আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের হিজরত: একটি ঐতিহাসিক ঘটনা

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর নবুয়াতের পঞ্চম বছরে মুশরিকদের অত্যাচারের কারণে, মক্কা থেকে প্রথমে ১৮ জন নারী-পুরুষ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। এরপর ঐ বছরই আরো ৮২ জন নারী-পুরুষ হিজরত করেন। এদের মধ্যে হযরত ওসমান গনী, রাসূল (সাঃ) এর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালেবসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন।

মুশরিকদের অত্যাচার ও হিজরত

মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন মুসলমানরা। সেখানে তারা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে সঠিকভাবে ধর্ম পালন করে, সময় পার করছিলেন। এরপর রাসূল (সাঃ) হিজরত করলেন এবং বদরের যুদ্ধ হলো। এই যুদ্ধে মুশরিকরা মারাত্মকভাবে পরাজিত হল।

বদরের যুদ্ধের পর মক্কার অবস্থা

বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের নেতৃস্থানীয় ৭০ জন লোক মারা গেল এবং ৭০ জন লোক বন্দী হলো। ফলে মক্কার ঘরে ঘরে শোকের ছায়া নেমে এলো। কিন্তু তারা শোক পালন করার জন্য লোকজন ডেকে কান্নাকাটি করতে পারছিল না।

প্রতিশোধের পরিকল্পনা

তখন তারা চিন্তা করল প্রতিশোধ কীভাবে নেবে। সিদ্ধান্ত হলো, আবিসিনিয়ায় যে ৮২ জন মুসলমান আছে, তাদেরকে সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারলে, ৭০ জন লোকের বিনিময়ে তাদেরকে হত্যা করা যাবে। এই পরিকল্পনা করে তারা জনসম্পদ জোগাড় করল এবং আবিসিনিয়ার বাদশাকে উপহার দিতে প্রস্তুতি নিল।

আবিসিনিয়ার বাদশার কাছে আবেদন

সমাজের সবচাইতে জ্ঞানী দুজন ব্যক্তিকে এই দায়িত্ব দিল মুসলমানদের ফিরে আনার জন্য। একজন হলেন আমর ইবনুল আস এবং আরেকজন আব্দুল্লাহ ইবনে রাবিয়া। তারা আবিসিনিয়ায় গিয়ে বাদশা আসামা নাজ্জাশীকে সিজদা করল এবং উপহার দিল। এরপর তারা বাদশাকে বলল, আমাদের দেশের কিছু লোক ভন্ড নবী দাবি করে এবং তারা আপনার দেশে পালিয়ে এসেছে। আমরা মনে করি এই লোকগুলো আপনার দেশে ফাসাদ ছড়াবে।

বাদশার ন্যায়পরায়ণতা

বাদশা নাজ্জাশী বললেন, আমার দেশের যে লোক গুলো আশ্রয় নিয়ে আছে, তাদের সাথে কথা না বলে তোমাদের হাতে তুলে দেই কি করে? তখন মুসলমানদেরকে বাদশার দরবারে ডাকার ব্যবস্থা করা হলো। আমর ইবনুল আস বললেন, মুসলমানেরা খুবই অহংকারী, তারা আপনাকে সিজদা করবে না।

মুসলমানদের বক্তব্য

জাফর ইবনে আবু তালিবের নেতৃত্বে মুসলমানেরা নাজ্জাশীর দরবারে হাজির হয়ে অনুমতি চাইলেন। তিনি বললেন, “ياستا ازيلوكا حزب الله” (আল্লাহর দল আপনার কাছে অনুমতি চায়)। বাদশা নাজ্জাশী বললেন, “أدخل في أمنيلله” (তোমরা আল্লাহর নিরাপদে দরবারে ঢুকে যাও)।

মুসলমানদের সিজদা না করার কারণ

মুশরিকরা বলল, বিদেশ থেকে যারা আসে তারা আপনাকে সিজদা করে, কিন্তু এরা আপনাকে সেজদা করল না। তখন নাজ্জাশী বললেন, তোমরা আমাকে সিজদা করলেনা কেন? জাফর ইবনে আবু তালিব বললেন, আমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করি না।

মুসলমানদের অপরাধ না থাকা

নাজ্জাশী আমর ইবনুল আস কে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কি তোমাদের কোনো লোককে খুন করে আমার দেশে পালিয়ে এসেছে? সে বলল না। এরপর জাফর ইবনে আবু তালিব বললেন, আমরা কি তাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছি? তারা বলল না। তাহলে কি অপরাধে তাদেরকে নিতে এসেছ?

নবীর আগমনের কথা

জাফর ইবনে আবু তালিব বললেন, আমাদের মাঝে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন নবী আসছে, আমরা সেই নবীর অনুসরণ করছি। নাজ্জাশী বললেন, তোমাদের মধ্যে নবী এসেছে? নবীর কথাতো খুব মারাত্মক কথা।

খ্রিস্টান আলেমদের সাক্ষ্য

নাজ্জাশী খ্রিস্টান আলেমদের ডাকলেন এবং তাদেরকে তাওরাতের কসম দিয়ে সত্য কথা বলতে বললেন। খ্রিস্টান আলেমরা বললেন, হ্যাঁ, ঈসা (আঃ) থেকে কিয়ামত এর মাঝখানে ইসমাইল (আঃ) এর বংশ থেকে একজন নবী আসবে।

কুরআনের তেলওয়াত

জাফর ইবনে আবু তালিব সূরা আন কাবুত, সূরা রোম তেলওয়াত করে শোনালেন। তখন সবাই কাঁদতে লাগলেন। আমর ইবনুল আস বলল, মুসলমানরা ঈসা (আঃ) কে গালি দেয়। নাজ্জাশী জাফর ইবনে আবু তালিব কে বললেন, ঈসা (আঃ) সম্পর্কে আপনারা কি বলেন? তখন তিনি সূরা মরিয়ম পাঠ করে শুনালেন।

নাজ্জাশীর সিদ্ধান্ত

নাজ্জাশী বললেন, এরা যা বলেছে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে, এটাই সত্য। তোমরা আমার দেশে কর মুক্ত বসবাস করবে। তোমাদের কেউ ক্ষতি করলে আমাকে বলবে, আমি প্রতিশোধ নিব। এরপর মুশরিকদের উপহার ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ঘুস খেয়ে আমি মুসলমানদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিব না।

মুসলমানদের নিরাপত্তা

মুশরিকরা বিফল হয়ে মক্কায় ফিরে গেল। খায়বারের যুদ্ধ পর্যন্ত মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় ছিল। তারপর তারা মদিনায় হিজরত করেন।

উপসংহার

আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের হিজরত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি, কিভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে ধৈর্য ধারণ করতে হয় এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হয়।

ছবি: Image by frimufilms on Freepik


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading