কোরিয়ান ত্বকচর্চার গোপন রহস্য: ঝকঝকে ত্বকের জন্য সেরা টিপস

ত্বককে সুন্দর ও ঝলমলে করে তুলতে কে না চায়। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর হলেন কোরিয়ান তরুণীরা। তারা তাদের ত্বক নিয়ে অত্যন্ত যত্নশীল ও পরিচর্চাকারী। তারা মনে করেন সৌন্দর্য ঈশ্বর প্রদত্ত হলেও তা নিজেকেই ধরে রাখতে হবে। এর জন্য অবশ্যই একটু পরিশ্রমেরও প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের সব দেশের মানুষই যখন অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেখানে কোরিয়ান লাইফস্টাইল সত্যি অবাক করার মতো। কোরিয়ান তরুণীদের ঝকঝকে ত্বকের অনুরাগী তো গোটা দুনিয়ায়। তাদের গ্লাসের মতো ঝকঝকে স্কিন পেতে চায় সকলেই। কেউ কেউ তাদের রূপচর্চা, ফ্যাশন ও খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলোও অনুসরণ করে থাকেন। বিশ্বজুড়ে তাদের উজ্জ্বল ত্বকের জন্য সুখ্যাতি রয়েছে। তবে তাদের রূপের রহস্য এখনো অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গেছে।

তারা তাদের এই সুন্দর স্কিনের জন্য তেমন কোনো দামী ট্রিটমেন্ট বা দামী ক্রিম ব্যবহার করতেন না। বরং তারা বেশিরভাগই ঘরোয়া উপাদানের মাধ্যমে নিজেদের ত্বকের যত্ন নিতেন।

গ্রীন টি

কোরিয়ানদের সৌন্দর্যের একটি রহস্য হলো গ্রীন টি। তারা এই গ্রীন টি পান করেন এবং সাথে সাথে তাদের ত্বকেও মাখেন। গ্রীন টিতে থাকা পলিফেনল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বককে তরতাজা করে এবং ত্বকের মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে।

ভিটামিন সি

স্কিনকে সুন্দর রাখতে ভিটামিন সি এর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। আমলকি, লেবু, বেরিজ এই জাতীয় ফলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। কোরিয়ানরা তাদের স্কিনের বলিরেখা ঠেকাতে প্রচুর ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতেন। এছাড়াও তারা ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্টও নিতেন।

কোলাজেন

আমাদের ত্বকের ভেতরে যে কোষগুলো রয়েছে, সে কোষগুলোর মেরামতের জন্য কোরিয়ানরা কোলাজেনের ব্যবহার করতেন। এটি কোষের মেরামতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি এক ধরনের প্রোটিন। এই প্রোটিন স্কিনের বলিরেখা ঠেকায় এবং চুলকে করে ঝলমলে। তাই যেসব খাবারে এই প্রোটিন রয়েছে কোরিয়ানরা সেসব খাবার তুলনামূলক বেশি খান।

রেড জিনসেং

ট্রাডিশনাল কোরিয়ান বিউটির পেছনে রয়েছে রেড জিনসেং এর অবদান। কোরিয়ানরা তাদের সৌন্দর্য বাড়াতে এই রেড জিনসেং ক্যাপসুল, টনিক খান।

হলুদ

আমরা বাঙালিরা যেমন রান্নায় হলুদ ব্যবহার করি, তেমনি কোরিয়ানদের রান্নার সঙ্গীও হলেন হলুদ। হলুদ দিয়ে ফেসপ্যাক ব্যবহারের পাশাপাশি খাবারের মাধ্যমে তাদের শরীরে হলুদের গুণ যায়। এই মসলার অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং হাড়ের জয়েন্টও মজবুত করে।

মধু

কোরিয়ানদের মতো গ্লাস স্কিন পেতে চাইলে ত্বকে মধু ব্যবহার করা উচিত। তবে খাঁটি মধু হতে হবে, যাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এক টেবিল চামচ মধুর সাথে এক চা চামচ দারুচিনি গুঁড়া মিশিয়ে ঘন পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগাতে হবে। তারপর ১৫-২০ মিনিট পর তা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। মধু ত্বককে মসৃণ রাখতে সাহায্য করে।

অ্যালোভেরা জেল

মধু, লেবুর রস, হলুদ ও অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে এক ধরনের পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগাতেন। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন এই প্যাক ব্যবহার করা হয়। রোজ রাতে অ্যালোভেরা জেল মুখে ম্যাসাজ করলে মুখ উজ্জ্বল থাকবে। তাই কোরিয়ানরা নিয়মিত এই জেল ব্যবহার করেন। এটি ত্বকের দাগ দূর করার পাশাপাশি ত্বককে ভেতর থেকে আর্দ্র রাখতেও কাজ করে।

কে-বিউটি

কোরিয়ানদের সুন্দর ত্বকের মূল কারণ হলো কে-বিউটি। কে-বিউটির পণ্যগুলো ত্বকের জন্য খুবই কার্যকরী। কোরিয়ানদের উজ্জ্বল ত্বকের জন্য সারা পৃথিবীতে তাদের যে সুখ্যাতি রয়েছে তার মূল কারণই হলো কে-বিউটি। কে-বিউটিতে ১০টি ধাপ অনুসরণ করা হয়। এগুলো হলো – ক্লিনজার, টোনার, স্ক্রাব বা এক্সফোলিয়েটর, এসেন্স, সিরাম বা অ্যাম্পুলিস, শিট মাস্ক, ময়েশ্চারাইজার, আইক্রিম এবং সানস্ক্রিন।

অয়েল ক্লিনজার

সাধারণত তৈলাক্ত ত্বকের জন্য এটি কার্যকরী হলেও এটি শুষ্ক ত্বকেও ব্যবহার করা হয়। এটিকে মেকাপ রিমুভার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অয়েল ক্লিনজার হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করা হয়।

ওয়াটার বেজড ক্লিনজার

মেকাপের উপাদানগুলো পুরোপুরি রিমুভ না হলে পরবর্তী ধাপে এটিকে ব্যবহার করা হয়। গ্রীন টি, চালের পানি ওয়াটার বেজড ক্লিনজারের সবচেয়ে ভালো উপাদান। এটি সাধারণত ভেজা ত্বকে ব্যবহার করা হয়।

এক্সফোলিয়েশন

মুখ পরিষ্কার করার পর ত্বকে আটকে থাকা মৃত কোষ অপসারণে এক্সফোলিয়েশন করা হয়। এটি ত্বকের শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। সপ্তাহে দুই বার এক্সফোলিয়েশন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

টোনার

ক্লিনজার দিয়ে যতবার মুখ পরিষ্কার করা হয় ঠিক ততবারই টোনার ব্যবহার করা হয়। টোনার মুখের ত্বককে কোমল করে। এটি বোটানিক্যাল উপাদান সমৃদ্ধ যা আর্দ্রতা বজায় রাখে, রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে এবং ত্বকের পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে।

এসেন্স

এসেন্স হলো টোনার ও সিরামের মিশ্রণ। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য এটি না করলেও চলে। এটি দিনে একবার করায় উত্তম। এটি ত্বককে হাইড্রেট করে এবং ত্বককে ভেতর থেকে উজ্জ্বল করে।

সিরাম বা অ্যাম্পুল

কে-বিউটির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সিরাম ও অ্যাম্পুল। সিরাম ডিহাইড্রেশন যা চেহারা থেকে বয়সের দাগ বা বলিরেখা দূর করে। সিরাম ও অ্যাম্পুল দুটি প্রায় একই ধরনের। তবে সিরাম অপেক্ষা অ্যাম্পুল ভারী হয়।

শিট মাস্ক

শিট মাস্ক সব ধরনের ত্বকের জন্য উপযুক্ত। এটি খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। শিট মাস্ক ত্বকের জন্য আরামদায়কও। শিট মাস্ক ত্বককে সুস্থ রাখে। একটি মাস্ক সপ্তাহে একবার থেকে দুই বার ব্যবহার করা উচিত।

আইক্রিম

ত্বকের বলিরেখা দূর করার জন্য আইক্রিম ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ সময় আমাদের চোখের চারপাশের ত্বক সূক্ষ্ম ও পাতলা হয়। সেক্ষেত্রে ও আইক্রিম লাগানো হয়।

ময়েশ্চারাইজার

ত্বকের যত্নে ময়েশ্চারাইজারের চেয়ে আর ভালো কিছু হতে পারে না। এটি ত্বককে পুনরুজ্জীবিত ও সুন্দর করে তোলে।

সানস্ক্রিন

সানস্ক্রিন ইউভিএ ও ইউভিবি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। প্রতিদিন সানস্ক্রিন ব্যবহার করা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। এটি ত্বককে ইউভিবি রশ্মি থেকে প্রায় ৯৭ শতাংশ রক্ষা করে। কে-বিউটিতে ৩০+ সান প্রটেকশন ফ্যাক্টর ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাকে সংক্ষেপে এসপিএফ বলা হয়।

চাল ধোয়া পানি

কোরিয়ানরা চাল ধোয়া পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নেন। এটি ত্বকের পিগমেন্টেশনের সমস্যা দূর করে এবং ত্বককে টানটান ও সুন্দর করে তোলে। তারা ভাতের মাড় দিয়ে চুল ধুয়ে নেন যা চুল পড়া রোধ করে এবং চুলকে চকচকে করে তোলে।

গরম পানির ভাপ

ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য তারা সপ্তাহে দুই দিন গরম পানির ভাপ নেন। এই পদ্ধতিটি কোরিয়ার মেয়েরা খুব যত্ন সহকারে করে থাকেন। গরম পানির ভাপ ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং ত্বককে মসৃণ ও উজ্জ্বল করে তোলে।

ভিটামিন ইনফিউশন থেরাপি

কোরিয়ানরা তাদের ত্বকে বলিরেখা না থাকার জন্য মাঝেমাঝে ভিটামিন ইনফিউশন থেরাপি করিয়ে নেন। এই থেরাপি ত্বকের গভীরে ভিটামিন সরবরাহ করে, যা ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করে এবং উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।

ডাবল মাস্কিং

তারা তাদের টোটকা অনুযায়ী পরপর দুটি মাস্ক ব্যবহার করেন। যার একটি ত্বককে ভালোভাবে পরিষ্কার করে এবং অপরটি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে।

ম্যাসাজ রোলার

কোরিয়ান মেয়েদের ত্বকে ম্যাসাজ করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের রোলার পাওয়া যায়। যা এখন আমাদের দেশেও পাওয়া যায়। কোরিয়ানরা রোজ রাতে এই রোলার দিয়ে নিয়ম করে ত্বকে ম্যাসাজ করেন। এটি ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং ত্বককে টানটান ও উজ্জ্বল করে তোলে।

পর্যাপ্ত পানি পান

তারা তাদের ত্বককে সুন্দর রাখার জন্য প্রচুর পানি পান করেন, যাতে করে তাদের শরীরে পানির পরিমাণ কম হয়ে শরীর ডিহাইড্রেট না হয়। প্রচুর পানি পান করার ফলে তাদের ত্বক সব সময় ময়েশ্চার থাকে।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

তারা তাদের খাওয়া-দাওয়ার দিকে বিশেষ নজর রাখেন। প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে প্রচুর শাক-সবজি, যাতে রয়েছে ভিটামিন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। কোরিয়ানরা বেশি বেশি বাধাকপি খেতেন, যা খাওয়ার ফলে তাদের ত্বক খুব উজ্জ্বল থাকে।

উপসংহার

কোরিয়ানদের ত্বকের যত্নের পদ্ধতিগুলি অত্যন্ত কার্যকরী এবং সহজে অনুসরণযোগ্য। তাদের প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার এবং নিয়মিত যত্নের মাধ্যমে ত্বককে সুন্দর ও উজ্জ্বল রাখা সম্ভব। আপনি যদি কোরিয়ানদের মতো ঝকঝকে ত্বক পেতে চান, তবে এই টিপসগুলি অনুসরণ করতে পারেন।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading