সম্পাদকীয়

আমরা কেন হলিউড সিনেমা/সিরিজের সাথে নিজেদের খুঁজে পাই না?

হলিউড সিনেমা/সিরিজ আমাদের বাস্তবতা থেকে দূরে রাখে কীভাবে এবং আমাদের জন্য একটি ফ্যান্টাসি কিংডম কেন?

আমরা কেন হলিউড সিনেমা/সিরিজের সাথে নিজেদের খুঁজে পাই না? হলিউড সিনেমা/সিরিজ আমাদের বাস্তবতা থেকে দূরে রাখে কীভাবে? হলিউড সিনেমা/সিরিজ আমাদের জন্য একটি ফ্যান্টাসি কিংডম কেন?

আমি এখানে হলিউড বলতে ‘পশ্চিমা’ সিনেমা ও সিরিজ কে উদ্দেশ্য করে বলছি। পশ্চিমা সিনেমা ও সিরিজ নিয়ে আমাদের মধ্যে যে আগ্রহ সেটা অনেক পুরনো। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও আমরা পশ্চিমা সিনেমা ও সিরিজ তুলনামূলক বেশি দেখে থাকি। শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের এশিয়ান সিনেমা ও সিরিজের সাথে পশ্চিমা সিনেমা সিরিজের সার্বক্ষণিক মিল খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। পুনরায়, ‘পশ্চিমা’ শব্দটিও কিন্তু ভৌগোলিক এলাকা নয়, এটা একটি দর্শন।

দর্শক যখন একটি হলিউডের সিনেমা বা সিরিজ দেখা শুরু করেন তখন তার পর্দায় ভেসে ওঠে বেশ কিছু বাড়ি। কিন্তু এই বাড়িগুলো আমাদের বাড়ির মত নয়। আমাদের বাড়ির মত না হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু এই বাড়িগুলোর মাঝের দুরত্ব অনেক বেশি। মানে একটা বাড়ির পর সুনির্দিষ্ট দুরত্বে আরেকটি বাড়ি খুঁজে পাবেন।

বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,১১৯ জন মানুষ বসবাস করেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ৩৩ জন মানুষ বসবাস করেন। সুতরাং পশ্চিমা কোন সিনেমা বা সিরিজ খুলতেই যে দৃশ্য আমরা সামনে দেখি সেটা আমাদের বাস্তবতা নয়।

আবার যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০২৩ সালে আনুমানিক ৭৫,০০০ মার্কিন ডলার ছিলো। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ২,৭৩৮ মার্কিন ডলার। মানে হলো যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে ২৭.৪ গুণ বেশি। এছাড়াও আমাদের মাথাপিছু আয় বেশি হবার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গুটিকয়েক মানুষের অর্থনীতি বুঝায়।

মানে হলো উপরের দিক থেকে ১০০-৫০০ জন ধনীর টাকা এখান থেকে বাদ দিয়ে হিসেব করলে মাথাপিছু আয় আরো অনেক কমবে। এই ২৭ গুণ বেশি আয় নিয়ে একজন মানুষের লাইফস্টাইল আলাদা হতে বাধ্য। এখানেও আমরা বাংলাদেশী হিসেবে নিজেদের সাথে ঐ সিনেমা বা সিরিজের মিল কোনোভাবেই খুঁজে পাবো না।

বুঝার সুবিধার্থে, মি. করিম সকালে উঠে টিউবওয়েল থেকে জল তুলে গোসল করেন। এরপর তার স্ত্রীর রান্না করা এক প্লেট খিচুড়ি খেয়ে অফিসের দিকে রওনা হোন। পথিমধ্যে একটি সিএনজি নেন। ট্যাক্সি-ম্যাক্সি এখানে পাওয়া যায় না। তারপর সিএনজির মোড় ঘুরানোর আগে তওবা পড়ে রাখা জরুরী। কখনো কখনো রাস্তায় ব্যাপক যানজটে পড়তে হয়। দুপুরের খাবারে তিনি তার চাকুরীর বেতন অনুযায়ী বাইরে খাবার খান নতুবা স্ত্রীর দেওয়া টিফিন বক্স থেকে খাবার সেরে নেন।

গড় ৮-১০ ঘন্টা কাজ শেষে ক্লান্ত করিম সাহেব ঘরে ফেরেন। ঘরে ফিরে দেখেন চোখে অনেক ঘুম। এখনো বাকি কিছু ই-মেইল করা। আবার শহর থেকে ফিরতি পথে ট্রেনে রোজ দেরি হয়। কেউ কেউ মজা করে বলেন, “ভাই, সন্ধ্যা ৬টার ট্রেন কখন আসবে?”

এছাড়াও মি. করিম যথেষ্ট আবেগী মানুষ। প্রায় প্রায় তিনি গালিগালাজ করেন, মারামারি করেন আবার কখনো কখনো তো ভাঙচুর অবধি করেন। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে গালিগালাজ করা খুবই কমন। এর মাধ্যমে তিনি তার বসের উপরে থাকা আক্ষেপ ও ক্রোধ প্রকাশ করেন।

এরপর সপ্তাহে দু’দিন সরকারী ছুটি পান যথাক্রমে শুক্রবার ও শনিবার। এরমধ্যে একটু বাইরে যান স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে। তারা নিয়মিত কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন যান না। পাশের এলাকার কোন পার্কে যান আর ফেরার পথে ১০০-৫০০ টাকা খরচ করে বাদাম খান ও আইসক্রিম হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। এখন এই দুই দিনের মধ্যে একদিন একটি হলিউডের সিনেমা/সিরিজ দেখা শুরু করতেই তিনি কোথাও ঐ সিনেমা/সিরিজের সাথে নিজের মিল খুঁজে পান না।

মানে আমাদের সমাজের গল্পটা এরকমই বা কিছুটা এর কমবেশি। এখন বাংলাদেশের এক পরিচালক তার একটি বাংলা সিনেমায় দেখাচ্ছেন, মি. রহিম একটি আলিশান ফ্ল্যাটে থাকেন। বিশাল বড় ঐ ফ্ল্যাটে রীতিমতো ফুটবল খেলা যাবে। মি. রহিমের আছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি (কার)। ২০০-৩০০ একরের মধ্যে বিশাল একটি বাগানও তার আছে। মানে এভাবে গল্পটি শুরু হবে…

অবশ্য এটাও কিছু মানুষের বাস্তবতা; খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এই বিলাসবহুল জীবন দেখাতে গিয়ে পরিচালক সাহেব প্রায় মি. করিম বা পূর্বে উল্লেখিত লাইফস্টাইলের সবকিছুই উহ্য করে ফেলেন। দেখে মনে হবে, বাংলা সিনেমার বর্তমান নায়ক-নায়িকারা জান্নাতে থাকেন। আহ্‌! তাদের কি দুর্দান্ত লাইফস্টাইল! এই লাইফস্টাইলের সাথে আমাদের বাস্তবতার কোনো মিল আমরা খুঁজে পাই না।

আর যখন মানুষ কোনোকিছুর সাথে নিজেকে খুঁজে পায় না তখন সে সেটার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। ফলাফল, একের পর এক ফ্লপ সিনেমা।

মানছি, সিনেমা/সিরিজ ‘সাধারণ’ মানুষের গল্প নিয়ে হয় না। একটু হলেও অতি-সাধারণ মানুষের গল্পের প্রয়োজন পড়ে। আমরা অধিকাংশ কমবেশি লুঙ্গি পরেছি বা পরে থাকি। বাংলা সিনেমাতেও লুঙ্গি দেখানো হয়, কিন্তু ঐ লুঙ্গির দাম শুনলে হুঁশ না হারায়। এখন তো পুরোপুরি পশ্চিমা ধারার চিন্তা-চেতনার প্রবেশ দেখা যায় বাংলা সিনেমাতেও।

এই কাল্পনিক বাস্তবতা বা সিনেমাটিক জীবনের সাথে আমাদের সত্যিকারের বাস্তবতার সামান্যতম মিলও খুঁজে পেতে অক্ষম আমরা। এছাড়াও বর্তমানের বলিউড এই কাঠামোগত বাস্তবতা দেখাতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। ফলাফল বলিউডের ভরাডুবি চলছে। আর বাংলাদেশে অনেক সফল পরিচালক থাকলেও আমার মতে এই কাঠামোগত বাস্তবতা খুব ভালোভাবে তুলে ধরেছেন হুমায়ুন আহমেদ স্যার। এক্ষেত্রে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সিনেমার নাম নেওয়া যেতে পারে।

পোশাক-আশাকে হলিউড ও বলিউড প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে আছে। আমি এসবের সমালোচনা করছি না। কিন্তু ভাবুন তো, এমন পোশাক-আশাক আমাদের অধিকাংশ কি পরে? বলিউডের আইটেম নম্বরগুলো দেখুন, প্রায় সফট্‌ পর্নোগ্রাফি! আমরা কি এত খোলামেলা পোশাক-আশাক পরে নাচানাচি করে থাকি?

আবার হলিউডে আইটেম নম্বর নাই। কিন্তু এখানে যেভাবে একটি সমাজ চলছে সেটা কি আমাদের সাথে যায়? মনে করুন, ৪০ বছর বয়সী এক মায়ের বয়সী মহিলা ক্লাবে বসে আপনার সাথে মদ খাচ্ছেন? বেডে যাবার জন্য অফার করছেন? কেমন লাগবে?

এরপর হলিউডের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে LGBTQ+ কমিউনিটি কে বারবার সামনে নিয়ে আসা এবং প্রায় প্রায় তাদের আধিপত্য বিস্তারকারী ভূমিকায় দেখানো। পয়েন্ট হচ্ছে, সব সমাজেই এই কমিউনিটি আছে। কিন্তু জোরপূর্বক বা প্রায় সব সিনেমা/সিরিজে এই কমিউনিটি কে কেন থাকতেই হবে? একজন বাংলাদেশী হয়ে এই ধরণের গল্প প্রায় নিয়মিত হজম করতে সমস্যা হয়।

আবার শুধুমাত্র ধর্মের কারণে বাংলাদেশের সিনেমায় এই কমিউনিটি কে উহ্য করা হয় না। এখানের সমাজের যে ফ্রেমওয়ার্ক আছে সেটা LGBTQ+ কমিউনিটি সমর্থন করে না।

ফিমেল প্রোটাগনিস্ট (নারী প্রধান চরিত্র) কে সবার উপরে দেখানো। আমার মতে, নারীবাদ মুভমেন্ট যে কারণে ধ্বংসের মুখে পড়তে যাচ্ছে। বর্তমানে নির্মিত অধিকাংশ হলিউডের সিনেমা ও সিরিজ এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও ফিমেল প্রোটাগনিস্ট নাম করেছে, বক্স অফিসে বারবার ঝড় তুলেছে কিন্তু এইভাবে নয়।

পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমন্বয় দেখানো উচিত নাকি নারীকে পুরুষের উপরে দেখানো উচিত? ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা নেন, ‘অগ্নি’ সিনেমা নেন… বা আরো কিছু আছে। ফলে পশ্চিমা এই চিন্তা ও সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে স্থান করে নিতে পারছে না। আমরা নিজেদেরকে এই সব সিনেমা/সিরিজের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না। এটা আমাদের বাস্তবতা নয়।

ভালো-খারাপ বিষয়টি পুরোপুরি আলাদা আলোচনা। আমরা যদি নিজেদের রিলেট করতে না পারি তাহলে সে সিনেমা/সিরিজ দেখবো কেন?

বর্তমান হলিউডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৬.৬% এর বেশি ফিমেল প্রোটাগনিস্ট এবং ২০-২৫% LGBTQ+ কমিউনিটির উপস্থিতি। পরিসংখ্যানের এই জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, নারীদের বেশি উপস্থিতি থাকুক কিন্তু তাদেরকে যেভাবে উপস্থিত করা হচ্ছে তা বাস্তবতা বিবর্জিত। এছাড়াও গৌন নারী চরিত্রের আধিপত্য তো আছেই। এই সিনেমাগুলোতে নারী-পুরুষের মধ্যে সমন্বয় সাধন তো অনেক দূরের কথা “আমি নারী আমি সব পারি” দর্শনে দূষিত।

আবার এমনও হতে পারে নারীদের হলিউডের বাস্তবতা বাংলাদেশের বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। আর একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের ২০-২৫% LGBTQ+ কমিউনিটি কোনোভাবেই থাকতে পারে না। সুতরাং, আনুপাতিক হিসাবটাও তো ঠিক নাই। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই গল্প আরো বিচিত্র। এখানে তো সমতা নাই-ই তার উপর ছন্নছাড়া কাঠামো।

আবার নেলসন ম্যান্ডেলার কল্যাণে কৃষ্ণাঙ্গদের উপস্থিতি তুলনামূলক বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। প্রায় ৫০% কৃষ্ণাঙ্গ সেদেশে থাকলেও তাদের সিনেমা/সিরিজে উপস্থিতি খুবই কম। আবার বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ ইস্যু কিন্তু ভিন্ন রকম।

আমি সাদা হলেও আমি নির্দিষ্ট রঙের সাদা। কেউ কালো হলেও নির্দিষ্ট রঙের কালো। পুরো সাদা বা পুরো কালো মানুষ এখানে খুবই কম তার উপর উচ্চতায় মিল নাই। এখানেও বাংলাদেশের মানুষ হলিউড সিনেমা/সিরিজের সাথে নিজের মিল খুঁজে পেতে অক্ষম।

আর লাইফস্টাইলের কথা যদি বলি, তাহলে মানুষ তার আয় অনুযায়ী ব্যয় করে থাকে। আগে অর্থনীতি ঠিক করতে হয়, তারপর বাকিটা মানে শিল্প ও সংস্কৃতি তার উপর দাঁড় হয়। ঐ লাইফস্টাইলের সাথে এই লাইফস্টাইলের কাছকাছিও কোন মিল নাই। পুনরায়, আমি কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল সে বিচারে যাচ্ছি না।

সামগ্রীকভাবে, হলিউড আমাদের জন্য একটি ফ্যান্টাসি কিংডম ছাড়া আর কিছুই নয়। হলিউডের চিন্তা আমাদেরকে প্রকৃত বাস্তবতা কে খর্ব করছে। এবং বর্তমানের হলিউডের মধ্যে আমরা নিজেরা নিজেদের খুঁজে পাচ্ছি না।

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button