মনোবিজ্ঞান

ভীড়ের মনোবিজ্ঞান এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতৃত্বের উত্থান

‘Follow/Subscribe’ বাটনের আসল খরচ

- Advertisement -

বর্তমান সময়ে গ্রেট লিডার (মহান নেতা) কারা? কীভাবে তাদের আইডিয়া নির্মিত হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত আইডিয়ায় পরিণত হচ্ছে? আমরা কিন্তু রাস্তায় যত আন্দোলন দেখছি তারচেয়ে বেশি আন্দোলন দেখছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তা থেকে একজন নেতা জনতার সামনে আসার যতটা সুযোগ থাকছে তারচেয়েও বেশি সুযোগ থাকছে একজন ফেসবুক বা ইউটিউবার ইনফ্লুয়েন্সারের। আর যে ব্যক্তির দুই জায়গায় মোটামুটি সহাবস্থান বিদ্যমান তিনি খুব দ্রুত একজন মহান নেতা হয়ে যেতে পারেন। অন্তত তিনি তার আইডিয়া খুব ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা যখন কোন সেলিব্রিটি কে অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করি তখন সেটাকে ‘সেলিব্রিটি ওরশীপ সিনড্রোম (Celebrity Worship Syndrome)’ বা সংক্ষেপে ‘CWS’ বলা হয়। আমার মতে, ব্যক্তিকে পূজো করার মত কিছুই নাই কারণ একজন মানুষ কখনোই পারফেক্ট হতে পারে না। আরো কঠোরভাবে বিষয়টিকে বলা যায়, কোন মানুষকে কখনোই আল্লাহ্‌/ভগবান/ঈশ্বরের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। তিনি যত বড়ই হোন, যত শক্তিশালী-ই হোন, যত ধনী-ই হোক, যত প্রতিভাবান-ই হোন না কেন, তিনি স্রেফ একজন মানুষ এর বাইরে গিয়ে তিনি এক ইঞ্চি বেশি বা কম নন।

এই ধরণের অন্ধভক্তি সত্য থেকে আমাদেরকে অদূর ভবিষ্যতে বহু দূরে নিয়ে যাবে। ব্রাজিলের একটি টেলিভিশন সিরিজ ‘3%’ তে দেখানো হচ্ছে ‘Cause’ নামক সিস্টেমে এক ধরণের আতঙ্কবাদী বিদ্যমান। এরা নোংরা এবং ‘জনপ্রিয় আইডিয়ার (Populist Ideas)’ পেছনে ঘুরে বেড়ায়। এই সিরিজ লাগাতার আমাদেরকে প্রশ্ন করে সবাই কি আমরা সবকিছু ডিজার্ভ করি? বা সবকিছু পাওয়ার যোগ্যতা রাখি? কিন্তু ‘Cause’ বারবার ফিরে আসে তাদের নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ‘Offshore (একটি সুন্দর জগত)’ সবার জন্য হওয়া উচিত হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরছে।

প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের প্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন? তিনি যা বলছেন তা সত্য বলছেন কিনা? আধা-সত্য তো বিষ মতন। তাকে আমরা আমাদের অজান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসরণ করার মাধ্যমে একধরণের নেতার দায়িত্ব দিলাম তা কতটুকু জায়েজ মানে উচিত হলো? একইসাথে আমাদের প্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার কে নিয়ে যে অবসেশন বিদ্যমান তা কোন পর্যন্ত? এখানে আমাদের লক্ষ্মণরেখা কি? তার ব্যক্তি জীবন থেকে কর্মজীবন আমাদেরকে কি খুবই বেশি প্রভাবিত করছে কিনা?

ফ্রেঞ্চ লেখক গুস্তাভ লে বনের বই ‘দ্য ক্রাউড: এ স্টাডি অব দ্য পপুলার মাইন্ড (১৮৯৫)’, এই বইতে ‘ভীড় (Crowd)’ মানে আমার মনে হয় বর্তমানে এই ‘Follow/Subscribe’ বাটনে প্রেস করা মানুষদের নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন। এরা এদের অনুসরণ করা ইনফ্লুয়েন্সারদের এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, নবী-রসূল-মশীহ্‌-ভগবান হার মেনে যাবে! মানে, ঐ ব্যক্তির কোন ভুল থাকলেও তা নজর আন্দাজ করে যাওয়া, অস্বীকার করা, মেনে নিতে না চাওয়া ইত্যাদি। অথচ ব্যক্তি মাত্রই ভুল হতে পারে, সেক্ষেত্রে আবার ‘Nitpicking’ করাও কিন্তু উচিত নয়।

- Advertisement -

ভীড় সবসময় আবেগ দ্বারা পরিচালিত। যৌক্তিক চিন্তা বা বিশ্লেষণ করে ভীড় চলে না। গুস্তাভের মতে, ভীড় যতটা বেশি যৌক্তিক তার চেয়ে বড় অভিনেতা। ভীড়ের মধ্যে থাকা ‘Individual’ নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পায় না, নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে বেখেয়ালি হয়ে পড়ে, এবং চলমান আবেগের দূষণে দূষিত হতে পারে। আমাদের মধ্যে ‘Shared Responsibility’ থাকবে কিন্তু সেটা কখনোই ব্যক্তি দায়িত্বকে পুরোপুরি খারিজ করে দিতে পারে না। এখানে নেতা এই আবেগ কে ফাঁদে ফেলে নিজের আইডিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

এখন ১৮৯৫ সালে তো আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলো না। এবং ভীড়ের যে সংজ্ঞা সেটাও আগে এরকম ছিলো না। এখন লাখ থেকে কোটি কোটি যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারো অনুসারী সেক্ষেত্রে উক্ত ইনফ্লুয়েন্সার এর মতামত, আইডিয়া, জ্ঞানীয় পক্ষপাত আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করছে। তাহলে ভীড়ের সংজ্ঞা কিছুটা হলেও পরিবর্ধন করা দরকার। পরিমার্জন করা দরকার, তাই নয় কি?

এখন এই যে অবসেশন প্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার কে নিয়ে, এটাকে কাটানো জরুরী হয়ে পড়েছে। আগামী দিনে নেতা রাস্তা থেকে আসবে না, ফেসবুক বা ইউটিউব বা আরো সোশ্যাল মিডিয়া আছে সেখান থেকেই আসবে। আমি ও আপনি যে ‘Follow/Subscribe’ বাটনে প্রেস করছি সেটা বন্ধ করতে বলছি না, এতে সিস্টেমের কিচ্ছু আসে বা যায় না। আমরা যখন ফলো বাটনে প্রেস করছি, বা সাবস্ক্রাইব বাটনে প্রেস করছি তখন কিন্তু আমরা আমাদের নিজের অজান্তে তাকে আমাদের ভার্চুয়াল নেতার দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি। যিনি আমাদের মুখপাত্র হিসেবে সিস্টেমের প্রধানের সাথে কথা বলবেন, বলতে পারেন।

কিন্তু বর্তমান ভারত ও বাংলাদেশে আমরা এমন এমন ইনফ্লুয়েন্সার কে অনুসরণ ও সাবস্ক্রাইব করেছি তারা শুধু ঘৃণার কথা ছড়াচ্ছে, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। আমাদের আবেগ নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলছে আর আমরা ঢালাও যাচাই-বাছাই না করে ফলো বা সাবস্ক্রাইব করে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি যে ক্রমান্বয়ে আমাদের নেতা তে পরিণত হচ্ছেন তা ভুলে যাচ্ছি। বাংলাদেশে নতুন নতুন ভন্ড শায়েখ/ভন্ড হুজুর এবং ভারতে ভন্ড গুরু সংস্কৃতি তারই আবাদ করছে।

বাংলাদেশ তো কয়েকধাপ এগিয়ে এমন এমন সব ইনফ্লুয়েন্সারদের অনুসরণ করে যারা তাদের সমস্যার মধ্যে তাদের ঐ ইনফ্লুয়েন্সার বা নেতাকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না। বাংলাদেশে ও ভারতে এই শায়েখগুলো শুধু ইসলামিক/হিন্দু শায়েখ/গুরু নন, এরা অতি প্রতিভাবান, জ্ঞানী ব্যক্তি, রাষ্ট্রের বড় বড় পদে বা অবস্থানেও আছেন। কিন্তু এদের ফলোয়ার বা সাবস্ক্রাইব যখন বিপদে পড়ে তখন আর এদের হদিস পাওয়া যায় না।

- Advertisement -

তাই, আমরা সবসময় বলে থাকি, সামাজিক মাধ্যমে আমাদের ভুলভাল রিলস্‌/কন্টেন্ট দেখানো হচ্ছে, আমেরিকার ও চায়নার পরিকল্পনা; সব ষড়যন্ত্র। কিন্তু এই ভীড় যদি এখানে ভালো মানের কন্টেন্ট কনজিউম করতো তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও তাই-ই দেখাতো। জ্ঞানীয় চর্চা ছাড়া গণতন্ত্র একটি গাধার তন্ত্র হতে বাধ্য এবং একই সাথে এই ভীড় একটি বড় গাধার কমিউনিটি। এরা নিজেদের নেতা নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারে না। ফলাফল, আপনার নির্বাচিত প্রতিনিধি আপনার সমস্যা নিয়ে কথা বলে না, চুপ করে থাকে। ঘৃণা ও বিদ্বেষে আপনাকে খুনী পর্যন্ত বানায়।

উল্লেখ্য, আমি সকল হুজুর/গুরু কে সমালোচিত করছি না। না কোন বিশেষ ইনফ্লুয়েন্সার কে। আমি এই চক্রের মধ্যে যারা আমাদের নেতা হয়ে বসে আছেন কিন্তু যা সত্য এবং যা নিয়ে কথা বলা জরুরী তা নিয়ে চুপটি-ঘাপটি মেরে বসে আছেন তাদেরকে বলছি। তারচেয়েও বেশি বলছি আমি আমাকে এবং আপনাদেরকে যে, অনুসরণ বা সাবস্ক্রাইব করার পূর্বে অন্তত ১ বার চিন্তা করে দেখবেন।

কারণ এই সংখ্যাই নির্ধারণ করে তিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রের কতবড় ভীড়ের নেতা হবেন!

- Advertisement -
- Advertisement -

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- Advertisement -
Back to top button