

বিজ্ঞাপন

‘ইসকন (ISKCON)’ নিয়ে কোথাও একটি পূর্নাঙ্গ আর্টিকেল নাই। খাপছাড়া কিছু ভিডিও, কিছু আর্টিকেল খুঁজে খুঁজে দেখতে ও পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি এই সংগঠনের সাথে জড়িত বা এই সংগঠন সম্পর্কে যারা জানেন তাদের থেকে তথ্য নিতে হচ্ছে। আমার আজকের এই আর্টিকেল ‘ইসকন (ISKCON)’ নিয়ে। এই সংগঠন কেন পয়দা হইছে? এই সংগঠনের উদ্দেশ্য কি? এই সংগঠনের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ কেন? এবং এই সংগঠন কে বাংলাদেশ থেকে বাতিল প্রসঙ্গ সহ নানান আলোচনা ক্ষুদ্র পরিসরে করবার চেষ্টা করছি।

‘ইসকন (ISKCON)’ এর পুর্ণরুপ হলো, International Society for Krishna Consciousness (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ)। ইসকন ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই নিউ ইয়র্ক শহরে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান শুরুর দিকে ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়ে। শ্রীল প্রভুপাদ (ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা) মূলত বৈদিক শাস্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ ও ভাষ্য সম্বলিত বই বিক্রি করে ইসকন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সঞ্চয় করতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ছোট ছোট বই ও পুস্তিকা যেমন ‘Easy Journey to Other Planets’ ও ‘The Science of Self-Realization’ ইত্যাদি।

ইসকন প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে সাংস্কৃতিক বাধার মধ্যে পড়ে তাও দুই ভাবে। এক, পশ্চিমা সমাজে ইসকনকে ছড়িয়ে দেওয়া মোটেই সহজ ছিলো না। তার প্রধান কারণ এই ‘কৃষ্ণভাবনামৃত’ এই জিনিসটাই অনেকেই বুঝেন না। একই সাথে এই প্রতিষ্ঠান পশ্চিমা রাষ্ট্রের জন্য সিকিউরিটি থ্রেট কিনা সে বিষয়েও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। দুই, খোদ হিন্দু সম্প্রদায় ইসকনের প্রচার পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বারবার; আজও। কারণ এতদিনে ইসকনে প্রবেশ করেছেন অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং তারকা পর্যন্ত এবং স্বভাবতই যে প্রতিষ্ঠানের তহবিল যত বড় সে প্রতিষ্ঠানের প্রচার, প্রসার ও নেটওয়ার্ক ততবেশি বিস্তৃত হতে বাধ্য।

ইসকনকে নিয়ে অন্য একাধিক হিন্দু সংগঠনের ঈর্ষার কারণে সমালোচনা আছে। কারণ সমস্ত হিন্দু প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন হাতে গোনা নয় এবং এই প্রতিযোগীদের প্রায় সবাইকে সহসাই হারিয়ে দিয়েছে ইসকন। কিন্তু একাধিক হিন্দু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ইসকন নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব্য করেছেন বারবার। এই মন্তব্যগুলোর মধ্যে কোনটা কতটুকু সত্য তা শুধুমাত্র একজন হিন্দু পন্ডিত হয়তো ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তাদের আপত্তির মধ্যে প্রধান দুটি আপত্তি হচ্ছে,

১. একাধিক হিন্দু সংগঠন মনে করেন ইসকন একটি উগ্রবাদী সংগঠন বা মুভমেন্ট বা ‘হরে কৃষ্ণ আন্দোলন’ এবং ইসকনের শেকড় বা পাঠদান প্রক্রিয়া খোদ হিন্দু ধর্মকে ছোট করছে বলেও অভিযোগ আছে।

বিজ্ঞাপন

২. একাধিক হিন্দু সংগঠন মনে করেন পশ্চিমাদের চালচলন হিন্দুধর্মের মূলনীতি বা সংস্কৃতির সাথে কোনোভাবেই যায় না। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেহেতু এই প্রতিষ্ঠান সমালোচিত হতে বাধ্য।

চট্রগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী হিন্দু সংগঠন ‘প্রবর্তক সংঘ’ ইসকনকে উগ্রবাদী এবং হিন্দু ধর্মবিরোধী বলে মনে করেন।

হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আমরা কি জানি?

হিন্দু ধর্মে একাধিক দেব দেবতার পূজা প্রচলিত রয়েছে। আরো সংক্ষেপে হিন্দু ধর্ম হলো একটি ‘বহুঈশ্বরবাদী ধর্ম (Polytheistic Religion)’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দু ধর্মে ব্যক্তি তার পছন্দমত দেবতাকে পূজা করতে পারেন। হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এর বহুত্ববাদী প্রকৃতি, যেখানে বিভিন্ন দেবতা ও দেবীর পূজা প্রচলিত। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, সকল দেবতা এক পরম সত্যের বিভিন্ন রূপ, এবং তাই তারা তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোনো দেবতাকে পূজা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, কেউ শিবের পূজা করতে পারেন, আবার কেউ বিষ্ণুর পূজা করতে পারেন। কেউ কেউ সরস্বতী, লক্ষ্মী, দুর্গা বা গণেশের পূজা করেন। এই বৈচিত্র্য হিন্দু ধর্মের সহনশীলতা ও উদারতার প্রতিফলন দেখায়।

কিন্তু ‘ইসকন (ISKCON)’ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানানো হয় না। কি সেই সিক্রেট? আসল সিক্রেট হলো, ‘ইসকন – ISKCON (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ)’ হলো একটি একেশ্বরবাদী সংগঠন। কি? একেশ্বরবাদী! হ্যাঁ, তারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর হিসেবে পূজা করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, তিনি সকল সৃষ্টির মূল। ISKCON-এর মূল ধর্মবিশ্বাস শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতমের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ISKCON-এর ভক্তরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম জপ, কীর্তন এবং ভক্তিযোগের মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করেন। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র সর্বোচ্চ ঈশ্বর এবং তাঁর উপাসনা করাই মুক্তির পথ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশের ইসকনের একজন প্রাক্তন নেতাকে দেশদ্রোহী মামলায় গ্রেফতার করা হলে এর বিরুদ্ধে ইসকন সমর্থকরা ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান কেন দিচ্ছেন? তারা তো একেশ্বরবাদী। তারা কি বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্র কে মানেন? উত্তর হলো, না।

তাহলে ইসকন সমর্থক কেন ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিচ্ছেন? এর প্রতুত্তরে ইসকন সমর্থকেরা জানান, “ ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানটি রামচন্দ্রের প্রতি ভক্তির প্রকাশ। যেহেতু রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের একটি অবতার, তাই ISKCON-এর ভক্তরা কখনও কখনও এই শ্লোগান ব্যবহার করতে পারেন।” কিন্তু তারা রামচন্দ্র কে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন না, করতে রাজী নন কোনোভাবেই। আবার এই ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানটি একটি রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের উগ্রবাদী রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির প্রধান শ্লোগান হলো ‘জয় শ্রীরাম’। ঠিকাছে, ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহ্‌ আকবার (উচ্চ আওয়াজে বলো, আল্লাহ্‌ সর্বশ্রেষ্ঠ)’ খুব সুন্দর শব্দ এবং ‘জয় শ্রীরাম’-ও খুব সুন্দর শব্দ যার যার ধর্ম অনুযায়ী। হতে পারে এই দুই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা প্রকাশে সক্ষম; একইসাথে এই দুই শব্দ বা ‘Analogy’ টানার উদ্দেশ্য হচ্ছে এর ‘Essence’ টা বুঝানো।

বিজ্ঞাপন

জাতীয়তাবাদ খুব ভালো জিনিস নয়, কিন্তু নূন্যতম জাতীয়তাবাদ না থাকলে একটি রাষ্ট্র চলবে ক্যামনে? ইসকন ও বিজেপি উভয়ই ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ইসকন প্রচার করে ভারতীয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অন্যদিকে বিজেপি প্রচার করে ভারতীয় উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং এক ধরণের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা। অবশ্য যারা বিজেপি কে “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ” মনে করেন তাদের জন্য আমার এই আর্টিকেল নয়। কারণ এই দুই সংগঠন-ই হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। নিশ্চয়, ইসকন একটি সংগঠন হিসেবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নয়, খাতা-কলমে। কিন্তু ইসকনের ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের সাথে মিল ও সমর্থন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ওদের হিন্দুত্ববাদী বানায়।

হিন্দু ধর্মে গেরুয়া পোশাক পরিধান আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয়তার প্রতীক। একইসাথে হিন্দুধর্মে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রঙ, যা ত্যাগ ও পবিত্রতার প্রতীক। শুনতে তো ভালোই লাগছে। কিন্তু এই একই রঙ রাজনীতিকরণ করতে দেখা যায় ভারতীয় উগ্রবাদী দল বিজেপি কে। সর্বশেষ, দীপিকা পাডুকোনের এই গেরুয়া পোশাকে ‘পাঠান’ সিনেমায় নাচ তাকে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে ফেলে দেয়। আমার মতে, এই ধরণের আচরণ হিন্দু ধর্মের উদারতা কে উহ্য করে এবং এক ধরণের কট্টোরপন্থী হতে দেখা যায়। তবুও, এই মিল থাকার যুক্তিকে খুব পোক্ত যুক্তি হিসেবে মানা যায় না। আর দেশদ্রোহ মামলা করা হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপর গেরুয়া রঙের পতাকা টাঙানোর জন্য।

সর্বশেষ, বাংলাদেশের এক আইনজীবীকে নৃশংস ভাবে হত্যা। নিন্দা রইলো। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিষয় সরাসরি প্রতিবেশি দেশ ভারতীয় মিডিয়ায় বারবার প্রদর্শন আমাদের জাতীয়তাবাদ বা বাংলাদেশী মূল্যবোধ স্পষ্টত ক্ষুণ্ণ করেছে। কারণ বাংলাদেশ যদি একটি পরিবার হয় তাহলে সে পরিবারে ঝগড়াও হবে আবার মীমাংসাও এখানেই হবে। মানে খাতা-কলমেও যদি আমরা ভাই-ভাই হই! এই পরিস্থিতি ভয়ানক ঘোলাটে এবং দ্রুত আমাদের মানসিক শান্তি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। একইসাথে আরো প্রাণ যাক যে ধর্মেরই হোক সেটা আমার কাম্য নয়।

আরো কিছু পর্যবেক্ষণ,

১. ইসকন (ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস) বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের সংগঠনে সকল ভক্তকে সমান মর্যাদা দেয়। তাহলে ভারতে বর্ণপ্রথা আজ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয় নাই কেন? এই বর্ণপ্রথার কারণে ভারতে মানুষ হত্যা পর্যন্ত চলছে। মন্দিরে প্রবেশ করার অনুমতি পাচ্ছেন না। এছাড়াও অস্পৃশ্যতা নিম্নবর্ণের মানুষের উপর এক সামাজিক বিভেদ ও নিপীড়নের উপায়।

২. ইসকন অন্যান্য হিন্দু দেবতাদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে না। বরং, তারা বিশ্বাস করে যে সকল দেবতা কৃষ্ণের বিভিন্ন রূপ বা প্রতিনিধি। ইসকনের ভক্তরা প্রধানত কৃষ্ণের উপাসনা করে, কিন্তু তারা অন্যান্য দেবতাদেরও সম্মান করে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। পুনরায় পড়ুন? মানে যৌক্তিক ভাবে দেবতা একজনে এসে দাঁড়ালো।

বিজ্ঞাপন

৩. হিন্দু ধর্মমতে সাধারনভাবে অন্য ধর্মের কেউ হিন্দু ধর্ম গ্রহন করতে পারবেন না। কিন্তু ইসকনে এই বাধা নাই, যে কেউ যেকোন সময় ইসকনে যোগ দিতে পারেন। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার; যা আর কোনো হিন্দু সংগঠনে আমার জানা মতে নাই।

কোনোভাবেই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো বা কাউকে আঘাত দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো ভুল সংশোধনে আমি সবসময় প্রস্তুত। বেশ কয়েক ঘন্টা পড়াশোনার পর এই তথ্যগুলো আমি পেয়েছি। ধন্যবাদ


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading