রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: জ্ঞান ও ঐতিহ্যের মিলনস্থল

জ্ঞান অর্জন বা পড়াশোনার মাধ্যমে মানুষ আজ সভ্য হয়েছে। নিজেদের বসবাসের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধার নানা কিছুর আবিষ্কার করেছে। জ্ঞান অর্জনের আদিস্থান গাছতলা, গুরুর বাড়ি থেকে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে এসে রূপ নিয়েছে। বিশ্বে এখন নানা ধরনের জ্ঞান কাণ্ডের বিকাশ হয়েছে। ফলে প্রতিটি শাখার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলো নিজ নিজ ভাবে আলোকিত এবং দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে আলোকিত করে যাচ্ছে। জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে দারুণ একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার এক মিলনস্থল। এখান থেকে একজন শিক্ষার্থী নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অন্যতম সুনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এটি দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছর ধরে মানুষকে আলোকিত করে যাচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় ৬৯ বছর পেরিয়ে ৭০ বছরে নিজের আলোয় আলোকিত। দেশের সীমানা পেরিয়ে নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠা হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণআন্দোলন, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র-শিক্ষক ঝাঁপিয়ে পড়েছে অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলি খেয়ে ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা।

গুণীজনদের জন্মস্থান

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের গর্ভে জন্ম নিয়েছে অনেক গুণীজন। তাদের মধ্যে দেশবরেণ্য জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ভাষাবিজ্ঞানী ড. এনামুল হক, বিজ্ঞানী পিটার বার্টচি, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা, ইমেরিটাস অরুণ কুমার বসাক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত ও বিশিষ্ট নাট্যকার মলয় ভৌমিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম, বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন, সঙ্গীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর ও অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমরের মতো শিক্ষক। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুমসহ অনেক স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়! উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা-প্রযুক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম তীর্থস্থান এই প্রাঙ্গন। এখানের সুবিস্তৃত মাঠ ও বিভিন্ন প্রান্ত শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের মূল জায়গা। ফলে দেশের যেকোনো প্রান্তের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ও পড়াশোনার পরিবেশ অনুসারে এই প্রতিষ্ঠান পছন্দের শীর্ষে থাকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ডিগ্রি পাওয়া যাবে

কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন ডিগ্রি নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন। যেগুলো হলো:

  • স্নাতক (সম্মান): বিএ, বিএফএ, বিপিএ, বিএসসি, বিফার্ম, এলএলবি, বিবিএ, বিএসএস, বিএসসি এজি, বিএসসি ফিশারীজ ও বিএড।
  • স্নাতকোত্তর: এমএ, এমএফএ, এমপিএ, এমএসসি, এমফার্ম, এলএলএম, এমবিএ, এমএসএস, এমএস এজি, এমএস ফিশারীজ, এমএড ও এমপিএস। এছাড়া এমবিবিএস, বিডিএস ও ডিভিএম।
  • উচ্চতর ডিগ্রি: এমফিল ও পিএইচডি।
  • অন্যান্য ডিগ্রি: সার্টিফিকেট ইন ল্যাংগুয়েজেজ, সিনিয়র সার্টিফিকেট ইন ল্যাংগুয়েজেজ, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন জেনারেল সেরিকালচার, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ও পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ইনফরমেশন টেকনোলজি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫৩ একর বা ৩০৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ক্যাম্পাস। যার মধ্যে রয়েছে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইন্সটিটিউট, ১২টি অনুষদের অধীনে ৫৯টি বিভাগ ও শিক্ষার্থীদের জন্য ১৭টি আবাসিক হল। বর্তমানে প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী ও এক হাজার ৩০০ জন শিক্ষক রয়েছে। এছাড়া অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪১টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা এদেশের সর্বপ্রথম স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। তাছাড়া রয়েছে সাবাস বাংলাদেশ নামে একটি ভাষ্কর্য। গোল্ডেন জুবিলি টাওয়ার, সুবিশাল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরী, বিভাগীয় কম্পিউটার ল্যাব, ইন্সটিটিউট ও অনুষদ লাইব্রেরী, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ও লাইব্রেরী এবং কম্পিউটার সেন্টার। সংস্কৃতি চর্চার জন্য রয়েছে শিক্ষক-ছাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং খেলাধুলার জন্য স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো।

একাডেমির বাইরে সুযোগ-সুবিধা

বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন একটি জায়গা যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য মেধাকে কাজে লাগিয়ে যে কেউ সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ পান। এসবের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শতাধিক ক্লাব ও সংগঠন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো:

  • রোভার স্কাউট গ্রুপ
  • বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)
  • ক্যারিয়ার ক্লাব
  • জাতিসংঘ ভিত্তিক সংগঠন আরইউমুনা
  • উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে গমন বিষয়ক ক্লাব
  • ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
  • রোটারি ক্লাব
  • রাবি পাঠক ফোরাম

সংস্কৃতি চর্চার সংগঠন

  • বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা
  • বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠি
  • চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
  • অরণী সাংস্কৃতিক সংসদ
  • অনুশীলন নাট্যদল
  • সমকাল নাট্যচক্র
  • রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ড্রামা এসোসিয়েশন (রুডা)
  • তীর্থক নাটক
  • বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার রাজশাহী
  • অ্যাসোসিয়েশন ফর কালচার অ্যান্ড এডুকেশন (এস্)
  • বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্টি

অন্যান্য সংগঠন

  • আবৃত্তির সংগঠন: স্বনন ও ঐকতান
  • সাহিত্য চর্চার সংগঠন: চিহ্ন, স্নান
  • চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন: ম্যাজিক লণ্ঠন ও রাবি ফিল্ম সোসাইটি
  • সায়েন্স ক্লাব: বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ ও এগ্রিকালচারাল ক্লাব
  • বিতর্কের সংগঠন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং ফোরাম (আরইউডিএফ), গ্রুপ অব লিবারেল ডিবেটরস (গোল্ড বাংলাদেশ), ক্রিডেন্স, রেটোরিক
  • স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন: নবজাগরণ ফাউন্ডেশন ও ইচ্ছে
  • লেখালেখির সংগঠন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (রাবিসাস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি (রুরু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব।
  • স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন: নবজাগরণ ফাউন্ডেশন ও ইচ্ছে।
  • বিতর্কের সংগঠন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং ফোরাম (আরইউডিএফ), গ্রুপ অব লিবারেল ডিবেটরস (গোল্ড বাংলাদেশ), ক্রিডেন্স, রেটোরিক।
  • সায়েন্স ক্লাব: বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ ও এগ্রিকালচারাল ক্লাব।
  • চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন: ম্যাজিক লণ্ঠন ও রাবি ফিল্ম সোসাইটি।
  • আবৃত্তির সংগঠন: স্বনন ও ঐকতান।
  • সাহিত্য চর্চার সংগঠন: চিহ্ন, স্নান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, গবেষণা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন।

উপসংহার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। এখানের শিক্ষার পরিবেশ, অবকাঠামো এবং বিভিন্ন সংগঠন শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। ফলে দেশের যেকোনো প্রান্তের শিক্ষার্থীদের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি পছন্দের গন্তব্য।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading