অতীশ দীপংকরের তিব্বত যাত্রা: ঐতিহাসিক সত্য বনাম সাহিত্যিক কল্পনা
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে অতীশের চরিত্রের পরিবর্তন ও তার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পর জনপ্রিয়তায় এক ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ সাহিত্যিক হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বজায় রেখেও একটি অভিযোগ তোলা যায়, যা হলো এক অসামান্য প্রজ্ঞাবান মানুষের চরিত্র হনন।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু
‘তুমি সন্ধার মেঘমালা’ উপন্যাসে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় অতীশ দীপংকরের কাহিনী গড়েছেন। সূত্র হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)’ এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলার ইতিহাস (প্রথম ভাগ)’। এই দুই বই ও আরও নানান সূত্রাবলী হতে তিনি সংগ্রহ করেন ‘অতীশ’ চরিত্র।
অতীশ দীপংকরের তিব্বত যাত্রা
অতীশ দীপংকরের তিব্বত যাত্রা ও না যাত্রার দ্বিধার বিষয়টি ঐতিহাসিকদের অনুসরণ করে আবার খানিক নিজের যুক্তি দিয়ে বানিয়েছেন শরদিন্দু। শরদিন্দুর ডিটেকটিভ মনোভঙ্গীতে তৈরী করা যুক্তিতর্কের অতীশ দীপংকরের বিবরণে চলুন যাওয়া যাক।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে বর্বর যবন উপদ্রব দেখে বিক্রমশীলা মহাবিহারের বৌদ্ধ শ্রমণরা চিন্তিত ছিলেন। কিছুতেই সেই দুর্দান্ত শত্রুকে প্রতিহত করার উপায় দেখছিলেন না তাঁরা। স্বয়ং অতীশ দীপঙ্কর এই নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন ছিলেন। এমন সময় আসে তিব্বতের আমন্ত্রণ।
তিব্বতের আমন্ত্রণ
তিব্বতের দূত বিনয়ধর (তীব্বতী নাম থ্রিম-গ্যালবা) এসেছেন তিব্বত রাজের আমন্ত্রণসহ। এর আগেও একবার আমন্ত্রণ এসেছিলো, তখন অতীশ রাজি হননি। এবারেও রাজি হবে কি না এ বিষয়ে বিনয়ধর যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিহারের প্রধান পরিচালক আচার্য রত্নাকরও অতীশকে যেতে দিতে অরাজি ছিলেন। তবু শেষে গিয়েছিলেন অতীশ তিব্বতে।
অতীশের তিব্বত যাত্রার কারণ
শরদিন্দুর উপন্যাসে অতীশের তিব্বত যাত্রার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে যে, তিনি বোমা বানানোর বিদ্যা আয়ত্ত করতে তিব্বত গিয়েছিলেন। কিন্তু অলকা চট্টোপাধ্যায়ের মতে, অতীশ তিব্বতের সদ্যমৃত রাজার কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মকে কলুষমুক্ত করার ব্রত নিয়ে তিব্বত গমন করেন।
ঐতিহাসিক তথ্যের বিশ্লেষণ
অলকা চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম কোণে মুসলমান আক্রমণকারীদের ভয়ে অতীশ দ্রুত তিব্বতে চলে যান এমন একটি উড়ো খবরের কোন ভিত্তি নেই। কারণ এই আগ্রাসনের কাহিনী অতীশের তিব্বতে যাওয়ার শতাধিক বছর পরের কথা। শরদিন্দু অতীশ দীপংকরের চরিত্রে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন যা ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে বেমানান।
অতীশের তিব্বত যাত্রার প্রভাব
অতীশ দীপংকরকে সব পন্ডিতই জ্ঞান ও প্রেমের সাধক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি করুনাদ্র হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। শরদিন্দু তাঁকে সুযোগসন্ধানী যোদ্ধা রূপে এঁকেছেন যা ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে, শরদিন্দুর উপন্যাসে অতীশের চরিত্রের পরিবর্তন ঐতিহাসিক সত্যের সাথে মেলে না।
উপসংহার
অতীশ দীপংকরকে সব পন্ডিতই জ্ঞান ও প্রেমের সাধক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি করুনাদ্র হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। শরদিন্দু তাঁকে সুযোগসন্ধানী যোদ্ধা রূপে এঁকেছেন যা ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে, শরদিন্দুর উপন্যাসে অতীশের চরিত্রের পরিবর্তন ঐতিহাসিক সত্যের সাথে মেলে না।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | শরদিন্দুর উপন্যাস | ঐতিহাসিক তথ্য |
---|---|---|
তিব্বত যাত্রার কারণ | বোমা বানানোর বিদ্যা আয়ত্ত করা | বৌদ্ধ ধর্মকে কলুষমুক্ত করা |
তিব্বতে থাকার মেয়াদ | এক বছর | তিন বছর |
যবন আক্রমণ | তিব্বতে যাওয়ার কারণ | তিব্বতে যাওয়ার শতাধিক বছর পর |