বিশেষ প্রতিবেদন

করোনার প্রভাব ও বেকারত্ব: বর্তমান পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায়

কিভাবে করোনা মহামারী বেকারত্ব বাড়িয়েছে এবং এর সমাধানে করণীয় পদক্ষেপ

করোনার প্রভাব ও বেকারত্ব

করোনা নামক অদৃশ্য এক ভাইরাস পৃথিবীর সব মানুষকে চরমভাবে গৃহবন্দি করে। মানুষের জীবনযাপনে বিশাল পরিবর্তন এনে দেয়। বাণিজ্য, চাকরি, চিকিৎসা সব খাতে অস্বাভাবিকভাবে ধ্বংস নামতে শুরু করে। এসময় বিশ্বব্যাপী বড় বড় কোম্পানীগুলো লস কমাতে কর্মী ছাটাই শুরু করে।

এতে বিশ্বায়নের এ যুগে অসংখ্য নতুন বেকার গোষ্ঠী তৈরি হয়। বর্তমানে করোনার প্রভাব আগের চেয়ে অনেকটা কমিয়ে গেলেও চাকরির বাজার সেভাবে স্থিতিশীল হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় বেকার তালিকা আগের চেয়ে কয়েকগুণ ভারী হয়েছে।

এছাড়া মোদ্দা কারণ হিসেবে জব মার্কেট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছেই। এটি বর্তমানের তথ্য-প্রযুক্তির যুগের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। অন্যদিকে পড়াশোনা, চিন্তা ও সৃজনশীলতা, টেকনিক্যাল বা মেকানিক্যাল স্কিলফুল হওয়া সব কিছু এক নয়।

সবগুলোর ক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন তাই একটির সাথে আরেকটির তুলনা করা সেভাবে কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে যেকোনো ভাবে শিক্ষিত বেকার হওয়ার জ্যামিতিক সমীকরণ না থামাতে পারলে সার্বিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবো।

ফলে অতি দ্রুত এই সেক্টরে জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। এছাড়া এমন হওয়ার কারণ ও সংকট উত্তরণের বিষয়ে আজকের আলাপ।

বেকারের সংখ্যা

দেশে শিক্ষার হার আগের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে। এটি যেমন আনন্দের খবর তেমনি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি আরো বেশি দুঃখের। দেশের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, ১৫ বছরের উর্ধ্বে যারা কোনো কাজ করে না বা করতে পারছে না তারা হলো বেকার।

এ অনুসারে দেশে বেকারের সংখ্যা হলো ৩ কোটি। করোনার আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ, এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে ১০ গুণ। করোনা শুরুর তিন-চার মাসে ব্যাপকভাবে বেকারত্ব বেড়েছিল।

অন্যদিকে করোনাসহ নানা কারণে গত তিন বছরে সেভাবে কোনো জরিপ হয়নি। এর আগে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরপর দুই বছর ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ করা হয়েছিল। সেই জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ।

আর তাদের মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। শতাংশ হিসাবে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ২০২০ সালের মার্চের শেষ দিক থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে গেলে বহু মানুষ কাজ হারান। তারপরেও সরকারি হিসাবে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখই থাকবে। অন্যদিকে ২০২০ সাল থেকে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে।

লন্ডনভিত্তিক একটি সংস্থার জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভূক্ত। ফলে বিশ্বের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম।

বিজ্ঞাপন

দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। করোনার জন্য এই সংখ্যায় পৌঁছাতে হয়ত কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে না।

স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার প্রায় ৩৭ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা তরুণ-তরুণীর মধ্যে বেকারের হার যথাক্রমে ২৭ ও ২৮ শতাংশ।

বেকারত্বের মূল কারণ

বর্তমানে উচ্চশিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছেছে ফলে বেকার তৈরি হচ্ছে। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদি এর কারণও বেশ উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে আরেকটি মূল কারণ হলো চাকরির বাজারে যে ধরনের দক্ষতা ও চাহিদা সম্পন্ন মানব সম্পদ দরকার সেটির সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় নেই। আবার তারা যেসব স্কিল নিয়ে চাকরির বাজারে আসতে চাইছে সে অনুসারে চাকরির সংখ্যা অতি নগণ্য।

এছাড়া গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১০ বছর আগেও বছরে ২ থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। এই অনুপাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ফলে বিশাল সংখ্যক গ্রাজুয়েটরা বেকার থেকে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয় একটি কারণ হলো দেশের যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে সেদিক শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ কম। কারণ দেশের আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে শিক্ষিত তরুণরা মার্জিত কাজ করতে চায়। অন্যদিকে দেশের কৃষিখাতে কিছুটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও এদিক কাজ করতে আগ্রহী কম।

এছাড়া দেশে যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি সেটি করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন মানবসম্পদ তৈরি হওয়ার কথা সেটিও হচ্ছে না। আবার এখানে এসে অনেকে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে ফলে নানা ভাবে গ্রাজুয়েট হওয়ার প্রক্রিয়া ও পরবর্তী কার্যক্রমগুলো প্রতিনিয়ত জটিল হয়ে যাচ্ছে।

সংকট উত্তরণের উপায়

“শিক্ষা একটি জাতির মেরুদন্ড” এটি একটি ধ্রুব সত্য কথা। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এটি বিপরীতভাবে কাজ করে। কারণ দেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো হুরহুর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যেটি হওয়ার কথা ছিল সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত গবেষক ও চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করা।

এই আদর্শ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরে এসেছে অনেক আগে থেকে। বর্তমানে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। একটি জাতির জন্য এত বেশি সংখ্যক চিন্তাশীল মানুষের প্রয়োজনীয়তা নেই।

আবার আসলেই যে চিন্তাশীল ও গবেষক মানুষ তৈরি হচ্ছে সেটিও নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই আদর্শ থেকেই সরে যাচ্ছে। এসব থেকে উত্তরণের জন্য কলা, ব্যবসা প্রশাসন ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের যেকোনো একটি কারিগরি বিষয়ে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

এছাড়া প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট দিতে পারে, সবাই নির্দিষ্টসংখ্যক ‘ফ্রেশ’ গ্র্যাজুয়েটকে প্রতিবছর তিন থেকে ছয় মাসের জন্য ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দেবে। অন্যদিকে শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, কারিগরি দক্ষতা বা ভাষাগত যোগাযোগে পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

তথ্যবহুল টেবিল

বিষয় সংখ্যা শতাংশ
মোট বেকার ৩ কোটি ৩৯.৪০%
স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার ৩৭% ৩৭%
স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ৩৪% ৩৪%
মাধ্যমিক পাস বেকার ২৭% ২৭%
উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকার ২৮% ২৮%

উপসংহার

বর্তমান যুগে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনার প্রভাব এবং উচ্চশিক্ষার মানহীনতা এই সমস্যাকে আরো প্রকট করেছে। বেকারত্বের হার কমাতে হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং চাকরির বাজারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে এই সংকট উত্তরণ সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।

ছবি: Image by freepik

আব্দুস সবুর (লোটাস)

My name is Abdus Sabur Lotus. I am a sub-editor at ovizatri.com and a co-founder of this online news and magazine portal. I have worked as a journalist for various Bangladeshi news portals and agencies, both online and offline. I contribute to Haal Fashion and previously served as the Rajshahi University Correspondent for Kalbela. I was also the General Secretary of the Rajshahi University Journalists' Association. I graduated with a degree in Journalism from Rajshahi University. Stay updated with ovizatri.com.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button