ভ্রমণ

সেন্টমার্টিন: বাংলাদেশের নীলাভ স্বর্গ

প্রবালের বিস্ময়, জীববৈচিত্র্য এবং পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, যার বালুকাময় সমুদ্র সৈকত এবং নীল সমুদ্রের অবিরত গর্জন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন। এই দ্বীপের চারপাশের নীল সাগর এবং নীল আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে এক নীলাভ রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রতিটি দর্শনার্থীর মনে এক অমোঘ আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

দক্ষিণের স্বর্গ নামে পরিচিতি

‘দক্ষিণের স্বর্গ’ নামে পরিচিত এই দ্বীপে রয়েছে সারি সারি নারিকেল গাছ, কেয়া বন, এবং গাঙচিলের ঝাঁক। সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য এবং সৈকতের স্নিগ্ধ বাতাস পর্যটকদের মনে এক অনাবিল শান্তির অনুভূতি জাগায়।

পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য

প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক এই দ্বীপে তাদের পদচিহ্ন রেখে যান, যা এই দ্বীপকে দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এক পরম আরাধ্য পর্যটন স্থানে পরিণত করেছে।

প্রবালের বিস্ময়

প্রবাল হল এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী, যা অবৃন্তক এবং অমেরুদন্ডী। এরা কলোনির মত একত্রে বসবাস করে এবং প্রতিটি প্রবাল পলিপ নিজের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসরণের মাধ্যমে শক্ত পাথুরে খোলস বা বহিঃকঙ্কাল তৈরি করে।

প্রবাল দ্বীপ: প্রাকৃতিক বিস্ময়ের এক অনন্য উদাহরণ

প্রবাল দ্বীপ হলো এমন এক প্রকার দ্বীপ যা প্রবাল ছাইভস্ম এবং জৈব পদার্থ দিয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলি প্রবালের দেহাবশেষের উপর নতুন প্রবালের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বড়সড় পাথুরে আকৃতি ধারণ করে। এভাবেই তৈরি হয় বড় প্রবাল দ্বীপ এবং প্রবাল প্রাচীর।

বিজ্ঞাপন

সেন্ট মার্টিন্স: বাংলাদেশের প্রবাল প্রাচীরের দ্বীপ

সেন্ট মার্টিন্স এমন-ই এক প্রবাল প্রাচীরের দ্বীপ। পৃথিবীর বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর হলো অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ডে অবস্থিত দি গ্রেট বেরিয়ার রিফ, যার দৈর্ঘ্য ১৯৩০ কি.মি. এবং প্রস্থ ১৬ থেকে ১৪৫ কি.মি.।

সেন্ট মার্টিনের প্রবালের বৈশিষ্ট্য

প্রায় ২২º সে. তাপমাত্রা বিশিষ্ট পানি প্রবালের বিকাশের জন্য সর্বোত্তম। সেন্ট মার্টিনের প্রবাল এই তাপমাত্রায় সবচেয়ে ভালো বেড়ে ওঠে, যদিও ১৮º সে -এর কম তাপমাত্রা এদের জন্য ক্ষতিকর। এই অনুকূল পরিবেশের কারণেই সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।

প্রবালের ঐতিহাসিক বয়স ও ভূ-গাঠনিক প্রভাব

এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন প্রবালের বয়স ৩৩,২৩৮ বছর। বর্তমানে এখানে প্রবাল জন্ম নেওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান, তবে ভূ-গাঠনিক ক্রিয়া এদের বড় ধরনের ক্ষতি করছে।

সেন্ট মার্টিনের প্রবাল বৈচিত্র্য

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অধিকাংশ প্রবাল খন্ডই আকারে ছোট, তবে কিছু এলাকায় বড় আকৃতির প্রবালও চোখে পড়ে। এখানে ২১ প্রজাতির জীবাশ্ম প্রবাল এবং ৩৯টি প্রজাতির জীবন্ত প্রবাল চিহ্নিত করা গেছে।

প্রবাল সংগ্রহ ও স্থানীয় প্রজাতি

সমুদ্র শান্ত থাকা এবং জোয়ারভাটা অনুকূল হলে স্থানীয়রা প্রবাল সংগ্রহ করে। প্রধানত চার ধরনের প্রবাল সংগ্রহ করা হয়: পাতাফুল (Acropora sp), গাছফুল (Acropra sp), শৈবাল (Favia sp) ও মগ (Goniastrea sp)। এদের মধ্যে Acropora-র চাহিদা সবচেয়ে বেশি।

বিজ্ঞাপন

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ: বাংলাদেশের দক্ষিণের মুকুট

বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তার অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মুখে এই দ্বীপের অবস্থান।

প্রশাসনিক কাঠামো ও ঐতিহ্য

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন টেকনাফ উপজেলার অধীনে ৬নং ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে পরিচালিত হয় এবং এটি জাতীয় সংসদের ২৯৭নং নির্বাচনী এলাকা ও কক্সবাজার-৪ এর অংশ। স্থানীয়রা এই দ্বীপকে ‘নারিকেল জিনজিরা’ নামে ডাকে।

আয়তন ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার এবং এটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার এবং কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত শিলাস্তূপ বিস্তৃত।

প্রবাল প্রাচীর ও ছেঁড়া দ্বীপ

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিকে ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর রয়েছে। এছাড়াও, মূল দ্বীপের আশেপাশে কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ছেঁড়াদিয়া বা সিরাদিয়া (ছেঁড়া দ্বীপ) নামে ডাকা হয় এবং এগুলো বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু হিসেবে পরিচিত।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য

ভূ-প্রকৃতি

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূপ্রকৃতি মূলত সমতল হলেও কিছু কিছু বালিয়াড়ি এবং পাথরের উপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রবালের ওপর বালি মাটির স্তর এই দ্বীপের ভূমির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বিজ্ঞাপন

প্রাণিকুল

দ্বীপে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, এবং ২ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। সন্ন্যাসী শিল কাঁকড়া, স্পঞ্জ, লবস্টার, শিল কাঁকড়া এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন রূপচাঁদা, পরী মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি এখানে বিচরণ করে। সবুজ সাগর কাছিম, জলপাইরঙা সাগর কাছিম এবং সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্য এই দ্বীপ বিখ্যাত।

উদ্ভিদ

দ্বীপে ১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। গোলাকার পাতার আইপোমিয়া লতা, কেয়া, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ, নারিকেল গাছ, শিমুল, আম, সুপারি, বাবলা, কড়ই এবং কেয়া গাছ এখানকার ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদ। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে কেওড়ার ঝোপ-ঝাড় এবং সৈকতে ঝাউ গাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ: জনসংখ্যা, পেশা এবং ইতিহাস

জনসংখ্যা ও পেশা

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি এবং রাখাইন মৎস্যজীবিরা এখানে বসতি স্থাপন করেন, যার ফলে দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত হয়। দ্বীপের মানুষের প্রধান জীবিকা হল মাছ ধরা, শুটকি প্রকৃয়াকরণ, চাষাবাদ এবং পর্যটন সেবা। প্রায় ৫,৫০০ লোক মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত। দ্বীপের প্রধান শস্য হল ধান এবং নারিকেল।

ইতিহাস

প্রায় ৫০০০ বছর আগে এই দ্বীপটি টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল। পরবর্তীতে, প্রায় ৪৫০ বছর আগে দ্বীপের দক্ষিণ অংশ জেগে উঠে। আরব বণিকরা এই দ্বীপকে ‘জাজিরা’ নামে ডাকতো, যা পরে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামে পরিচিত হয়। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে দ্বীপে প্রায় দেড় লাখ নারকেল গাছ রয়েছে।

স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপ: সেন্ট মার্টিন

ছেঁড়া দ্বীপের মায়া

২০০০ সালের শেষে আবিষ্কৃত ছেঁড়া দ্বীপ জোয়ারের সময় অংশবিশেষ ডুবে যায়। এর অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের মন কাড়ে। সেন্ট মার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপে স্পিডবোটে মাত্র দশ মিনিটের পথ। সাইকেল ভাড়া করে অনেকে এই দ্বীপে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পাড়ি জমান।

বিজ্ঞাপন

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ রক্ষা আইন

গত পাঁচ বছরে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা স্থানীয়দের জন্য লাভজনক। দ্বীপের প্রবাল ও কচ্ছপ সংরক্ষণে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রবাল প্রাচীর বিক্রি, মোটর চালিত নৌকা এবং মাছধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মিয়ানমারের মালিকানা দাবি

সেন্টমার্টিনের কিছু অংশ নিয়ে মিয়ানমারের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ সরকার এর প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। মিয়ানমার ভুল স্বীকার করেছে এবং বলেছে এটি ভুলবশত হয়েছে।

পানির নীচের সৌন্দর্য

দ্বীপের প্রবীণ অধিবাসীরা জানিয়েছেন, পানির নীচে রয়েছে প্রবাল, শৈবাল, মোলাস্কা, কাঁকড়া, মাছ এবং কচ্ছপের অপূর্ব সমারোহ। এই সৌন্দর্য এখন আর আগের মতো দেখা যায় না, কারণ পানি আর স্বচ্ছ নয়।

যে জলে আগুন জ্বলে

সেন্টমার্টিনের অদ্ভুত সৌন্দর্য

সেন্টমার্টিনের পানির অপরূপ দৃশ্যের মধ্যে একটি হল আগুনের মতো ঝিলিক দেখা। আমবস্যার রাতে, জোয়ারের সময় ঢেউয়ের মাথায় এই আগুনের ঝিলিক দেখা যায়, যা অনেকের কাছে ভৌতিক মনে হতে পারে। তবে, এই ঘটনা আসলে ফসফরাস জাতীয় খনিজ লবনের কারণে ঘটে, যা পানির ঘর্ষণে আগুনের মতো দেখা দেয়।

বিজ্ঞাপন

পর্যটকদের আকর্ষণ

পর্যটকরা যখন এই দ্বীপে আসেন, তারা প্রায়ই শুধু দ্বীপের উপরিভাগের বেলে ও চুনাপাথর, মরা শামুক, কড়ি, ঝিনুক এবং পানির ঢেউ এর সাথে ভেসে আসা প্রবালের ভাঙ্গা টুকরা দেখে অভিভূত হন। এই দৃশ্য পর্যটকদের মনে এক অমোঘ আকর্ষণ সৃষ্টি করে, এবং তারা ভাবেন যে প্রকৃত সৌন্দর্য আরো কত সুন্দর হতে পারে।

তথ্যবহুল টেবিল

বিষয় বিবরণ
অবস্থান কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার দক্ষিণে
আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যা প্রায় ১২ হাজার
প্রধান পেশা মাছ ধরা, শুটকি প্রকৃয়াকরণ, চাষাবাদ, পর্যটন সেবা
প্রধান শস্য ধান, নারিকেল
উদ্ভিদ প্রজাতি ১২০ প্রজাতি
প্রাণিকুল প্রজাতি ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ২ প্রজাতির বাদুড়

উপসংহার

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এর নীলাভ সৌন্দর্য, প্রবালের বিস্ময় এবং জীববৈচিত্র্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। তবে, দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সকলের সচেতনতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। সঠিক সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা এই নীলাভ স্বর্গকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখতে পারি।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

সেলিনা আক্তার শাপলা

আমি একজন লেখিকা ও ব্লগার। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি।

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading