নিহিলিজম (Nihilism): জীবনের অর্থ খোঁজার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

‘Nihilism (নৈরাজ্যবাদ/ধ্বংসবাদ)’ এর সক্রিয় সমর্থক কখনোই জীবনের অর্থ হারিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন না। আবার ‘Nihilism (নৈরাজ্যবাদ)’ মানেই কিন্তু ‘Atheism (নাস্তিক্যবাদ)’ নয়, মানে জরুরী নয়। পুনরায় ‘Nihilism (নৈরাজ্যবাদ)’ মানে শুধু ফ্রিডরিখ নীটশে নন। ১৮৬২ সালে একজন বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ইভান তুর্গেনেভ একটি বই লেখেন ‘Fathers & Sons’। এই বইয়ে তিনি প্রথমবারের মত ‘Nihilism (নৈরাজ্যবাদ)’ শব্দ ব্যবহার করেন।

ধর্মের প্রতিশ্রুতি ও নিহিলিজম

যিনি নৈরাজ্যবাদ বা ‘কিছুই নাই’ মানেন তিনি কিন্তু তার সাথে সম্পর্কিত ধর্মের সমস্ত যুক্তি খারিজ করছেন। মানে হলো, ধর্ম আমাকে যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেসব প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে না এই শর্তে আমি ‘Nihilism (নৈরাজ্যবাদ)’ এ বিশ্বাসী হলাম। এখন প্রশ্ন হলো, ধর্ম আমাকে কি কি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে?

ধর্মের প্রতিশ্রুতি:

১. মৃত্যুর পরের জীবন: আমি মৃত্যুর পর জান্নাত/জাহান্নামে যাবো আমার কৃতকর্ম অনুযায়ী। কিন্তু একজন নৈরাজ্যবাদী লোক বলবেন, যদি মৃত্যুর পর এই ধরণের কিছুই না থাকে তবে কি হবে? কারণ আমি তো জানিনা বা দেখে আসি নাই মৃত্যুর পরের জীবন কেমন হবে বা আদৌ কি আছে? না নাই? যদি কিছুই না থাকে তো! মানে পুরোপুরি অন্ধকার বা নিঃশেষ হয়ে যাই তো!

২. পুনর্জন্ম: ধর্ম আমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, আমার পুনর্জন্মও হতে পারে এবং এখানেও আমার কৃতকর্মের উপর নির্ভর করবে আমার পরবর্তী জীবন কেমন হতে পারে? কিন্তু একজন নৈরাজ্যবাদী লোক পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নন। তিনি এই প্রতিশ্রুতি মানেন না।

মোটাদাগে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের যে বিষয়গুলো সেটা কিন্তু কৃতকর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মানে আমার কৃতকর্ম ঠিক করবে আমার ‘অভিশাপ’ অথবা, ‘আশীর্বাদ’। প্রকৃত ‘Nihilist (নৈরাজ্যবাদী)’ সবসময় জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়াবে। প্রতি সকালবেলা উঠে তিনি কাফকা’র আস্ত পোকায় পরিণত হতে চাইবেন না। একই সাথে তিনি এটাও চাইবেন না, ধর্মের সমস্ত মোরাল যেহেতু এখন আর থাকলো না/থাকছে না তাই আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবো।

আমি সমস্ত প্রতিশ্রুতি শুধু বাদ দিচ্ছি না, আমি কিন্তু আমার কৃতকর্মের যে মোরাল গ্রাউন্ড সেটাকেও খারিজ করে দিলাম। এখন একটু পৃথিবীটা কল্পনা করুন?

পৃথিবীর কল্পনা:

১. খুব ভয় লাগছে? ২. হতাশ লাগছে? ৩. কিছুই আসে বা যায় না!

স্টোয়িকিজম বনাম নিহিলিজম

এখানেই ‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ লাল কার্ড খেলে দেবে। বৈরাগ্যবাদ বলবে, মৃত্যুর পর আপনার কি হবে সেটা কিন্তু আপনার নিয়ন্ত্রণে নাই। আপনি ধার্মিক হতে পারেন, নাস্তিক হতে পারেন কিন্তু মৃত্যু জুড়ে আপনার কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। সুতরাং যাকে বা যে বিষয়ে আপনার নিয়ন্ত্রণ নাই তাকে বা সে বিষয়ে চিন্তা করাই বন্ধ করতে হবে। এখানে প্রথম শর্ত হলো, আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যা কিছুই আছে তা নিয়ে আগে চিন্তা করা বন্ধ করতে হবে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ধর্ম আমাদের প্রতিশ্রুতি দিক বা না-দিক, ধর্ম ব্যর্থ হলে হতেও পারে কিন্তু আমাদের কাছে আমাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে। পৃথিবী বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এমনি এমনি দাঁড়িয়ে আছে এমন নয়। পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে সুশৃঙ্খল একটি সূত্রের সাথে যুক্ত হয়ে। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই পৃথিবীতে আমরা আমাদের অস্তিত্ব পেয়েছি। এই প্রকৃতির যে সুন্দর বিন্যাস তা ‘অযথা’ বা ‘অকারণে’ নয়।

এখানে আমি একটা ‘Truth Bombing’ করবো, আপনি ইতিহাস এবং আপনার জীবন মিলে ক’টা মানুষকে কাফকা’র পোকা হতে দেখেছেন? আক্ষরিকভাবে? যদি না দেখে থাকেন তাহলে এসব ভন্ডামী বাদ দিতে হবে।

নিহিলিজম ও ধর্মের মিল

নিহিলিজমের সাথে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের বেশ কিছু কমন ইন্টারেস্ট আছে। ইসলামে ‘তাওয়াক্কুল (আল্লাহ্‌’র প্রতি ভরসা)’ কে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্টোয়িক দর্শন বলছে, যা কিছুই হচ্ছে সব প্রকৃতির নিয়মেই হচ্ছে। প্রকৃতির এই শৃঙ্খলাকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। ইসলাম এখানে বলবে, যা কিছুই হচ্ছে সব উপর আল্লাহ্‌’র ইচ্ছাতেই হচ্ছে।

পবিত্র আল-কোরআন থেকে:

“তাঁরই নিকট অদৃশ্যের চাবি রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত, তার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না, মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিম্বা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে (পবিত্র আল-কোরআনে) নেই।”

  • সূরা আল-আনাম ৬:৫৯

ভগবদ্গীতার শ্লোক:

“कर्मण्येवाधिकारस्ते मा फलेषु कदाचन। मा कर्मफलहेतुर्भूर्मा ते सङ्गोऽस्त्वकर्मणि॥”

বাংলা অনুবাদ:

“তোমার কর্তব্য পালন করার অধিকার আছে, কিন্তু তোমার কর্মের ফলের অধিকার নেই। কখনও নিজেকে তোমার কর্মের ফলাফলের কারণ মনে করো না, এবং কর্মে অনাসক্ত থেকো না।”

  • ভগবদ্গীতা (২:৪৭)

ইসলাম ও হিন্দু দুই ধর্মেই আমাদের কৃতকর্মের প্রতি বহু আদেশ/নিষেধ রয়েছে। এই সমস্ত রেফারেন্স সরাসরি স্টোয়িক দর্শনের সমর্থক না-হলেও প্রায় মোটাদাগে এই দর্শনের সাথে দুটো বড় বড় ধর্মের ব্যাপক মিল পাওয়া যায়। ইসলাম ধর্মে ওলি-আউলিয়াদের জীবনী নিরপেক্ষভাবে পড়লে দেখবেন প্রায় সরাসরি সূফি সাধকরা ‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ দর্শনে সমর্থন করছেন। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের ‘Karma’ নিয়ে আলোচনা যদি করা যায় তাহলে আমাদের কৃতকর্ম ও ‘Karma’ এর প্রভাব এখানেও ব্যাপক।

ধর্ম ও স্টোয়িকিজমের পার্থক্য

যদিও ধর্ম এবং ‘Stoicism’ এর মধ্যে পাতলা একটি লাইনের পার্থক্য আছে। স্টোয়িক দর্শনে, কর্ম ও উদ্দেশ্য ভিত্তিক জীবন এবং প্রকৃতির সর্বোচ্চ রায়। আর ধর্মের ক্ষেত্রে যেসব দর্শন পাওয়া যায় সেসবও কৃতকর্মের দিক থেকে প্রায় একই কিন্তু এখানে পার্থক্য হলো প্রকৃতি নয় এসব নির্ণয় করছে স্রষ্টা। কিন্তু মীমাংসার অজুহাত যদি চান, তাহলে নিশ্চিত অর্থে একজন স্টোয়িক ব্যক্তি ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম যার-যার মত করে পালন করতে পারবেন।

আমি হতে পারি একজন মুসলিম বা একজন হিন্দু ব্যক্তি কিন্তু আমি আমার ধর্মের সাথে এই দর্শনের গুরুতর বা সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো না থাকায় এই দর্শনও পাশাপাশি পালন করতে পারবো। শুধু ফ্রেমওয়ার্ক হবে, যা কিছুই হচ্ছে স্রষ্টার দ্বারা/হুকুমে/আদেশে হচ্ছে। একই সাথে আমি নিহিলিস্টিক হয়েও কিন্তু এই দর্শন পালন করতে পারবো যেখানে অন্তত একটি মোরাল গ্রাউন্ড থাকে। কারণ একজন নিহিলিস্ট যিনি তিনিও বলবেন, “নিহিলিস্ট হয়ে একজীবন নিহিলিস্ট হয়ে থাকাটা ব্যর্থতা, এর মধ্যে কোন মানে বা অর্থ খুঁজে পাওয়াই সফলতা।”

নিহিলিস্ট’রা ভ্যাকুয়াম তৈরি করবেন, ওটাই তাদের কাজ। কিন্তু ভ্যাকুয়াম তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে, জীবনের অর্থ খুঁজে বের করা। কারণ যখন আপনি বলছেন, “কিছুই নাই!” তখন-ই তো প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে কিছু তো একটা আছে!


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading