ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার: আবেগ নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার এর লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
প্রতিদিনের মতো আজও নতুন একটি মানসিক সমস্যা সম্পর্কে কথা বলবো। যেগুলো সম্পর্কে অনেকেই আমরা অবগত নই। আমাদের আজকের বিষয় ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse-Control Disorder)। চলুন জেনে আসা যাক এই রোগের লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে।
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse-Control Disorder) কি?
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse-Control Disorder) বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ ব্যাধি হল এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তির আবেগ বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয়। প্রায় সময়ই এই আচরণগুলি অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে থাকে বা সামাজিক নিয়ম এবং আইনের সাথে সংঘর্ষ লেগে যায়।
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse-Control Disorder) বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ ব্যাধি সাধারণত শৈশব বা কৈশোরে বেশি দেখা দেয়। এই ব্যাধিগুলোতে মহিলাদের তুলনায় পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং সাধারণত অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বা পদার্থের অপব্যবহারের জন্যও এই রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিজঅর্ডার অর্থাৎ DSM-IV এর চতুর্থ সংস্করণের তথ্য অনুসারে অনুমান করা হয় সাধারণ জনসংখ্যার প্রায় ১০.৫% মানুষ এই ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse-Control Disorder) এর প্রকারভেদ
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার (Impulse-Control Disorder) এর কিছু ধরণ আছে। আর এই ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডারগুলির মধ্যে রয়েছে অপজিশনাল ডিফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার (Oppositional Defiant Disorder), ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিজঅর্ডার (Intermittent Explosive Disorder), কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার (Conduct Disorder), ক্লেপ্টোম্যানিয়া (Kleptomania) এবং পাইরোম্যানিয়া (Pyromania)।
ক. অপশনাল ডিফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার
অপশনাল ডিফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার যাকে সংক্ষেপে ODD বলা হয়। অর্থাৎ এটি শৈশবের বিভিন্ন আচরণ থেকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের মেজাজ হারিয়ে ফেলেন, অকারণেই বিরক্ত এবং রাগান্বিত হন।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্য লোকেদের বিরক্ত করে এবং তাদের সমস্যার জন্য অন্যদেরকে দোষারোপ করে থাকে। এই আচরণের জন্য তারা তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং সামাজিকভাবে বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন।
দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ থেকে ১১% শিশুর মধ্যে এই ব্যাধি রয়েছে। আর এটি মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ODD বা অপশনাল ডিফিয়েন্ট ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত ৫-১০ বছর বয়সের মধ্যে তাদের লক্ষণগুলি অনুভব করতে শুরু করে।
আর এই লক্ষণগুলো বয়স বাড়ার সাথে সাথে চলে যেতে পারে।
অপশনাল ডিফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার বা ODD এর লক্ষণ
১. কোনো বিষয়ে অসম্মত এবং বিঘ্নিত ঘটানো
২. খিটখিটে এবং প্রতিবাদমূলক আচরণ
৩. অবাধ্য আচরণ
খ. ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিজঅর্ডার (IED)
এই ব্যধিটি আইইডি নামেও পরিচিত। ক্রমাগত আবেগপ্রবণ এবং রাগান্বিত আগ্রাসনের দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এই ব্যাধিকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানুষ, প্রাণী বা সম্পত্তির প্রতি হিংস্র বা আক্রমণাত্মক হতে পারে।
এই রাগের স্থায়িত্ব প্রায় আধা ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি সাধারণত পরিচিত ব্যক্তির সাথে বেশি হয়ে থাকে। আর এর ফলে আইনি বা আর্থিক সমস্যাও হতে পারে সেই ব্যক্তির। এটি নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রণার কারণ এবং সাধারণ কাজের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিজঅর্ডার বা IED এর লক্ষণ
১. সহজে হতাশ হয়ে যাওয়া।
২. অতিরিক্ত মাত্রায় রাগ যার ফলে শরীরে আঘাত বা ক্ষতি হতে পারে।
গ. কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার (CD)
কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার হল ক্রমাগত এমন আচরণ যা সামাজিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন নিয়ম লঙ্ঘন করা। যেমন; পালিয়ে যাওয়া বা স্কুলকে এড়িয়ে যাওয়া। এই আচরণের জন্য স্কুলে বা সামাজিকভাবে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি শৈশবেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সীদের সাধারণত এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার (CD) এর লক্ষণ
১. সম্পত্তি ধ্বংস করা।
২. মানুষের কাছে মিথ্যা বলা।
৩. অবৈধ বা অপরাধমূলক কার্যকলাপ করা।
ঘ. ক্লেপটোম্যানিয়া
প্রয়োজন নেই এমন জিনিসের প্রতি আবেগপ্রবণ হওয়া, অপ্রয়োজনীয় জিনিস চুরি করাকে ক্লেপ্টোম্যানিয়া ব্যধি বলা হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চুরি করে সেগুলো অন্য লোকেদের দেয় নয়তো ফেলে দেয়।
এই রোগটির জন্য ব্যক্তি চুরি করতে বাধ্য থাকে অর্থাৎ এই বাধ্যতার উপর রোগীর কোনো আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি চুরি করার পরে ব্যক্তিরা স্বস্তি বা তৃপ্তির অনুভূতি অনুভব করে থাকে। সাধারণ জনগণের মধ্যে ০.৩% থেকে ০.৬% মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ক্লেপটোম্যানিয়া এর লক্ষণ
১. প্রয়োজন নেই এমন জিনিসপত্র চুরি করা।
২. চুরি করার জন্য বাধ্যতা বোধ করা।
৩. চুরি করার পরে স্বস্তির অনুভূতি অনুভব করা।
৪. এবং পরবর্তী সময়ে অপরাধবোধ বা বিষণ্ণবোধ হওয়া।
ঙ. পাইরোম্যানিয়া
যে ব্যক্তি বারবার এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন দেয় সেই ব্যক্তিকে ধরা হয় সে পাইরোম্যানিয়ায় আক্রান্ত। অপ্রয়োজনে আগুন জ্বালানো এবং তা করার পর স্বস্তি বা আনন্দ অনুভূত হওয়া এই ব্যাধির লক্ষণ। ব্যক্তিরা তাদের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা দূর করার জন্য বাধ্য হয়ে আগুন দেয় এছাড়া তারা অন্য কোন কারণে আগুন দেয় না।
আর এই পাইরোম্যানিয়া তুলনামূলকভাবে বিরল একটি ব্যাধি। জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৩% মানুষ আছে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগায়।
পাইরোম্যানিয়া এর লক্ষণ
১. আগুন লাগানোর ঠিক আগে উত্তেজিত হওয়া।
২. আগুন লাগাতে বাধ্যতাবোধ অনুভব করা।
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার এর কারণ
“Impulse control disorder” বা বেগ নিয়ন্ত্রণ ব্যাধির জন্য কোন একক কারণ নেই। এটি স্বভাবগত, শারীরবৃত্তীয়, পরিবেশগত এবং জেনেটিক কারণগুলির যেকোনো কারণে হতে পারে। এছাড়াও জানা যায় এলকোহল ব্যবহারের ফলেও মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার এর চিকিৎসা
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার এর চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলো আবাসিক সিস্টেমে হতে পারে। এখানে ব্যক্তি বা বহিরাগত কোনো রোগী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসবেন এবং দিনের কিছু অংশের জন্য সেই চিকিৎসায় অংশ গ্রহণ করবে। এরপর রাতে বাড়িতে চলে যাবে।
এই আবাসিক প্রোগ্রামগুলি বেশিরভাগই ব্যক্তিগত এবং গ্রুপ থেরাপি। এগুলো আর্ট থেরাপি বা মেডিটেশন, এবং কিছু মিটিং নিয়ে গঠিত হয়। এখানে রোগীরা একসঙ্গে সকল ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করে থাকে।
ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার এবং ড্রাগ বা অ্যালকোহলে আসক্তি এর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন থেরাপির ব্যবহার করা যেতে পারে।
১. জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি
এই থেরাপির একটি বহুল ব্যবহৃত রূপ হল ব্যক্তিদের সম্ভাব্য ক্ষতিকারক চিন্তার ধরণ এবং আচরণগুলিকে কীভাবে পরিবর্তন করতে হয় তা শিখতে সাহায্য করে।
২. দ্বান্দ্বিক আচরণ থেরাপি
এই থেরাপি মানুষকে আত্ম-ক্ষতিমূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যেমন; আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, চিন্তাভাবনা বা তাগিদ, সেইসাথে ড্রাগ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে।
পরিশেষ
“Impulse control disorder” বা বেগ নিয়ন্ত্রণ ব্যাধি গুলোর লক্ষণ অন্যান্য ব্যক্তির চেয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিই বেশি ভালো বুঝতে পারে। তাই কখনো এমন কিছু অনুভূত হলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এতে নিজে এবং নিজের চারপাশের মানুষদের ভালো রাখা সম্ভব।
আজ এই পর্যন্ত। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ