মনোবিজ্ঞান

ডার্ক ট্রায়াড: আপনার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য!

নার্সিসিজম, ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম, সাইকোপ্যাথি: কিভাবে চিনবেন এবং এদের থেকে সাবধান থাকবেন?

ডার্ক সাইকোলজি নিয়ে দশম কিস্তি। দশম পর্বে আমি ডার্ক সাইকোলজির ‘ডার্ক ট্রায়াড (Dark Triad)’ নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। প্রতিবারের মত এবারেও সতর্কতা হচ্ছে, ডার্ক সাইকোলজির কোনো কৌশল কারো উপর প্রয়োগ করা থেকে দূরে থাকবেন। এই কৌশলগুলো নিয়ে আলাপ করার উদ্দেশ্য হলো আমরা সবাই যেন সাবধান থাকি। মানুষ খুব সহজেই আমাদেরকে ব্যবহার/অপব্যবহার বা কোনরূপ মানসিক অশান্তির মধ্যে না ফেলে দিতে পারে।

ডার্ক ট্রায়াডের বৈশিষ্ট্য

‘ডার্ক ট্রায়াড (Dark Triad)’ যেসব ব্যক্তির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে নিম্নোক্ত এই ৩টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে:

১. নার্সিসিজম (Narcissism) ২. ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম (Machiavellianism) ৩. সাইকোপ্যাথি (Psychopathy)

টক্সিক মানুষ চেনার উপায়

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি অমুক-তমুক খুবই ‘টক্সিক (Toxic)’ প্রকৃতির মানুষ। টক্সিক মানুষদের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ আমরা সবাই কমবেশি একে-অপরকে দিয়ে থাকি। কিন্তু কীভাবে বুঝবেন অমুক-তমুক একজন সত্যিই টক্সিক মানুষ এবং আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?

অন্যকে বিষাক্ত বলার সময় আমাদের সাবধান হতে হবে এবং কোনো ব্যক্তি যদি সত্যিই টক্সিক হয় তাহলে আরো বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ডার্ক ট্রায়াডের উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য কারো মাঝে যদি প্রকাণ্ডভাবে উপস্থিত থাকে তাহলে উক্ত ব্যক্তি একজন সত্যিকারের ‘টক্সিক (Toxic)’ প্রকৃতির মানুষ এবং এমন মানুষের সাথে জীবনে যদি ভুলেও সাক্ষাত হয় তাহলে এদের থেকে সবসময় ১০০ গজ দূরত্ব অবলম্বন করুন।

নার্সিসিজম (Narcissism)

এদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘নার্সিসিজম (Narcissism)’। নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতায় ভোগা এসব ব্যক্তি সারাক্ষণ “আমি… আমি… আমি…” করতে থাকে। এরা মনে করে পৃথিবী এদেরকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। নিজেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং অন্যের খারাপ পরিস্থিতির প্রতি শূন্য মাত্রার ‘সমব্যথী (Empathy)’ প্রকাশ করে থাকে। সার্বক্ষণিক নিজের প্রশংসা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। ব্যক্তিগত সমস্ত অর্জনের এক ধরণের সামাজিক স্বীকৃতি সবসময় প্রত্যাশা করে।

এদের মাথা নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করতে অক্ষম। কাউকে সাহায্য করার কথা এরা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারে না; ওতে সময় ও টাকার অপচয় মনে করে সবসময়। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে নিজেই এত মুগ্ধ থাকে এতে বাকিরা সেটা আর মূল্যায়ন করার সুযোগ-ই পায় না। এই ধরণের ব্যক্তি সবসময় মনে করেন তার দ্বারা ভুল হওয়া একরকম অসম্ভব সুতরাং তাকে নিয়ে সমালোচনাও করা যাবে না। নিজেকে সুপিরিয়র পাশাপাশি কাছের মানুষদের ক্রমান্বয়ে ইনফেরিওর ভাবাতে একরকম বাধ্য করে। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া একটি জনপ্রিয় হিন্দি গান, “মে ইতনি সুন্দর হু মে কিয়া কারু!” – দেখে আমার শুধু বলার, “তুই ডাক্তার দেখা বোন?”

ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম (Machiavellianism)

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম (Machiavellianism)। ইতালীয় একজন বিখ্যাত দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ১৫১৩ সালে একটি বই লেখেন ‘দ্য প্রিন্স (The Prince)’ নামে। এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৫৩২ সালে (লেখকের মৃত্যুর ৫ বছর পর)। এই বই থেকেই মূলত আমরা জানতে পারি মানুষের মধ্যে ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। ম্যাকিয়াভেলিয়ানদের মধ্যে কৌশলী এবং প্রতারণামূলক উপাদান দেখা যায়। এরা চোখে চোখ রেখে মিথ্যে কথা বলতে সক্ষম এবং প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় ডেটা (তথ্য) গোপন রাখতে সক্ষম। কারণ পরবর্তী সময়ে ঐ লুকায়িত তথ্যকে এরা হাতিয়ার হিসেবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।

‘দ্য প্রিন্স’ বই যারা পড়েছেন তাদেরকে এই বৈশিষ্ট্যর ব্যাখ্যা না দিলেও চলে। ম্যাকিয়াভেলিয়ানরা প্রভাব বিস্তার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পরিবারে কোনো অনুষ্ঠান হলে তার মনমর্জি মতন হতে হবে, কোনো সংগঠনে থাকলে সেখানেও যা ঘটবে তার মনমর্জি মতন হতে হবে আর রাষ্ট্রের নায়ক হলে তো হয়েছে! হিটলারের বাপ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কোনো বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট ভালো হলেও ওদের মত না হলে তা ঠিক হলো না, চলে না, গেল না, মানালো না, মানি না… ইত্যাদি এদের মনে চলতেই থাকে।

বিজ্ঞাপন

কারণ অন্যের সিদ্ধান্তে চলা যেকোনো ঘটনার মধ্যে এরা নিজের প্রভাব হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন। অথচ, নিজের বাজে সিদ্ধান্তের মধ্যে এরা সন্তুষ্টি খুঁজে পান চাই তার ‘Consequence’ যা-ই হোক না কেন! সম্পর্কের ক্ষেত্রে পার্টনারকে কমবেশি আমরা সবাই নিজের মত করে রাখতে চাই, কিছু আপোষ করি, কিছু মেনে নিই আর কিছু ছেড়ে দিই। এরা বন্ধুত্ব বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদের মত সব হতে হবে বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং আপোষহীন। সবার উপর (পার্টনার, পরিবার, আত্বীয়-স্বজন, কর্মক্ষেত্র) নিজের মতামত আপোষহীন ভাবে চাপিয়ে দেওয়া-ই এদের মূখ্য উদ্দেশ্য।

এদের শব্দভান্ডারে ‘নীতি-নৈতিকতা’ বলে কিছুই নাই। নিজের স্বার্থের জন্য যেখানে যে পরিমাণ নীতি বিবর্জিত হতে হয় এরা সেটাই করবে। নীতি-নৈতিকতা এবং ফতোয়া বা আইন-কানুনের প্রশ্নে এরা এত উদাসীন যে নিজের লক্ষ্যের ক্ষেত্রে এসবকে এরা মোটেই পাত্তা দেয় না। শুধু তাই নয়, অভিনয়েও এরা ভালো পারদর্শী। এরা জানে মানুষকে কীভাবে আবেগী করে তুলতে হয়। কখনো হাসে তো কখনো কাঁদে; ধরার কোনো উপায় নাই। কিন্তু মানুষ এই মায়া কান্না দেখে বিশ্বাস করে ও আবেগী হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে তিনি যা চাইছেন সেটাই করতে বাধ্য হোন। কিন্তু এই হাসি বা এই কান্না ছিলো সবটুকুই মিথ্যা।

প্রভাব বিস্তার, লক্ষ্য অর্জন বা স্বার্থে পৌঁছার ক্ষেত্রে সড়কের মাঝ রাস্তায় ন্যাংটো হয়ে নাচতেও রাজী, মিথ্যে হাসি দিয়ে ভুলাতেও রাজী, মিথ্যা কান্না দিয়ে উদ্দেশ্যে হাসিলে আপোষহীন।

সাইকোপ্যাথি (Psychopathy)

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাইকোপ্যাথি (Psychopathy)। আমরা কথায় কথায় মজা করে বলি, “এই তুমি সাইকোপ্যাথ নাকি!” শব্দটা পরিচিত হলেও ডার্ক ট্রায়াডের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের ব্যক্তিত্ব ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে গা শিউরে উঠবে। এদের মধ্যে সহানুভূতির অভাব দেখা যায়। আপনার যত্নের বাগানের কোন ফুলের গাছ নষ্ট করা, পোষা বিড়ালকে মেরে ফেলা, নতুন ল্যাপটপের স্ক্রিনে ক্র্যাচ ফেলা, নতুন গাড়ি (বাইক/কার) চাকা ফুটো করে দেওয়া ইত্যাদি। এখন আপনি যদি এদেরকে বলেন, “কেন?” তাহলে খুব সম্ভবত অদ্ভুত সব উত্তর পাবেন।

আরো একটি বিষয় হচ্ছে, এদের মধ্যে অপরাধবোধ থাকে না। আপনার ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করা থেকে শুরু করে আপনাকে মেরে ফেলা পর্যন্ত এদের কোনোভাবে অপরাধবোধ কাজ করে না। এরা মনে করে, এসব কর্মকাণ্ড খুবই স্বাভাবিক বা তাদের অধিকার বা প্রয়োজনীয় যুক্তি আছে এসব করবার।

বিশ্ববিখ্যাত সাইকোপ্যাথিক মানুষদের তালিকা

১. টেড বান্ডি ২. জন ওয়েন গ্যাসি ৩. রিচার্ড রামিরেজ ৪. রবার্ট পিকটন ৫. ডেভিড বারকোভিটজ

এদের সম্পর্কে একটু গুগল সার্চ দিয়ে নেবেন। ঠান্ডা মাথায় এত এত মানুষকে খুন ও ধর্ষণ করে হত্যা করেছেন এবং এতে এদের কোনো অপরাধবোধ পাওয়া যায় নাই। হ্যাঁ, সাইকোপ্যাথ কাউকে বলার আগে এখন থেকে একটু ভাববেন। কারণ এই শব্দটি খুব বেশি সুবিধার নয়। এছাড়াও এরা এমন কিছু কাজ করে যার মধ্যে সেন্স খুঁজে পাবেন না।

অযাচিত ঝুঁকি নেওয়া, অকারণে মিথ্যা বলা, হঠাৎ করে আক্রমণাত্মক বা সহিংস হয়ে ওঠা ইত্যাদি। আবার কাউকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু কেন ঠকাচ্ছে? তার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ আছে দেখবেন, ওর কাজ যেটা সেটা ঠিকভাবে করেও নাই এবং এই নিয়ে অপরাধবোধও নাই। এই তো সেদিনের কথা, এক লোক সকালবেলা চায়ের দোকানে আমার সামনে বলছে তিনি তার বউকে কীভাবে পেটান! শুধু তাই নয়, বউকে পেটানোর সুফল সম্পর্কে সকলকে জ্ঞাত করছেন! ননসেন্স।

ডার্ক ট্রায়াডের প্রভাব

উপরোক্ত ৩টি বৈশিষ্ট্য যুক্ত করুন এবার ভাবুন এমন একজন মানুষ ঠিক কেমন হতে পারে? টক্সিক… টক্সিক… টক্সিক… করে কাউকে ট্যাগ করার পূর্বে অন্তত আমরা নিজেই টক্সিক কিনা তা জানা এবং বুঝা জরুরি। তবে একটা কথা সত্যি, আপনি মানসিকভাবে যত বেশি ডিস্টার্ব তত বেশি সৃজনশীল হতে পারবেন। খুব আরামপ্রিয় জীবন আমাদের ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাহিত্যিক হয়তো বানায় না। মানুষের মন ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে কিছুটা হলেও নিজেরও কিছু অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি হয়ে পড়ে। শরীরের মত করে মনও ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে কখনো কখনো মানসিকভাবে ডিস্টার্ব হওয়া জরুরি হতে পারে।

ডার্ক ট্রায়াড থেকে সাবধান থাকার উপায়

ডার্ক ট্রায়াডের ব্যক্তিদের থেকে সাবধান থাকার জন্য কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:

১. সীমা নির্ধারণ করুন: আপনার ব্যক্তিগত সীমা নির্ধারণ করুন এবং তা মেনে চলুন। এদের সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে আপনার সীমা অতিক্রম করতে দেবেন না।

২. আত্মবিশ্বাস বজায় রাখুন: নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন এবং এদের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। এদের কথায় প্রভাবিত না হয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকুন।

৩. সাহায্য নিন: যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। তারা আপনাকে এদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করতে পারবেন।

৪. সচেতন থাকুন: এদের আচরণ সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং এদের কৌশল বুঝে নিন। এদের মিথ্যা এবং প্রতারণামূলক আচরণ থেকে সাবধান থাকুন।

উপসংহার

ডার্ক ট্রায়াডের ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা এবং এদের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের আচরণ এবং কৌশল সম্পর্কে সচেতন থাকলে আমরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি। আজকের এই প্রবন্ধ আপনাদের উপকারে কিছুটা হলেও লাগবে। কোনোপ্রকার ভুল থাকলে মন্তব্যে সেটা তুলে ধরতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button