এন্টি পোয়েট্রি: একটি নতুন ধারা
‘পোয়েমস এন্ড এন্টি পোয়েমস’ এই একটি কবিতা লিখে কবিতার জগতে বোমা! ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কে এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কাকে বলে এন্টি পোয়েট্রি? তাঁর উত্তর, “বলব না, সেটা আমার প্রফেশনাল সিক্রেট।” আবার জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন হেসে, বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে বাঁচতে মুখোশ পরতে হয়, এন্টি পোয়েট্রি সেই মুখোশ।
নিকানোর পাররা: এক অনন্য কবি
তিনি নিকানোর পাররা। পৃথিবীর একমাত্র কবি যাঁর হয়ে তিন বার সুইডিশ একাডেমিকে নোবেল লরিয়েট অনুরোধ করেছিলেন পাররাকে নোবেল দিতে। দিতে পারেন নি নোবেল কমিটি। নোবেল দেওয়ার ও না দেওয়ার দুইয়ের পিছনে রাজনীতি থাকে। থাকে অনেক উল্লাস, অপযশ।
একই ভাষার গাব্রিয়েলা মিস্ত্রান, পাবলো নেরুদা, ওক্তাভিও পাস, ফের নিকানোর পাররা! এতো কম সময়ে একই ভাষার এতজন কবি! অন্যদেশের রাগ হবে যে! তবে নিকানোর সেটা সৌভাগ্য। এক গ্লোরিয়াস তালিকায় তিনি চলে গেলেন যাঁরা পান নি নোবেল। যে তালিকা শুরু হবে তলস্তয় দিয়ে! পঁয়ত্রিশ বছর আগে পাররা এসেছিলেন ভারতের ভারত ভবনে।
ভারত ভবনে নিকানোর পাররা
ভারত ভবন তখন কবিতার স্বর্গভূমি। তাঁকে ভারতের এক নবীন কবি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কি লিখছেন?”
বললেন, “এই খাতায় আমি লিখে রাখছি ভারতে যা দেখছি। চিলে তে ফিরে গিয়ে আমি খাতাটা দেখবো। যদি একটা লাইনও তখন বেঁচে থাকে, আমি আমার কবিতায় তুলে আনবো।”
কবিতার নতুন সংজ্ঞা
তাঁর মতে, কবিতা এমন লেখা, যাতে কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বুঝতে পারে। কবিতাকে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হবে। কবিতা শুধু এলিটের জন্য নয়। তাকে দলিতের উঠোনে বসতে হবে। ক্ষমতাবানকে নিয়ে হাসাহাসি করতে হবে। ন্যাকামি করার দিন শেষ। যাঁরা সাধক সাজতে চাইছেন, তাঁরা ভন্ড, তাঁদের ভন্ড বলতে হবে।
এন্টি কবিতা: ভন্ডামির বিরুদ্ধে
এন্টি কবিতা সেই কবিতা, যে ভন্ডামি নিয়ে কথা বলে। এন্টি কবিতা একটা কবিতা পড়বে, উঠে দাঁড়িয়ে এক ছুরি চালিয়ে দেবে ঠাণ্ডা মাথায়, রক্ত এক বিন্দু বের হবে না। “আমি তোমাকে ভালবাসি” – এই বলে আমরা আমাদের স্নায়ুকে বিবশ করে ফেলেছি। “আরে ছো” বলে গা ঝেড়ে একজন উঠে দাঁড়ালেন। “আয় পা চালিয়ে” বলে চলতে লাগলেন তাসখন্ড থেকে ইস্তানবুলের দিকে, সেখান থেকে জেলখানার চিঠি নিয়ে এলেন কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে।
কবিতার ভাষা
কবিতার ভাষা হবে মুখের ভাষা। এন্টি পোয়েট্রি কোন আইভরি টাওয়ার নয়, কবিতা এক সরল মানুষের পিঠ, সেখানে অনেক মারের দাগ, চাবুকের দাগ, অশ্রু পতনের দাগ।
ভোপালের ভারত ভবনে পাররা
যখন ভোপালের ভারত ভবনে পাররা উঠে দাঁড়ালেন কবিতা পড়তে, মানুষের ঠোঁটে প্রশ্ন এন্টি পোয়েম কি? নিকানোর মাথাভর্তি চুল ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন, “এ প্রশ্নের উত্তর না পেলে আপনারা আমায় কবিতা পড়তে দেবেন না?” সমস্ত হল নিস্তব্ধ।
পাররা তাঁর একটি কবিতা দিয়ে উত্তর দিলেন:
অর্ধ শতাব্দ ধরে
কবিতা ছিল একটা স্বর্গ
অভিজাত বোকাদের।
আমি না আসা পর্যন্ত তাই ছিলো
আমি এলাম
আমি আমার নাগর দোলা তৈরী করলাম
আপনারা চড়ে দেখতে পারেন
কিন্তু মনে রাখবেন যদি নাক মুখ ফেটে যায়
তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না
নিকানোর পাররার দর্শন
নিকানোর পাররা আমাদের নিয়ে এলেন এক নির্জন পুকুর পাড়ে যেখানে এক বোন স্নান করছিলো। মিথ্যা তার ছোট বোন দিদির রাখা জামা নিয়ে পালিয়ে গেছে। নিকারা চান না ‘নগ্ন সত্য’ পুকুর পাড়ে কান্নাকাটি করুক।
পাররার কবিতা হলো মিথ্যা নামের মেয়েটিকে খুঁজতে থাকা যে সত্যর জামা পরে রয়েছে। পরবর্তী কালে অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে পাররা বলেছিলেন, “হ্যাঁ হোমার ও এন্টি কবিতা লিখতেন।”
পাররার শিক্ষা ও জীবন
দুটো বিষয় নিয়ে তাঁর পড়াশোনা – গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা সান্তিয়াগো ও অক্সফোর্ড। দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন পাররা একশো তিন বছর। শতবর্ষ পালন হলো সারা ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে। তিনি দরজা বন্ধ করে বসে নিজের জন্মদিন না দেখে লিখছিলেন, “আই জাস্ট লিভড এ মোমেন্ট ইন দ্য ইউনিভার্স। ইউ কলড ইট সেঞ্চুরি।”
যুগান্তকারী কাব্যগ্রন্থ
মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে প্রকাশিত হলো, ১৯৫৫ সালে – সেই যুগান্তকারী কাব্যগ্রন্থ – ‘পোয়েমস এন্ড এন্টি পোয়েমস’। সান্তিয়াগো থেকে তাঁর ছড়িয়ে পড়া ল্যাটিন আমেরিকা, স্প্যানিশ জগতে। বারো বছর বাদে ইংরেজি অনুবাদ হলো। তোলপাড় দুনিয়া। আটলান্টিক পার হয়ে হিথরো হয়ে ইউরোপে। পরে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে এশিয়ায়। ভারত মহাসাগর পার হতে সময় লাগেনি।
আজ অন্তত কুড়িটি ভাষায় নিকানোর পাররার কবিতা পাওয়া যায়। সেটা সম্ভব হয়েছে ভারতের তরুণ কবিদের জন্য। সারা পৃথিবীর তরুণ কবিদের মুখে মুখে, দেশ থেকে দেশে, ঘুরে বেড়ায়।
কবিতার স্বাধীনতা
লেখো, যা চাও লেখো। যে ভাবে ইচ্ছে হয় লেখো… কবিতায় সব চলে। এই শর্তে অবশ্যই সাদা পৃষ্ঠাকে করে তুলতে হবে আরও উন্নত।
পাররার আরেকটি কবিতা
পাররা লিখেছেন আরও একটি কবিতা, তাতে মাত্র ছ’টি শব্দ। একটি এটম বোমা:
USA
Where
Liberty is statue
কৃতজ্ঞতা সহ তথ্যসূত্র
সুবোধ সরকার
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.