ব্যবসা ও বাণিজ্য

সিটিসেল: বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল অপারেটরের উত্থান ও পতন

সিটিসেলের ইতিহাস, সাফল্য এবং পতনের কারণ

এখনো অনেকেরই মনের কোটরে সিটিসেলের দৃষ্টিনন্দন বিজ্ঞাপন গুলো দাগ কেটে রয়েছে। ২০১১ সালেও এই সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ লক্ষ। তখনও তেমনভাবে মোবাইল ফোনের প্রচলন হয়নি।

সিটিসেল (Citycell) কোম্পানির ইতিহাস

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর হিসেবে সিটিসেলের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এটি প্রথমে বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড এবং পরবর্তীতে তা প্যাসিফিক বাংলাদেশ লিমিটেড পরিবর্তিত হয়ে সিঙ্গাপুরের সিংটেল এর সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ করে। এজন্য সিটিসেল কে বাংলাদেশের প্রথম সিডিএমএ মোবাইল অপারেটর বলা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম মোবাইল ফোন অপারেটর তিনটির একটি হচ্ছে এই সিটিসেল। ২০১১ সালের আগস্ট এর হিসাব অনুযায়ী সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষেরও বেশি। সিটিসেলের ৪৫% ছিলো সিংটেল-এর মালিকানায় এবং ৫৫% ছিলো প্যাসিফিক গ্রুপ ও ফার ইস্ট টেলিকমের মালিকানায়।

২০০৭ সালের শেষের দিকে নতুন লোগো উন্মোচন করে সিটিসেল। এর গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে এটি ছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মোবাইল অপারেটর কোম্পানি। আর এই সিটিসেল এর নাম্বার শুরু হয় ‘০১১’ দিয়ে।

শুরুতে সিটিসেল তার গ্রাহকদের জন্য পোষ্টপেইড সেবা চালু করেছিল। পরবর্তীতে তাঁরা প্রি-পেইড সেবাও চালু করে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে। কিন্তু শুরুর দিকে এই সিটিসেল এর কল রেট ছিল অনেক। যা সাধারণ জনগণের জন্য ছিলো প্রায় আকাশ ছোঁয়ার মতো।

এই সিটিসেলের কলরেট যেকোনো লোকাল নাম্বারে ১ মিনিট কথা বললে ১০ টাকা কেটে নেওয়া হতো। শুধু তাই নয় যে কল রিসিভ করার জন্যও তারা টাকা কেটে নিত। এই রিসিভিং কলের জন্য প্রতি মিনিটে ৮ টাকা কেটে নেওয়া হত।

সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য অনেক মোবাইল কোম্পানিগুলোর আবির্ভাব হতে লাগলো। সেগুলোর সুযোগ-সুবিধা গুলোর জন্য সিটিসেল কোম্পানি মার্কেট ডাউন হতে থাকলো। কারণ সিটিসেলে গ্রাহকরা তাদের ফোনে কেবলমাত্র সিটিসেল সিমই চালু রাখার নিয়ম ছিলো। অন্যান্য সিম এর কোনো সুযোগ সুবিধা ছিলো না। কিন্তু অন্যান্য নতুন মোবাইল কোম্পানিগুলোতে অন্যান্য সিম ব্যবহারের সুযোগ ছিলো।

কিন্তু সিটিসেল কোম্পানিও থেমে থাকেনি। তারাও নতুন নতুন মোবাইল ফোন, এবং আকর্ষণীয় প্রিপেইড অফার এর মাধ্যমে তাদের বাজার ধরে রেখেছিল। সিটিসেলও এগিয়ে যাচ্ছিলো সকল মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সাথে তাল মিলিয়ে।

আর এই সকল সুবিধাগুলো দেওয়ার কারণেই ২০১১ সালে সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে যায়। এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২০ লক্ষেরও বেশি।

২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর বিটিআরসি কোম্পানিটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এ সময় এর গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ লাখের কিছু বেশি। ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিটিসেলের তরঙ্গ আবার খুলে দেওয়া হয়। যা ৬ নভেম্বর আবার বন্ধ করা হয়।

সিটিসেল (Citycell) কোম্পানির পতন

সিটিসেল কোম্পানি ২০১১ সাল পর্যন্তও ঠিকঠাক ছিলো। তবে ২০১১ সালে অন্যান্য মোবাইল অপারেটর জিএসএম টেকনোলজির দিকে ধাবিত হয়েছিলো। ফলে এগুলোর সুযোগ সুবিধাগুলো আরও বেড়ে যায়। কিন্তু সিটিসেল তখনো সিডিএম সিস্টেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যা ছিলো তাদের গ্রাহক কমে যাওয়ার একটি কারণ।

যদিও একটি মোবাইল কোম্পানি সিটিসেল কোম্পানিকে জিএসএম টেকনোলজী ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করেছিল। তবুও তারা কোনো কারন বশত পেছনেই থেকে যায়। পরবর্তীতে যখন দেশে থ্রিজি সিস্টেম আসে তখন সিটিসেল এই জিএসএম টেকনোলজি ব্যবহার করার অনুমতি পায়। ততদিনে ধীরে ধীরে সিটিসেল গ্রাহকেরা এর ব্যবহার কমিয়ে দিতে থাকে।

আর দিনে দিনে তাদের এই গ্রাহক সংখ্যা কমতেই থাকে। এবং এক পর্যায় সিটিসেল গ্রাহক সংখ্যা শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে দেখা যায় সিটিসেলের এই গ্রাহক সংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে নেমে গিয়ে দাড়ায় মাত্র পাঁচ লক্ষে।

সিটিসেলের ঋণের পরিমাণ ছিলো অনেক বেশি। প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণই ছিলো বিটিআরসির কাছে। এছাড়াও সিটিসেলের আরো শতকোটি টাকা ঋণী ছিল বিদ্যুৎ বিল সহ দেশের অন্যান্য ব্যাংকের কাছে।

তবে সিটিসেল কোম্পানির এই ধসের কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় সিটিসেলের সকল কর্মকর্তাদের। বিশিষ্ট তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের খামখেয়ালি এবং সনাতন পদ্ধতিতে কোম্পানিটি চালানোর জন্যই এই সিটিসেল কোম্পানির এত বড় ধস নেমেছে।

পরিশেষ

এই ছিলো বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল কোম্পানি সিটিসেলের উত্থান পতনের ইতিহাস। যা থেকে এটাই শিক্ষা দেয় যে, সময়ের কাজ সময়েই করা উচিত। অর্থাৎ সব সময় সময়ের সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে হয়। নয়তো কথায় বলে, “সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়।”

তাই সময়কে কখনোই অবজ্ঞা করতে নেই। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনটাকেও গ্রহণ করে সামনে এগুনোই বুদ্ধিমানের কাজ।

আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button