রাজনীতি ও নেতৃত্ব: অন্তর্ভুক্তিমূলকতার অভাব ও আমাদের সংকট
একক নেতৃত্বের প্রভাব ও অন্তর্ভুক্তিমূলকতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিশ্লেষণ
ছোটবেলা থেকেই ‘জাতির জনক’, ‘জাতির পিতা’, ‘জাতির মাতা’, ‘জননেত্রী’ থেকে শুরু করে ‘দেশনায়ক’, ‘রাষ্ট্রনায়ক’ শব্দগুলো আমাকে প্রচুর অস্বস্তিকর করে তুলতো; আজও তাই। এই শব্দগুলোকে আমার কাছে ‘One Man Army’ জনরার দক্ষিণী ভারতীয় সিনেমার মত মনে হয়। মানে উনি বা অমুক একাই সব উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে আমি আজও ‘Inclusivity’ খুঁজে পাইনি। হয়তো আমার সংকীর্ণ চিন্তার ফসল হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের একটি ভাইরাল মিমস্ খুঁজে পেলাম, লেখা আছে, “We all have daddy issues.”। এই উক্তি একই সাথে আমাদের হাসায় ও ভাবায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক উপদেশ দিয়েছিলেন, “কাউকে আর যাই-ই মানো ঈশ্বর মেনে নিও না (হুবহু নয়, তবে এরকমই কিছু বলেছিলেন)।”
জুলাই বিপ্লবের অনেকেই আহত হয়েছিলেন। খবর পাই তাদের মধ্যে কেউ-বা হাত কেউ-বা পা পর্যন্ত হারিয়েছেন। আবার কেউ কেউ তো পরপারে পাড়ি জমাচ্ছেন। এক আরব আমিরাতে জুলাই বিপ্লব কে কেন্দ্র করে ৫৭ জন কারাদণ্ড ভোগ করেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং বাকি একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। শুধুমাত্র এই আরব আমিরাতে কয়েক হাজার প্রবাসী সেদেশে বিক্ষোভ করেন/প্রতিবাদ জানায় ছাত্রদের সমর্থনে। মনে রাখা ভালো, আরব আমিরাতে অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ বা আন্দোলন করলে পড়তে হতে পারে মহা আইনী জটিলতায়। ভিসা বাতিল থেকে জেল জরিমানা এমনকি ক্যাপিটাল প্যানিশমেন্ট পর্যন্ত।
জুলাই বিপ্লবে আহতদের মধ্যে কতজন সুস্থ হয়েছেন জানিনা। কতজনের ব্যাপারে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হলো তাও ঠিক জানিনা। উল্টো জুলাই বিপ্লবের সরকারকে হুঁশে ফেরাতে আহতদের পুনরায় আন্দোলন করতে হয়। তারপর ফকির-মিসকিনদের মত করে মিলে যায় কিছু টাকা, কিছু সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। সেটাও আবার যমুনা টেলিভিশনে লম্বাচওড়া করে না দেখালে ষোলকলা পূর্ণ হয় না। আর বাংলাদেশি ডায়াসপরার শুধুমাত্র আরব আমিরাত সরকারের থেকে মাফ নিয়ে কিছু জনকে দেশে ফেরত আনতে দেখা যায়। তারমানে বাংলাদেশী ডায়াসপরার দম আছে বৈ কি! কিন্তু বাকি প্রবাসীদের কেউ কি কোন সমস্যার মধ্যে নাই? মানে যে রেমিট্যান্স দিয়ে দেশ চলে!
এবার প্রথমেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে একটু ভাবা যাক। তিনি আজ পর্যন্ত এতগুলো হত্যার দায় স্বীকার করে একটি ‘দুঃখিত!’ পর্যন্ত বলতে পারলেন না। দুই দিনের এই জীবনে আপা যেন সপ্তাহের সাত দিনই আমাদের মধ্যে বারবার ফিরে আসতেছেন। তাদের নেতাকর্মীদের নৈতিক ভিত্তি অদৌ আছে কিনা সে বিষয়ে বাংলাদেশীদের আর কোনো সন্দেহ নাই। কতটুকু নির্মম হলে, কতটুকু লজ্জাহীন হলে প্রতি ঘন্টায় একটি করে গজব (গুজব) ছড়ানো যায় সেটা আমার জানা নাই। এই লিমিটলেস নৈতিকতা বিবর্জিত দল পুনরায় দেশ দখলের কথা বলেই যাচ্ছেন। কিন্তু নিজেদের কুকর্মের কথা একটি বারও মুখ ফসকেও বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, প্রাণ ফ্রুটিকা খাওয়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নাই।
এরপর, মহাত্মা গান্ধীর আত্মা ভর করেছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপর। তিনি প্রথমেই যে দারুণ কাজটা করে আমাদের তব্দা লাগিয়ে দিয়েছেন সেটা হলো, জুলাই বিপ্লব কে একরকম ব্যক্তিগতকরণ। এরপর তিনি মহান আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পুনর্বাসনের কথা বলেছেন বারবার। সর্বশেষ তিনি যেটা বলেছেন তা শুনে আমাদের হৃদয় ও মন আহত থেকে নিহত পর্যন্ত হয়ে গেছে শুধু একবার অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের মত “আমেনার মা” বলা বাকি।
তিনি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কে রাখার কথা বলেছেন। পরবর্তীতে বক্তব্য সংশোধন করেছেন এবং প্রধান উপদেষ্টা কে এক ধরণের মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিজের ইমেজ সার্ফ এক্সেল দিয়ে পুনরায় ধুয়ে ‘মির্জা ফখরুল: দ্য গান্ধী ২.০’ তে রুপান্তরিত হয়েছেন। যদিও বিএনপি বিগত বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত বিরোধী দল। তাই মানুষ আর বেশি আক্রোশ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করছে না। শুনেছি, এস.আলম গ্রুপ কেও বিএনপি কিছু সাহায্য করেছেন। সবই উপর আল্লাহ্’র ইচ্ছা।
এসব দেখে মোটেই চুপ থাকতে পারেন নাই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বর্তমান আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি আওয়ামীলীগ কে রাজনৈতিক পরিবারের অংশ হিসেবে দাবী করেছেন। তিনি তার একটি বক্তব্যে বলেছেন, “আমি বারবার ফ্যাসিজম আর ফ্যাসিস্ট বলা পছন্দ করিনা কারণ এরাওতো আমাদের পরিবারের সদস্য, রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। ভুল মানুষই করে, দুর্নীতিও মানুষ করতে পারে। ভুল যে করবে সে ক্ষমা চাইবে, দুর্নীতি যারা করবে তারা শাস্তি পাবে।”
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের এই বর্তমান আমীর নিজ দলের নেতাদের ফাঁসি, গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আফসোস খুব বেশি একটা করতে দেখা যায় না। সমস্ত বিষয়কে পুনরায় স্ক্রুটিনাইজ করে নিজ দলের অবস্থান জনগণের কাছে স্পষ্ট করা তো অনেক দূরের কথা তার আগেই সমালোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
জুলাই বিপ্লবের সরাসরি সমর্থক এই বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাজনীতি জিনিস টা-ই তো নাই। আপনার যে দু’জন নেতাকর্মী সামনে ছিলো তাদেরকে ধরে ধরে আমাদের সামনে বারবার আনবেন, দেখাবেন, একটি ন্যারেটিভ তৈরি করবেন। নাকি আমরা ধরে নেবো, আপনারা কিছুই ছিঁড়তে পারেন নাই। বিএনপি খুব শুরুর দিকে কিছু জনের তালিকা দিলো নয়া দিগন্তে। কিন্তু সর্বশেষ সংশোধিত, পরিমার্জিত ও ফাইনাল তালিকা এই বড় দুই দলের পক্ষ থেকে আমি এখন পর্যন্ত পাই নাই।
আপনারা যে রাস্তায় ছিলেন সেটা আরো কিছুদিন গেলে মানুষ অস্বীকার করবে। আরো বড় বিষয় হচ্ছে, আপনারা যে আওয়ামীলীগ নন শুধুমাত্র এটুকু দিয়ে রাজনীতি হয় না। আপনাদের কাছে জনগণকে অফার করার মত এমন ছন্নছাড়া তালিকা আছে যা আমাদের হারিকেন দিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। সেটা আমাদের হাতে যেভাবেই হোক পৌঁছাবে, পৌঁছানো উচিত। নাকি রাজার এই রাজ্যে আমরা সবাই গোলাম!
জুলাই বিপ্লবে বেশিরভাগ যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। বুঝার সুবিধার্থে, কোনো রাজনৈতিক দলের স্টুডেন্ট উইংস এর সভাপতি বা সম্পাদকের কেউ কি মারা গেছেন? যদি মারা যাইতো তাহলে সেটাকেও ক্যাপিটালাইজ করতে কারোরই সময় লাগতো না। বিশ্বাস না হলে হাসিনা সরকারের সময় গ্রেফতার করার পর ডিএমপির রিপোর্ট দেখুন। ওরা কি চাইতো? কীভাবে চাইতো? ক্যামনে চাইতো? আমরা জনিনা তো!
ওরা কবরে শুয়ে আছে। কবর থেকে উঠে এসে আমাদের জানাচ্ছে না তো যে, ওরা কি চাইতো? একটা জিনিস শুধু সবাই বলে গেছে, “বৈষম্য চাই না।” কিন্তু আপনারা এখনো ক্ষমতায় পর্যন্ত গেলেন না অথচ যে বা যারা খুন/হত্যা করলো তাদের বিচার না করেই নির্বাচন দেবার পায়তারা করছেন, খুনীদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছেন। শুনলাম, “চাঁদা তো সব জায়গায় চলছে শুধু পার্টির লোক বদলেছে…” এই মডেলে?
এবার আশা যাক একজন টাকলা ভদ্রলোক সম্পর্কে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান টাকলা ব্যারিষ্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। আপনাকে ‘টাকলা’ আমি ইচ্ছে করেই বলছি। কারণ আপনি সত্য পছন্দ করেন এবং আপনি টাকলা। আমরা আনুপাতিক নির্বাচন চাচ্ছি। কবে থেকে? আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে গুগলে সার্চ দিলে বাংলা লেখাগুলোর মধ্যে যে লেখাটি সবচেয়ে বেশি পুরনো তবে থেকে। এতে উনি ঈসরায়েলের উদাহরণ টেনে বলেছেন, “এতে উগ্রবাদীরা ক্ষমতায় আসবে। সুতরাং বিষয়টি আরো খতিয়ে দেখার বিষয় আছে।”
আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বিএনপির হবে, দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির মত বৃহত্তর দল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে ভাবছে, কারণ তারাও জানেন খতিয়ে আরো দেখতে গেলে কিছুই থাকবে না। আর আমরাও চাই এবি পার্টির দুই একজন হলেও ক্ষমতায় যাক। নতুন ও বিকল্প দলগুলোর স্বাদ নেওয়া এখনো বাকি।
সর্বশেষ, সব পাড়া ও মহল্লায় কিছু কুকুর থাকে। আমাদের দেশে রাজনীতির পাড়ার কুকুর হলো জাতীয় পার্টি। যেখানে হাড্ডি সেখানে উপস্থিত হয়। মানুষ আপনাদের সবার প্রতি বিরুক্ত হয়ে একটি ফেসবুক পেইজ খুলেছে, “ইউসুফ সরকারকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।”
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.