Stoicism (বৈরাগ্যবাদ) নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব: Amor Fati (Love of Fate)
ভাগ্যের প্রতি ভালোবাসা এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে স্টোয়িক দর্শনের প্রয়োগ
‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে লাতিন শব্দ ‘Amor Fati’ যার অর্থ ‘Love of Fate’ নিয়ে আজকের আলোচনা। পূর্বের আলোচনায় ‘অগ্রাধিকার (Priority)’ কে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছি ‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ দর্শনের আলোকে। কারণ আমি খুব বেশি ‘Conversationalist’ না হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ‘অগ্রাধিকার (Priority)’ অন্যের কাজকর্মের প্রতি বেশি, অন্যকে শোধরানোর গুরুত্ব বেশি, অন্যের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব-খাতা নিয়ে অনর্থক ব্যস্ততা।
অগ্রাধিকার ও বৈরাগ্যবাদ
দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক বেশি। যতটুকু আমরা অন্যকে নিয়ে ভাবি, ভাগ্যকে নিয়ে ভাবি ততটুকুও যদি নিজেকে নিয়ে আমরা (আমি সহ) ভাবতাম তাহলে আমাদের পরিস্থিতি আরো উন্নত হত এবং এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ নাই। ‘Amor Fati’ মানে ভাগ্যের প্রতি ভালোবাসা ফ্রেডরিখ নিৎশের মত অস্তিত্ববাদী দার্শনিক স্বীকার করতে বলেছেন। কি অদ্ভুত তাই না! ইসলাম ধর্ম পর্যন্ত তকদীর (নিয়তি/ভাগ্য) এর প্রতি বিশ্বাস করাকে বাধ্যতামূলক করেছে।
Amor Fati বা Love of Fate আসলে কী?
স্টোয়িক দর্শনের একেবারে গোড়ায় কথা হচ্ছে ভাগ্যের প্রতি ভালোবাসা। এই শব্দটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন (ধ্রুব অর্থে) ফ্রিডরিখ নিৎশে। কিছু বুলেট পয়েন্ট:
১. বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া
আমাদের জীবন নিয়ে বহুরকম ও বহুধরনের পরিকল্পনা থাকে, অনেক স্বপ্ন থাকে, অনেক ইচ্ছে থাকে কিন্তু তার সবটুকুই কি পূরণ হয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় না। একজন জীবনে হয়তো অনেক বড় সরকারি অফিসিয়াল হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হয়ে আছেন কোন এক এনজিও সংস্থার সাধারণ কর্মী; মালিকও নন। কিন্তু তাকে সেটাই করে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশে সেলসম্যান চাকুরীর জন্য যেমন স্নাতক সম্পন্ন করেও অনেকে কাজ করছেন অথবা, টরেন্টোর উবার ড্রাইভার। আচ্ছা, উনি কি স্রেফ একজন সেলসম্যান হতে চেয়েছিলেন জীবনে? ছোটবেলায় ‘Aim of Life’ রচনায় তিনিও হয়তো বড় বড় পেশার নাম লিখেছিলেন, মন থেকেই হয়তো লিখেছিলেন।
‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ এখানে বলছে, আপনার সাথে যা কিছুই ঘটছে তাতে আপনার ভাগ্যের সরাসরি হাত আছে এবং এখান থেকে আপনার নিস্তার নাই। আরো বলছে, যা হচ্ছে এসব আপনার ভালোর জন্যই হচ্ছে। মানে আপনার ভাগ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এর সাথে সংযুক্ত হয়ে চেষ্টা করছে আপনাকে আরো উন্নত জীবন উপহার দেওয়ার। সুতরাং যা কিছুই আপনি হারিয়ে ফেলেছেন, যা কিছুই ক্ষতি হয়েছে, যা কিছুই আপনি পাননি আসলে এসমস্ত কিছুই আপনার ভালোর জন্য ঘটছে।
সুতরাং জীবন ভ্রমণে আমাদের সাথে অনেক খারাপ সময়, কঠিন সময়, একাধিক চ্যালেঞ্জ এ সকল কিছুর মধ্যে আপনার ভালোটা আছে এবং এসব মেনে নিতে হবে। এর মধ্যে ভয়ানক বিষয় হচ্ছে, খুব কাছের মানুষের মৃত্যু এবং সেটাও এই দর্শন অনুযায়ী মেনে নেওয়া সবার জন্য মোটেই সহজ নয়। কারণ আপনার সামনে আপনার দাদা-দাদী, নানা-নানী, বাবা-মা বিদায় নেবে (যদি কোন এক্সিডেন্ট না ঘটে)। স্টোয়িক দর্শনে এসবও মেনে নিতে হবে। আপনার ছেলেটা বা মেয়েটা কোন এক্সিডেন্টে হয়তো পৃথিবীতে আর নাই, এখানে স্টোয়িক দর্শন বলছে, “তাকে ঘিরে পৃথিবীর পরিকল্পনা ঐ পর্যন্ত -ই ছিলো”। যেটা মেনে নেওয়া অনেক অনেক বেদনাদায়ক। এখানে ইসলাম বলছে, মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না পর্যন্ত না করতে। কারণ তিনি বা সে মহান স্রষ্টার কাছে চলে গেছেন।
২. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখুন
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ (আমার চোখ যতদূর যায়) ‘Problems oriented personality (POP)’ বহন করে। মানে হলো, সমস্যা কে ভীষণভাবে মিস করে এবং সমস্যার ব্যাপকতা নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা চলে। বর্তমানে রাজনীতি নিয়ে দেখবেন, আমাদের মনে হয় ভোটের আগে আমরা কেউ-ই নিজ কাজে বা দায়িত্বে আর ফিরছি না। ছাত্ররা কে? ওরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। সামষ্টিক সিদ্ধান্তে সবাইকে এগিয়ে যেতে বলছে। আমরা একটি নতুন একটি সমাজের পর্যন্ত দেখা পেলাম, এই সমাজ নিয়ে আমি অন্তত গর্ব করতে রাজী আছি। এখানে তো কোন সমাজ-ই ছিলো না। মানে জনাব ‘ক’ যদি বিপদে পড়েন তাইলে আমার কি? সমস্যা জনাব ‘ক’ এর এবং জনাব ‘ক’ কে সেটার সমাধান করতে হবে।
না, সমস্যা সবার। কারণ আজ ওরা প্লাবিত, দুর্যোগ ও মহামারীতে বড্ড অসহায়। আগামীকাল কি আমাদের সমস্যা হতে পারে না? একটা ‘Individualistic’ প্রেক্ষাপট বিবেচনায়ও আমাদের এখন তাদের সাহায্য করা জরুরী। কেন? কারণ ভবিষ্যতে আমাদের বিপদেও তারা সমানভাবে এগিয়ে আসবেন এই বিশ্বাস থেকে। স্টোয়িক দর্শন এখানে এক ধরণের ‘Solution Oriented Personality (SOP)’ কে খুঁজে বেড়াবেন। কারণ ব্যক্তি সমস্যা কে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা নয়, বরং সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা ও দুর্দান্ত ফাইট-ব্যাক দেওয়া জরুরী। এটাই তো সে-ই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
উপরোক্ত উদাহরণ বৃহত্তর স্বার্থের জন্য হলেও ব্যক্তি পর্যায়ের সমস্যাকেও কোনোভাবেই ছোট করে না দেখা এবং একই সাথে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাধানে কাজ শুরু করে। মায়া এঞ্জেলোর বিখ্যাত কবিতার লাইন, “And Still I Rise”। আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেতিবাচক কথা দিয়ে শুরু হয়, “তোমাকে দিয়ে হবে না (হিন্দিতে একটি সিনেমার শিরোনাম: তুমছে না হো পায়েগা)।” কেন? হবেনা কেন? পারবোনা কেন? সমাজ কিন্তু আজকাল এটাও বলছে, ছাত্ররা কি রাজনীতি বুঝে? এরা আবার দল গঠন করবে? ওদিকে ছাত্ররা বিপ্লব ঘটালো। বাংলাদেশ পুলিশের চায়না মডেলের টি-৫৪ পিস্তলের ৯ মিলিমিটার বুলেটের সামনে একজন (পক্ষান্তরে কয়েকজন ও একাধিক এলাকায়) বুক পেতে দেওয়া শুধুই কি চাকুরীর জন্য? এরচেয়ে বড় রাজনীতি আর হয় না। সেটা ঐ আশির্ধো টাকমাথাওয়ালা বুদ্ধিজীবীদের মাথায় নাও ঢুকতে পারে (উল্লেখ্য, সবাই নয়)। Just give them a chance!
৩. ট্যাগিং করা যাবে না
‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ দর্শন বলছে, গতানুগতিক যে ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ এর ধারণা তা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। কারণ এই দুটোই আমাদের নানাবিধ পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করাতে পারে। এখন আমরা যখন এই সমস্ত পরিস্থিতি কে মোকাবেলা করতে যাবো তখন আমাদের মধ্যে বিরাট অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হবে। আবার আমরা আজ যেটাকে ‘মন্দ/খারাপ’ বলছি আগামীকাল সেটা কিন্তু ‘ভালো’ হিসেবে দেখা দিতে পারে। স্টোয়িক দর্শনে, ভাগ্য আমাদের সামনে বহু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে এবং আমাদের সেটা শুধু মোকাবিলা করলে চলবে না বরং মোকাবিলা করার পাশাপাশি আমাদের শিখতে হবে, জানতে হবে।
‘হিটলার স্টাডিজ’ বা কাছাকাছি কিছু নাম নিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে হিটলারের শাসন ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে পড়ানো হয়। কেন পড়ানো হয়? তিনি তো একজন মার্ডারার, গণহত্যা করেছেন, তাই নয় কি? তাহলে একজন গণহত্যাকারী কে নিয়ে কেন পড়ানো হয়? কারণ গণহত্যার আগেও তিনি একটি স্ট্রাটেজিতে তার দেশ চালাতে চেয়েছিলেন। অনেক অনেক বুদ্ধিজীবী তাকে জার্মানের ডাক্তার মনে করতেন। কিন্তু এই স্ট্রাটেজি যে ভুল ছিলো এবং কোনো দেশের কোনো শাসক এমন স্ট্রাটেজিতে যেন দেশ পরিচালনা না করতে পারেন সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা। মানে এই এই চূড়ান্ত ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা।
বাংলাদেশে কোন ধরণের ট্যাগিং নিয়ে মানুষ বিরুক্ত? বাংলাদেশের মানুষ বাইনারি ট্যাগিং নিয়ে বিরুক্ত। ভালো যা কিছুই হচ্ছে তা যেন একদল করছে (লীগ বাহিনী) এবং খারাপ যা কিছুই তা যেন জামাত ও বিএনপি করছে। কিন্তু বাংলাদেশে কি মাত্র এই ৩ দল বিদ্যমান? এটা কিন্তু বুঝার বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ শুধু নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪৪টি! আর এর বাইরেও না জানি কত দল আছে!
এই বাইনারি ট্যাগিং এখনো চলমান। ধরুন, বিএনপি এর পুরো অর্থ হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ পার্টি’। কিন্তু বিএনপি নিজেও এই ‘জাতীয়তাবাদ’ ধারণ করে কি? প্রশ্ন রইলো? যদি ধারণ না করে তাহলে তাদেরও শিখতে হবে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কি ইসলাম সম্পর্কে সব জানেন? সব মুসলিম কে তাদের সমর্থন করেন? না, করেন না। সুতরাং তাদেরও শিখতে হবে। আর এক মেইনস্ট্রিম দল আছে ‘বাম’। মানে আমরা! দেশে পড়াশোনা করে দুই শ্রেণী, ১. বাম ২. শিবির বাকিরা কেন পড়ে আমি সেটা নিজেও জানি না। হয়তো তারা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি আরো উঁচু করবেন মাশাল্লাহ্। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাম’রা কি সবাই একদলে আবদ্ধ না একাধিক দলে বিভক্ত? সহজ প্রশ্ন ছিলো। এরাও একাধিক দলে বিভক্ত। নিজেকে ‘বাম’ বলতে যত কুল লাগে বিষয়টা এত কুল না। তাহলে তাদেরও শিক্ষা নেওয়া উচিত।
‘জাতীয়তাবাদ’ নাম করে ‘তালেবানবাদ’ গ্রহণযোগ্য নহে কিন্তু ‘জাতীয়তাবাদ’ মনেপ্রাণে ধারণ করে এই একটি দল এটাও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিক যেমন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এর চেতনা একদল তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করেছিলো, আরেকদল যদি ‘ইসলাম’ কে নিজের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে তারাও জয়-বাংলা হয়ে যাবে। এই বাইনারী ট্যাগিং থেকে মুক্ত হতে হবে।
যারা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন তাদের সবাই কি একদল করতেন? নিশ্চয় নয়। সুতরাং আজ সময় এসেছে ওদের থেকে শিক্ষা নেবার। ওরা মৃত্যুর সময় আমাদের বলে যেতে পারেনি ওরা কি চায়! কীভাবে চায়! কিন্তু আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি তারা গতানুগতিক ধারার ট্যাগিং থেকে আগে বের হয়ে আসবো এবং সকল দল ও মতের ভুল ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা পূর্বক শিখবো।
এই শেখার দর্শন ‘Stoicism’ দেখাক আর না দেখাক কিন্তু ওদের রক্ত বৃথা হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের সবাইকে বসতে হবে, শিখতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে… তবেই ওদের আত্মা শান্তি পাবে।
উপসংহার
‘Stoicism (বৈরাগ্যবাদ)’ দর্শন আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে শেখায়। ভাগ্যের প্রতি ভালোবাসা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ট্যাগিং থেকে মুক্তি—এই তিনটি মূল বিষয় আমাদের জীবনে প্রয়োগ করলে আমরা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারি। আমাদের উচিত এই দর্শন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে আরো সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলা।
ধন্যবাদ
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.