সত্যজিৎ রায়: এক মহাপ্রয়াণের স্মৃতিচারণ

ত্রিশটি বসন্ত হয়ে গেলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ‘সত্যজিৎ রায়’। ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২ সাল। সত্যজিৎ নেই। হয়তো সেই কারণেই বড় বেশী করে আছেন তিনি। তিনি আমাদের চোখের দৃষ্টি, মনের ভাষা, হৃদয়ের অনুভূতি জুগিয়েছেন পূর্ণ চার দশক ধরে। বলাই যায় রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি আমাদের চারপাশ ঘিরে আছেন।

তাঁর না-থাকা, তাঁর থাকা

তিনি চলে গেছেন, যতখানি নিরুচ্চার ছিল তাঁর থাকা, তাঁর না-থাকা ঠিক ততোখানিই কিংবা তার চেয়ে অনেক বেশীই, সোচ্চার। যখন তিনি ছিলেন তখন তাঁর অস্তিত্ব রণিত হতো আমাদের মধ্যে কেবল তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। এখন এতোদিন তিনি নেই, তাঁর বিচ্ছেদ হাহাকার করে ফেরে আমাদের প্রতিটি সচেতন মুহূর্তে। ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যার পরবর্তী প্রতিটি সচেতন মুহূর্ত অহোরহো সাক্ষী সেই হাহাকার ময় স্তব্ধতা!

ফেলুদা এবং বিশ্বজনের বেদনা

‘ফেলুদা’র ভক্ত স্কুলে পড়া কচি কচি মুখগুলোতে তা যেমন ছিল মূর্ত, তেমন মূর্ত ছিল বিদগ্ধ প্রবীণদের বিষাদময় অবয়বে। একই বেদনার প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল সে দিন বিশ্বজন। তিনি চলে গেছেন, তিনি আর নেই, আর কোনও দিন তিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে ফিরবেন না – এই শূন্যতা বোধের আর্তি আজ অনেক সংযত। আজ মনে হয় তাঁকে নতুন করে জানা, জানানোর, তাঁকে আবিষ্কারের, তাঁর সৃষ্টির সান্নিধ্যে মগ্ন হওয়ার আগ্রহ।

মহাপ্রয়াণ এবং মহা-অধিষ্ঠান

তাই তাঁর মহাপ্রয়াণ যেন মনে হয় মহা-অধিষ্ঠান। তিনি নতুন করে বিশ্বমানবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন মরদেহের বিনাশের মধ্য দিয়ে। সূর্য অস্ত গেলে সব যেমন পুরো অন্ধকার হয়ে যায় না, কোথাও কোথাও আলোয় সমুজ্জ্বল থাকে। অমলিন সত্যজিৎ চলে গেলেও দীপ্ত এখনো তাঁর সৃষ্টিপ্রভা শুধু এই বাংলার ভূমিতে নয়, বিশ্বভূমিতে।

চিকিৎসকের স্মৃতিচারণ

“আমরা হেরে গেলাম, অনেক চেষ্টা করেও ওঁকে ধরে রাখতে পারলাম না, সত্যজিৎ বাবু চলে গেলেন।” – সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘকালীন চিকিৎসক ডা. কান্তিভুষণ বক্সী বেলভ্যু ক্লিনিকে লাউঞ্জের লিফটে এ কথা বলেন।

শেষ দিনগুলো

মৃত্যুর সঙ্গে সত্যজিৎ বেলভ্যু ক্লিনিকের সাত তলায় ছ’নাম্বার শুয়ে পাঞ্জা লড়েছেন অনেক দিন ধরে। এখানে তিনি এইবারে ভর্তি হয়েছিলেন ২৭ জানুয়ারি। সাতাশি দিন কাটিয়ে অষ্টআশি দিনে মারা যান হৃদরোগেই মৃত্যুর কারণ বলে জানিয়েছেন ডা. বক্সী।

প্রথম হার্ট অ্যাটাক এবং বাইপাস অপারেশন

আট-ন’বছর আগেকার কথা। সন ১৯৮৩, অক্টোবরে তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক। পাঁচ মাস না কাটতেই ফের অ্যাটাক ১৯৮৪ সনের মার্চ। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রে সুস্থ হলেও হার্টের দুর্বলতা থেকে যাওয়ায় সত্যজিৎ বাবুকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিশ্বখ্যাত হার্ট সার্জন ডা. ডেন্টন কুলি তাঁর অপারেশন করেন। হবে বাইপাস অপারেশন। ১৯৮৪ সালে ১২ জুন সত্যজিৎ বাবুকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো হিউস্টন। সঙ্গে পরিবারজন। ভালোভাবে অপারেশন হবার পর অগাস্টে ফিরলেন ভারতে। মোটামুটি একরকম থাকা সত্ত্বেও হার্টের বেসিক উইকনেস ছিল।

শেষ ইচ্ছা এবং অস্কার পুরস্কার

সত্যজিৎ বাবুর খুব ইচ্ছে ছিল লস এঞ্জেলসের ডরথি ম্য্যান্ডলার স্টেজে উঠে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘অস্কার’ নিজ হাতে তুলে নেবেন। তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়নি। নির্ধারিত দিনের পনেরো দিন পূর্বেই এই কলকাতা বেলভ্যু ক্লিনিকে রোগ শয্যায় শায়িত সত্যজিৎয়ের হাতে তুলে দেওয়া হলো ‘অস্কার’ পুরস্কারটি। সোনায় মোড়া ঝকঝকে পুরস্কারটি হাতে নিয়ে নিজের বক্তব্য জড়ানো গলায় বলেছিলেন সত্যজিৎ।

বিজয়া রায়ের স্মৃতিচারণ

২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ জায়া শ্রীমতী বিজয়া রায়ের কিছু স্মৃতিচারণ – ডা. বক্সী বেরিয়ে এলেন ঘর হতে। শান্ত ধীর বললেন, “হার্টটা স্টপ করে গেলো হঠাৎ, ওরা চেষ্টা করছে, কিছু হবে না ফলাফল।”

সত্যজিৎ রায়ের অবর্তমান

সত্যজিৎ রায়ের অবর্তমানে এক বিরাট শূন্যতা সকলেই বোধ করেছেন, করছেন এবং করবেন। তাঁর সৃষ্টির মাঝেই আমাদের সন্ধান চলবে ওই শূন্যতার পরিপূর্ণতার।

সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিকর্মের প্রভাব

সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিকর্ম শুধু বাংলা চলচ্চিত্রে নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেও এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো যেমন ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ ইত্যাদি আজও দর্শকদের মুগ্ধ করে। তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তিনি সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যকর্ম

সত্যজিৎ রায় শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, তিনি একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর লেখা ‘ফেলুদা’ সিরিজ এবং ‘প্রফেসর শঙ্কু’ সিরিজ আজও পাঠকদের প্রিয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে তিনি বাঙালি সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে।

সত্যজিৎ রায়ের প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা

সত্যজিৎ রায় তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৯২ সালে ‘অস্কার’ পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ‘ভারত রত্ন’ পুরস্কারেও ভূষিত হন।

সত্যজিৎ রায়ের উত্তরাধিকার

সত্যজিৎ রায়ের উত্তরাধিকার আজও বেঁচে আছে তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে। তাঁর চলচ্চিত্র, সাহিত্যকর্ম এবং সৃষ্টিশীলতা আজও নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading