পুরুষের চুল কাটার দুর্ভোগ
চুল কাটার কষ্ট
ভাবতে ভাবতে সেই নিষ্ঠুর অমানুষটি হঠাৎ একটা ময়লা তোয়ালে তাঁর গলায় পেঁচিয়ে দেয়। সেই ব্যক্তি তৃপ্ত হয়ে আনন্দ পায়, যেন কি এক শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে চলেছে অতি সূক্ষ্মতার সঙ্গে! মাঝে মাঝে একটা ‘খচ’ করে শব্দ। বুদ্ধদেব ভাবেন, যাক, এতোক্ষণ কষ্টটা সহ্য করে দু’মাসের মতো নিশ্চিন্ত!
কিন্তু না! মাসখানেকও শান্তিতে কাটে না। একটা আট ঘন্টার সুখনিদ্রা দিয়ে সকালে শয্যায় বসে চা পান চলছে, তখনই পেনশন প্রাপ্ত পিসেমশায় অবাধে ঘরে প্রবেশ করে বলেন, “মাথাটাকে কাকের বাসা করে রেখেছিস কেন? ইস! বিশ্রী! বেঁচে আছিস কি করে?”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
কয়েক দিন পর ট্র্যামে ওঠার পর পাশে বসলেন এক পত্রিকার সম্পাদক। আমার এপাশ ওপাশ নিরীক্ষণ করে বললেন, “কই না তো!” বুদ্ধদেব বলেন, “কি হলো?” শুনেছিলাম আপনি বাবরি চুল রাখছেন। কিন্তু না তো! এতো উচ্চঃস্বরে বললেন যে আশে পাশের সবাই গোল গোল চোখ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।
তরুণ কবির মন্তব্য
এক দিন এক তরুণ কবি এলেন গৃহে। বললেন, নির্লজ্জ হলেই প্রেমের কবিতা লেখা যায়, নির্লজ্জ যদি হতে হয় তাহলে শুধু প্রেমের কবিতা লেখা নয়, নির্লজ্জের মতো প্রেম করাই ভালো। এমন একটি লম্বা ভাষণ দিয়ে চলে যাবার সময় বললেন, আপনার চুলটি বেশ হচ্ছে – একেবারে উদয়শংকর!
স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
এর দিন সাতেক পর মনে ঘনিয়ে আসা একটি কবিতার স্তবক আওড়াতে আওড়াতে স্নানঘর থেকে ভিজে চুলে বেরিয়েছি, রাণু (তাঁর স্ত্রী – লেখিকা প্রতিভা বসু) তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, “তুমি আজই যাবে কিনা বলো?” তিনি কনটিনিউ করছেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে, “কেন আজ কি?” সে দিন ডলি বলে গেলো বুদ্ধদেব বাবুর দিকে তো আর তাকানো যায় না!
“তোমার সখী ভুল বলেছেন, এই তো আমি বুদ্ধদেব বাবুর দিকে বেশ তাকাতে পারছি!” বলে আয়নার সামনে ভিজে চুলের জল ছিটিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললাম। “ঠিক বলেছে ডলি। নিজের পেছন দিকটা তো দেখা যায় না। পুরুষ মানুষের ঘাড় বেয়ে চুল নামলে বিকট দেখায়।”
“সত্যি কি যে বিকট দেখায়!” রাণু হেসে বলে, “এই কি হচ্ছে? না সত্যি বলছি এখনই যাও।” বুদ্ধদেব কাতর স্বরে বলেন, আজ তো সম্ভব হবে না, “আজ আমার অনেক কাজ।” “কাজ তুমি একলাই করো না কি?”
নরসুন্দরের কাছে যাওয়া
বুদ্ধদেব কলমটা খুলে টেবিলে লিখতে বসলেন। “তুমি তাহলে আজ যাবে না?” রাণুর তীব্র স্বর। “না! যাবো না। সময় মোটে নেই।” বুদ্ধদেব খাতায় মনোনিবেশ করলেন। লেখায় মন ছিল না বুদ্ধদেবের, ভীত মনে চিন্তা করছেন যতই বীরত্ব দেখান। মনে মনে ঠিকই জানেন, সেই শেষের সময় ঘনিয়ে এসেছে, দু’ঘন্টা দুখের ক্ষণ!
নরসুন্দর এখন আর কারো ঘরে আসে না। যেতে হবে তাঁকেই। তার কাছে, যাকে চেনা নেই জানা নেই। তারা চিত্তবিনোদনের জন্য অথবা মনোরঞ্জনের তরে কারুর ঘরের হাঁড়ির খবর বলে না নরসুন্দরদের মতো। বিনা বাক্যে সেই কুশলী শিল্পীর হাতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
চুল কাটার কষ্ট
কিন্তু যাওয়া কতটা মুস্কিল তা কি তাঁর জীবনসঙ্গীনি রাণু কোনও দিন অনুভব করবেন, জানবেন? সপ্তাহের কোন দিন খোলা, কোনদিন বন্ধ, কোন দিন আধেক, কোন দিন পুরো সেও তাঁর খেয়াল থাকে না। ছুটির দিন নয়, সোম, মঙ্গল, বুধ দুপুর কি সহজে আসে! আর সকাল, সন্ধ্যে কি যে ভীড় হয় সেখানে, ভাবতেই হৃদকম্প উপস্থিত হয়। শুধু কি এই! সেখানে যেতে বাস, ট্র্যাম লাগে। যাওয়া, আসা, কিছুক্ষণ অপেক্ষায় বসে থাকা, অন্তত দু’ঘন্টা সময় লাগে দুঃখের দুটি ঘন্টার জন্য।
বইয়ের সঙ্গ
তো কেমন করে কাটবে দু’ঘন্টা! সঙ্গে একটা বই তো রাখতেই হয়! দীর্ঘকেশ তাঁর, তাই খুঁজে পেতে, বলা যায় দৈবক্রমে এমন কোনো পাঠ্যবস্তু হাতে আসা চাই যা তাঁকে দুঃখ ভুলিয়ে রাখতে পারে!
একখানা বই হাতে তাঁকে সেখানে যেতে হয় পাংশুমুখে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, আর যেন তাঁকে এই বীড়ম্বনা ভোগ করতে না হয়! রিক্ত কেশে অসহনীয় কষ্ট ভোগ করে যখন তিনি গৃহে পা রাখেন মানে পা দিতে না দিতেই ছোট কন্যা বলে, “বাবা, তোমায় কি বিশ্রী দেখাচ্ছে!”
পুনরাবৃত্তি
দুটো দিন কাটতে না কাটতে আবার সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি। হায়! পুরুষের জীবনে এ কি পৌনঃপুনিক দুর্ভোগ! রাণু বলে, পুরুষের এতো কাঁদুনি গাইছো, মেয়েদের যে দু’বেলা চুল বাঁধতে হয় সে কথা ভেবেছো!
“ভাববেন না! মেয়েদের প্রসাধন যে কি সুন্দর!” পুরুষ রোজ দাড়ি কামান সে এক সামাজিক নিয়ম। ঐ যন্ত্রণা গাল পেতে নিতে হয়! তারও কি যন্ত্রণা কে বুঝবে! নানা রকম মুখভঙ্গী করে বিনা রক্তপাতে পুরুষ নিত্যদিনের সংগ্রাম করে বাইরে বেরতে পারে, তার সঙ্গে তুলনা মেয়েদের চুল বাঁধা!
মেয়েদের প্রসাধন
একটি মেয়ে যখন লম্বা কেশ এলিয়ে রোদে দাঁড়ায়, বিকেলে চুল আঁচড়াতে গুনগুনায়, হাতের মধ্যে ফিতে চেপে দু’হাত দিয়ে খোঁপা বাঁধে – এই অবস্থায় সে সুন্দরী না হলেও সুন্দর। চুল বাঁধা নিছক নিয়ম রক্ষা নয়, মেয়েদের নিজেকে ব্যক্ত করা। এই জন্যই তো মেয়ে চুল বাঁধে আবার রাঁধেও। সেখানে পুরুষ কি ছড়া কাটবে আবার চুল ছাঁটবে সম্ভব!
পুরুষের কর্তব্য
পুরুষের কর্তব্য সম্পাদন, মেয়েদের প্রসাধন জীবন সাধনার অঙ্গ। বুদ্ধদেব বলেন, তাই দু’মাসে দু’ঘন্টা সেই পরামানিকের কাছে আত্মসমর্পণ করে দুঃখ ভোগ করা! না ভুল – বুদ্ধদেব স্বীকার করেন এক রূপশিল্পী, কেশকলাবিদ, সৌন্দর্য সম্পাদকের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া! খুব সম্ভব ভবিষ্যতে সেই শিল্পীরা মার্কিন দেশ থেকে একটা ডক্টরেট ডিগ্রী এনে নিজেদের নামের আগে প্রফেসরের পতাকা ওড়াবে!
কৃতজ্ঞতা
বুদ্ধদেব বসু
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.