ইতিহাসের সেরা ১০ সুন্দরী নারী: সৌন্দর্যের কিংবদন্তি

কবির ভাষায়, নারী হেসে ওঠার আগে পৃথিবী ছিল বিষণ্ন, বাগান ছিল জঙ্গল আর পুরুষ ছিল সন্ন্যাসী। যুগের পর যুগ সৌন্দর্য আর কোমলতার প্রতীক হলেন নারী। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এমন অনেক সুন্দরী নারীর কথা জানতে পারা যায়। তাদের মধ্যে মেরি, এলিজাবেথ, লুক্রেজিয়া বর্জিয়াসহ আরও অনেকে বিখ্যাত। এসব বিখ্যাত নারীদের কৃতকর্মের কথা কমবেশি আমরা অনেকেই জানি। আজ আমরা তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো, যা জানলে আপনারা অনেকেই বিস্মিত হবেন।

১. ক্লিওপেট্রা

পরিচিতি

ইতিহাসের সেরা সুন্দরীদের কথা মনে করলে প্রথমে যার কথা মাথায় আসে তিনি হলেন ক্লিওপেট্রা। তিনি ছিলেন মিশরের শেষ রানী। ক্লিওপেট্রা জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে। তিনি জগত বিখ্যাত রূপসী ছিলেন এবং সেই সাথে বুদ্ধিমতি একজন রানীও ছিলেন।

রূপচর্চা

তিনি তার রূপচর্চার জন্য ব্যবহার করতেন ভেষজ বিদ্যাকে। তার আবিষ্কৃত সৌন্দর্য চর্চার বিভিন্ন পদ্ধতি আজও ব্যবহার হয়। এখানকার ফেস মাস্কের ধারণার আবিষ্কারকও হলেন ক্লিওপেট্রা। তিনি মধু, ডিমের সাদা অংশ এবং ‘গাধারখুর’ নামে এক প্রকার গাছের পাতার রস দিয়ে ফেস মাস্ক বানাতেন। ক্লিওপেট্রা যখন গোসল করতেন তখন গোসলের পানিতে গাধার দুধ ও খাঁটি মধুর সাথে বাদাম তেল মিশিয়ে দিতেন। এটা ছিল তার রূপের একটি বিশেষ রহস্য। এটা ব্যবহারে ত্বক কোমল ও সুন্দর হয়। দুধ ও মধু দিয়ে গোসলের সময় ক্লিওপেট্রার দাসীরা একটি বিশেষ ধরনের স্ক্রাব লাগিয়ে দিতো, যা ২ টেবিল চামচ সামুদ্রিক লবণ ও ৩ টেবিল চামচ ক্রিম (প্রাকৃতিক) দিয়ে তৈরি। এটি পুরো শরীরে ম্যাসাজ করার পর ৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে।

চুলের যত্ন

ক্লিওপেট্রা ২ টেবিল চামচ অ্যালোভেরা জুস, ৪ ফোঁটা গোলাপের তেল, ১ টেবিল চামচ বাদামের তেল ও মৌচাকের মোম দিয়ে মুখের জন্য এক ধরনের বিশেষ ক্রিম তৈরি করতেন। যেখানে মোম ও বাদাম তেল হালকা গরম করে নিতে হয়। এই উপকরণটি একবার বানিয়ে ফ্রিজে রেখে এক সপ্তাহ ব্যবহার করা যায়।

রানী ক্লিওপেট্রার চুল ছিল অনেক সুন্দর। তিনি তার চুলে শ্যাম্পু হিসেবে ডিমের সাদা অংশ চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগিয়ে নিতেন, তারপর ধুয়ে ফেলতেন। ২ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল ও ২ টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েল গরম করে তার চুলে লাগাতেন। এরপর প্রায় ৩০ মিনিট কাপড় দিয়ে চুল পেঁচিয়ে রাখতেন। এই হেয়ার ট্রিটমেন্ট চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং চুলকে কোমল করে। তিনি নিজেকে এবং নিজের রূপকে অনেক ভালোবাসতেন। এই জন্যই তিনি নিজের চুল ও ত্বকের যত্নে অনেক পদ্ধতি আবিষ্কার করে গেছেন।

২. সিমোনেত্তা ভেসপুচ্চি

পরিচিতি

আমরা যে বিখ্যাত সুন্দরী নারী সম্পর্কে আলোচনা করতে যাচ্ছি, আপনারা হয়তো তার সম্পর্কে নাও জানতে পারেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইতালির সেরা সুন্দরী। আর তিনিই হলেন সিমোনেত্তা ভেসপুচ্চি। মাত্র ২২ বছর বয়সে যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে পরপারে পারি জমান তিনি।

চিত্রশিল্পের মডেল

তার এই সুন্দর্যের জন্যই বত্তিচিল্লি সহ ফ্লোরেন্সের অনেক চিত্রশিল্পীরই চিত্রের মডেল হয়েছিলেন এই তরুণী। যেমন বত্তিচিল্লির ১৪৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অঙ্কিত ‘দ্যা বার্থ অফ ভেনাস’ চিত্রকর্মে মাঝখানে ভেনাসরূপে দাঁড়ানো নারী হলেন ভেসপুচ্চি, যিনি সেখানে ভেনাসের মডেল হিসেবে ছিলেন। সেই সময় ইতালীয় নারীরা ফ্যাশনের জন্য তার অন্ধ অনুকরণেই অভ্যস্ত ছিলেন।

রূপচর্চা

চেহারাকে ভেসপুচ্চির ন্যায় সাদা ও সৌন্দর্যময় করার জন্য সেকালের নারীরা মুখে জোঁক লাগিয়ে রাখতেন। জোঁকেরা তাদের রক্ত চুষে নেওয়ার ফলে তাদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যেতো। অনেকে জোঁক ব্যবহার না করে, পাউরুটির টুকরো, ডিমের সাদা অংশ ও ভিনেগার একত্রে মিশিয়ে ফেস মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করতেন। তবে ভেসপুচ্চির চুল জন্মগতভাবেই সোনালি রঙের ছিল। তাই অনেকেই তাদের চুলকেও সোনালি করতে চাইতেন। তবে যেসব নারীদের অর্থের অভাব বা দরিদ্র ছিল তারা তাদের নিজেদের চুলে নিজেদের মূত্র ব্যবহার করতো, যাতে তাদের চুলের রঙও হালকা হয়।

৩. রানী প্রথম এলিজাবেথ

পরিচিতি

রানী এলিজাবেথ ১৫৩৩ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের গ্রীনউইচে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি টিউডর রাজবংশের ৫ম ও শেষ রানী ছিলেন। তার বাবা ছিলেন অষ্টম হেনরি। প্রথম এলিজাবেথ নভেম্বর ১৭, ১৫৫৮ থেকে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রানী, ফ্রান্সের রানী, ও আয়ারল্যান্ডের রানী ছিলেন।

সৌন্দর্য ও রূপচর্চা

রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী। তিনি তার সৌন্দর্য ধরে রাখতে নিজের অনেক যত্ন নিতেন। তার যে কোন তৈলচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তার ত্বক, ঠোঁট এবং চুলের যত্নে তিনি বিভিন্ন প্রসাধনীর ব্যবহার করতেন। রানীর এই রূপচর্চাকে ইতিহাসবিদ স্যার রয় স্ট্রং ‘মাস্ক অফ ইয়ুথ’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে ১৯৭০ সালে বর্ণনা করেন।

রূপচর্চার পদ্ধতি

স্বভাবতই রূপ ও আচার-আচরণে ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি এবং রাজকীয়তার প্রতিফলন প্রয়োজন ছিল তার। সে জন্যই রূপচর্চা নিয়ে অনেক সচেতন ছিলেন তিনি। দিনের বেশিরভাগ অংশই তিনি রূপচর্চা করতেন। ১৫৬২ সালে তিনি গুটি বসন্তে আক্রান্ত হন। জীবন বাঁচলেও তার সারা শরীরে গভীর ক্ষতদাগ থেকেই যায়। তাই তিনি ‘ভেনেসিয়ান সেরুজ’ ব্যবহার করতেন। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাধিকবার মেকআপ করতেন। এই মেকআপ মুছতে তিনি ডিমের খোসা, অ্যালাম, এবং পারদের মিশ্রণ ব্যবহার করতেন। এই পারদই বিষক্রিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পারদের প্রভাবে তার চুলগুলোও ঝরে পড়েছিল। তার চোখেরও ক্ষতি হয়েছিল।

৪. মেরি আতোয়ানো

পরিচিতি

ফরাসি বিদ্রোহের আগে মেরি আতোয়ানোই ছিলেন ফ্রান্সের শেষ রানী। মানুষ যেগুলোকে খাবার হিসেবে জানেন মেরি আতোয়ানো সেগুলোকে ফেসমাস্কের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতেন।

রূপচর্চার উপাদান

সেখানে থাকত কনইয়াক মদ, ডিম, লেবুর রস ও গুরা দুধের সংমিশ্রণ। সকালে ঘুম থেকে উঠে রানী কবুতর সেদ্ধ করা পানি দিয়ে ফেস পরিষ্কার করতেন। প্রতিটি বোতলের পানিতে আটটি করে কবুতর ব্যবহার করা ছিল। তিনি দিনে তিনবার করে পোশাক বদল করতেন। তিনি ফ্রান্সে শিরাকে নীল রঙে রাঙানোর জনপ্রিয় ফ্যাশনের একজন অনুসারী ছিলেন। তিনি ছাড়াও সে সময়ের অনেক নারীরা এগুলো করতেন। আর তারা পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য এগুলো করতেন।

৫. সম্রাজ্ঞী জো পোরফাইরোজেনেটা

পরিচিতি

জো পোরফাইরোজেনেটাকে বলা হয়ে থাকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অন্যতম সেরা সুন্দরী সম্রাজ্ঞী। তিনি যখন তরুণী ছিলেন তখন তেমন সুন্দর ছিলেন না। কিন্তু তিনি সম্রাজ্ঞী হওয়ার পরে তার রূপচর্চার উদ্দেশ্যে প্রাসাদের ভেতরে একটি কসমেটিকের গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়।

রূপচর্চার গবেষণাগার

এখানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো অনেক দামি ছিল, এবং তৈরি প্রসাধনিগুলোও অনেক ব্যয়বহুল ছিল। যার ফলে তাকে ষাটোর্ধ্ব হয়েও এতোটাই সুন্দর লাগতো যে মনে হতো কোন তরুণী হেঁটে যাচ্ছে।

৬. নেফারতিতি

পরিচিতি

মিশরের রানী নেফারতিতির নাম অনেকেরই অজানা। তার নামের অর্থ হলো সৌন্দর্যের আগমন। শুধু নামেই নয়, নামের সাথে রূপের সত্যিকার মিল রয়েছে।

রূপচর্চা

নেফারতিতির মাথায় কোন চুল ছিল না, পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো চুলই কামিয়ে ফেলা হয়েছিল। তাই তিনি মাথায় পরচুলা ব্যবহার করতেন। তিনি চোখে সীসার আকরিক গ্যালেনা থেকে তৈরি সুর্মা ব্যবহার করতেন। তিনি যে লিপস্টিক ব্যবহার করতেন সেটি বিষাক্ত ব্রোমিন ম্যানাইট দিয়ে তৈরি, যা তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর ছিল।

৭. মেরি, কুইন অফ স্কটস

পরিচিতি

রানী মেরি তেমন একটা সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু তিনি যেহেতু রানী তাই তাকে সুন্দর হতেই হবে।

রূপচর্চা

তাই তিনি তার চেহারাকে সুন্দর করার জন্য তার চাকর-বাকরদের হোয়াইট ওয়াইন দিয়ে বাথটাব পূর্ণ করতে বলতেন। তবে জন্মগতভাবেই তার নাকটা ছিল লম্বাটে গড়নের, আর চিবুকটা ছিল সূক্ষ্মগ্রবিশিষ্ট। তিনি বাথটাবে গা ভিজাতেন এবং মনে করতেন তার রূপের উন্নতি হচ্ছে।

৮. লুক্রেজিয়া বর্জিয়া

পরিচিতি

লুক্রেজিয়া বর্জিয়া ছিলেন বিখ্যাত হাউজ অফ বর্জিয়ার এক অভিজাত বংশীয় নারী। তার রূপের আকর্ষণীয় দিক ছিল তার চুল।

চুলের যত্ন

তার চুলগুলো ছিল সোনালি বর্ণের, তবে তা জন্মগতভাবে ছিল না। তার পরিবারের সকলের চুল ছিল ঘন, কালো। কিন্তু বর্জিয়ার পছন্দ ছিল সোনালি চুল, সেজন্য তিনি লেবুর রস ও এক প্রকার ক্ষারের সাহায্যে চুলগুলোকে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতেন। পরে আবার সূর্যের আলোতেই চুলগুলো শুকিয়ে নিতেন। তার চুলের যত্ন নিতে এতোটাই সময় লাগতো যে মাঝে মাঝে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্তও বাতিল করতেন।

৯. ফ্রাইন

পরিচিতি

ফ্রাইন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মানুষ ছিলেন। সে সময়ে যেসব গল্প ও উপকথা ছিল সেগুলোতে তার রূপের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

রূপচর্চা

প্রাচীন গ্রিসের এই নারী বিখ্যাত ছিলেন তার অঙ্গ সৌষ্ঠব ও নিষ্কলুষ সৌন্দর্যের জন্য। পরবর্তীতে সৌন্দর্য ও প্রেমের দেবী অ্যাফ্রোডাইটের যে মূর্তি ও ছবি ছড়িয়ে পড়ে, তা ফ্রাইনের মাধ্যমে ই তৈরি হয়েছিল।

১০. গিনিভিয়ার

পরিচিতি

গিনিভিয়ার ছিলেন সর্বকালের সেরা সুন্দরী। তাকে ব্রিটেনের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সুন্দরী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। তার বাবার নাম ছিল রাজা লিওডিগ্রান্স।

রূপচর্চা

গিনিভিয়ার ছিলেন বিখ্যাত রাজা আর্থারের প্রিয়তমা স্ত্রী। রাজা আর্থারের বিভিন্ন কিংবদন্তি ও মিথের সাথে জড়িয়ে আছে গিনিভিয়ারের সৌন্দর্যের কথা।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading