মৃত্যুর ছায়ায় জীবনের লক্ষ্য: ‘Zom 100: Bucket List of the Dead’ সিরিজের দর্শন ও অনুপ্রেরণা
জীবনের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য নির্ধারণে মৃত্যুচিন্তার প্রভাব এবং জাপানীজ অ্যানিমেশন ও কোরিয়ান ড্রামার অনুপ্রেরণা
মৃত্যুর ভয় বা জীবিত থাকার অনিশ্চয়তা মানুষের জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মৃত্যুচিন্তায় মানুষের জীবন ক্ষীণ হিসেবে উদীয়মান হয় এবং এতে করে ব্যক্তির ফোকাস ঠিক করে দেয় বা বেশি স্বচ্ছতা নিয়ে আসে।
লক্ষ্য নির্ধারণে মৃত্যুচিন্তা
আমাদের হাজারো চিন্তা ও স্বপ্নের মধ্যে ছোট্ট জীবনে সম্ভাব্য যেসকল সফলতা বা অর্জন সম্ভব তার একটি বাকেট লিস্ট তৈরি করা সহজেই সম্ভব হয়। একইসাথে ঐ বাকেট লিস্টের সুনির্দিষ্ট প্রায়োরিটিও নির্ধারণ করে দেয়। কারণ আমি যদি বুঝতে পারি আমার হাতে সময় মাত্র একদিন বা এক সপ্তাহ, তাহলে আমাকে নিশ্চয় এমন জীবন নিয়ে ভাবতে হতে পারে যেখানে ঐ একদিন বা এক সপ্তাহে আমি সর্বোচ্চ কি কি করতে পারবো? বা আমার পক্ষে ঐ একদিন বা এক সপ্তাহে কি কি করা সম্ভব?
দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি
এই দর্শন নিয়ে খ্যাতিমান তিনজন দার্শনিক খুব দারুণ কাজ করেছেন: ১. মার্কাস অরেলিয়াস: ‘বৈরাগ্যবাদ (Stoicism)’ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা। তাঁর বই ‘মেডিটেশনস (Meditations)’ এ মৃত্যুর অনিবার্যতা জীবনের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২. সেনেকা: জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে মৃত্যুর সচেতনতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলতেন, মৃত্যুর সচেতনতা আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে করতে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে। ৩. মার্টিন হাইডেগার: জার্মান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক। তাঁর বিখ্যাত ‘বিইং অ্যান্ড টাইম (Being and Time)’ গ্রন্থে মৃত্যুকে জীবনের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইসলামিক দর্শন
ইসলামিক দর্শনও প্রায় একই কথা বলছে। পবিত্র আল-কোরআনে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে” (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৮৫) এবং “তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান” (সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৬)।
‘Zom 100: Bucket List of the Dead’ সিরিজের দর্শন
এই দর্শনের ভিজ্যুয়াল প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া একটি জাপানীজ অ্যানিমেশন সিরিজে। সাধারণ গল্পেও অসাধারণ দর্শন নিয়ে কাজ করেছে জাপানীজ অ্যানিমেশন ‘Zom 100: Bucket List of the Dead (মাঙ্গা সিরিজ)’ -এ। ২০১৮ সালে জাপানীজ অ্যানিমেশন বেশ সাড়া ফেলার পর ২০২৩ সালে কোরিয়ান একটি ড্রামা সিরিজ চলে আসে নেটফ্লিক্সে; একই নাম, একই দর্শন কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে। মানে অ্যানিমেশনের রিমেক হিসেবে তবে চরিত্রগুলো বাস্তব ক্যানভাসে।
কোরিয়ান ড্রামা
হরর, অ্যাকশন ও কমেডি ধাঁচের এই কোরিয়ান ড্রামাও দর্শকমহলে বেশ প্রশংসিত হয়। ‘My Drama List’ -এ এর রেটিং বর্তমানে ১০ এর মধ্যে ৭+, সুতরাং একবার দেখা যেতেই পারে। এখানে ব্যক্তি ‘নাইন টু ফাইভ পিএম’ চাকুরী পাওয়ার জন্য অস্থির, একইসাথে স্বপ্ন যখন অনেক বড় কোম্পানি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি যখন তার কাঙ্খিত চাকুরীও পেয়ে গেলেন তারপর ঠিক কি কি ঘটলো?
প্রোটাগনিস্টের সংগ্রাম
প্রোটাগনিস্ট কাজ করতে করতে নিজেই কবে জীবিত এক জম্বি হয়ে গেছেন তিনি জানেন না। তার স্বপ্ন ছিলো একদিন এতবড় কোম্পানীতে চাকুরী করা যেখানে মাইনে ভালো, পরিবেশ ভালো এবং কাজে প্রচুর প্রশংসা পাওয়া যায়। আরো বড় যে সুবিধে এই কোম্পানিতে পাওয়া যায় সেটা হলো, সহকর্মীদের আচরণ খুবই বন্ধুসুলভ। সুতরাং কে চাইবেনা এমন কোন এক জায়গায় চাকুরী মিলে যাক!
কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি
কিন্তু এই গল্পে দেখা যায় কোম্পানি যত বড় হয় দায়িত্ব বা কাজের চাপ তত বেশি হয়। একইসাথে কোম্পানি যত বড় সেখানের কর্মীদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি তত বেশি দেখা যায়। অবশ্য এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ে তেমন ভাবেন না। তিনি শুধু চান কীভাবে কাজ করে সবার মন জয় করা যায় এবং যে-কোনো ভাবে তার প্রমোশন দরকার।
জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ
ফ্রেডরিখ নীটশের ‘অতিমানব (Übermensch)’ হওয়ার কনসেপ্ট এবং ‘বৈরাগ্যবাদ (Stoicism)’ দর্শনের প্রয়োজনীয় মিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায় এই দুই সিরিজে, যেখানে মূল থিম ‘মৃত্যু’ কে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মৃত্যু যেখানে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। মৃত্যু যেখানে জীবনের লক্ষ্য পূরণের নির্দেশ বা টাইমলাইন। কারণ আমাদের জীবন তো কিছু সময়েরই সমষ্টি মাত্র। কিন্তু আকিরা টেন্ডোর জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেসব পূরণের ধরণ ছিলো খুবই আকর্ষণীয়। প্রথমত, তিনি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কি কি কাজ/স্বপ্ন সম্পন্ন করতে পারেন সেটা এবং দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ তিনি কি কি কাজ করতে পারেন সেসব কাজ/স্বপ্নের এক বালতি তালিকা; মোট ১০০টি নির্ধারণ করেন।
উপসংহার
বৈরাগ্যবাদ দর্শন নিয়ে কোরিয়ান সিরিজ ও জাপানীজ অ্যানিমেশন এত এত বেশি কাজ করছেন যা তাদের সিনেমা, সিরিজ ও নাটকগুলোকে উঁচু মাত্রায় আজ নিয়ে গেছে। ঠিক তেমন করে ‘Zom 100: Bucket List of the Dead’ একইসাথে আপনাকে বিনোদন দেবে, জানতে চাইলে কিছু জানাবে, শিখতে চাইলে কিছু শেখাবে, হাসতে বা কাঁদতে চাইলে সেটাও করবে… নির্ভর করবে আপনি কেমন দর্শক? তাই জাপানীজ অ্যানিমেশন এবং কোরিয়ান ড্রামা দুটোই রেকোমেন্ডেড রইলো। রাখুন ওয়াচলিস্ট এ আপনার মৃত্যুর পূর্বে বাকেট লিস্ট তৈরির জন্য। হ্যাপি ওয়াচিং!