স্বাস্থ্য

ধূমপানের জালে আটকে বাংলাদেশ: রেস্টুরেন্টে ধূমপানের চিত্র

বাংলাদেশে ধূমপান নিষেধাজ্ঞার আইন কতটা কার্যকর?

বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টগুলোতে ধূমপানের প্রচলন এবং তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপনের প্রভাব কতটা? এই আর্টিকেলটি বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছে বাংলাদেশে ধূমপান নিষেধাজ্ঞার আইন কতটা কার্যকর এবং তামাক কোম্পানি কিভাবে আমাদের যুবসমাজকে লক্ষ্য করছে।

লাস্ট কবে কোনদিন আপনি কোন টিভি চ্যনেলে বা এইরকম মিডিয়াতে একটা সিগারেট বা তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখাছেন? আমার তো মনে হয় না আপনি দেখেছেন। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্টে খেতে গেছেন সেখানে দেখেছেন মানুষ আলাদা ভাবে ধোয়া খেতে যায় এবং তাদের জন্য একটা নির্ধারিত জায়গা আছে যেটাকে বলে ‘DESIGNATED SMOKING AREA(DSA)’। আর রেস্টুরেন্টের এই সকল জায়গায়ই তামাক কোম্পানিগুলো তাদের প্রডাক্টগুলোর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।

‘Smoking and Tobacco Control Act 2005’ একটা আইনে বলা বলা হয়, একটা রেস্টুরেন্টে যদি এক রুমের হয় তাহলে সেখানে ধূমপান করা যাবে না। কিন্তু আপনার রেস্টুরেন্ট যদি একের অধিক রুমের হয় তাহলে আপনি ধূমপানের জন্য একটি রুম (DSA) নির্ধারন করে দিতে পারেন।

গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা এরকম টপ রেটেড এরিয়ার রেস্টুরেন্টগুলোতে সার্ভে করার পর জানা যায় কিছু কিছু রেস্টুরেন্টে যেসব জায়গায় DSA আছে সেই সকল জায়গায় একটি বা অধিক ধূমপান বা তামাক কোম্পানি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দেয়া আছে এবং সেগুলো খুবই সুসজ্জিত।

যেটা কখনই একটি রেস্টুরেন্টে করা উচিট না। যেখানে ধুমপানের ৭৩% বিজ্ঞাপন দেয়া হয় ভেতরে আর ২৭% দেয়া হয় বাইরে। হ্যাঁ ভাই, এটাই আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা। আমাদের এই সকল বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদেরই যুবসমাজকে জোর করে ধূমপানের দিকে আকর্ষিত করা হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন, এইসব বিজ্ঞাপনে রেস্টুরেন্টের লাভ কি? এখানে রেস্টুরেন্ট মালিক আর তামাক কোম্পানি উভয়েরই লাভ রয়েছে। একদিকে কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপন মানুষকে দেখিয়ে তাদের প্রসার বাড়াচ্ছে আর অন্যদিকে কোম্পানিগুলো থেকে রেস্টুরেন্ট মালিকগুলো টাকা খেয়ে ফুলে ফেপে উঠতেছে।

রেস্টুরেন্টের লোকেশনের ভিত্তিতে তামাক কোম্পানিগুলো এই বিজ্ঞাপন মানুষকে দেখানোর জন্য রেস্টুরেন্ট মালিকদের টাকা দিয়ে থেকেন, যেটার পরিমান ৪ থেকে ১৫ লাখের মধ্যে ওঠানামা করতে দেখা যায়।

রেস্টুরেন্ট গুলো সঠিক ভাবে বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে কিনা এগুলো প্রতিনিয়ত কোম্পানির লোক এসে চেক করে যান। যেটার ৭ দিনে পরিদর্শন করে ৪০%, ১০ দিনে পরিদর্শন করে ২৬.৬% এবং বাকিটুকু পরিদর্শন করে ১৫ দিনে।

এই ব্যাপারটা আসলে কতটুকু ঠিক সেই ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। প্রথম লজিক হচ্ছে, একজন রেস্টুরেন্ট মালিক তার সম্পদের মধ্যে কি করবে না করবে সেটার স্বাধীনতা তার রয়েছে। সেকেন্ড লজিক যে রেস্টুরেন্টে আলাদা জায়গা নাই আর সেই রেস্টুরেন্টে যদি প্রকাশ্যে ধূমপান করে তাহলে অধুমপায়ীদের সমস্যা হয়, এখন ধুমপায়ীদের কথা হচ্ছে তোমরা যখন জানোই এখানে প্রকাশ্যে ধূমপানের স্বাধীনতা আছে তাহলে এখানে সবাই মিলে খাইতে আসো ক্যান?

এইখানে পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তিই আছে। তবে রেস্টুরেন্ট থেকেই প্যাসিভ স্মোকিং এর সুত্রপাত হয়। প্যাসিভ স্মোকিং হল, আপনি স্মোকিং করতেছেন না কিন্তু অন্যের স্মোক (SIDE STEAM) আপনার শরীরে প্রবেশ করতেছে যেটা কিনা আপনার শরীরে ক্যান্সারের মত রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। ১৯৬৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত এই সাইড স্টিম এর জন্য প্রায় ২৫ লক্ষ লোক ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তার তারা জীবনে কোনদিন সিগারেট খেয়েও দেখেননি।

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও রয়েছে থার্ড হ্যান্ড স্মোকিং, যা হল আপনি স্মোক করার সময় যেখান থেকে ধোয়া বের হচ্ছে সেখান এই ধোয়ার সংস্পর্শে জামা কাপড় এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়জনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে ধোঁয়ার সাথে থাকা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থগুলো আটকে থেকে যায় এবং যারা স্মোক করে না তারা এইগুলো ব্যাবহার করার ফলে তারাও স্বাস্থ্যঝুকির সম্মুখীন হচ্ছে।

তাহলে কি বুঝলেন? রেস্টুরেন্টে আলাদা জায়গা থাকুক আর নাই থাকুক, সেকেন্ড হ্যান্ড এবং থার্ড হ্যান্ড উদ্ভব সবজায়গায়ই হচ্ছে যেতা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির এক অপর নাম।

এখন আসি কিছু দেশের কথায় যারা এই ধুমপানের হার তাদের দেশে ইতিবাচক হারে কমিয়ে এনেছে। ২০২১ সালে ইংল্যান্ড এ সর্বনিম্ন ধুমপানের হার কমিয়ে নিয়ে আসছিল এবং তা ছিল মাত্র ১৩% যা ছিল এক অভাবনীয় পদক্ষেপ।

কিন্তু ১৯৫০ এর দশকে যুক্তরাজ্যে ৮০% লোক ধুমপায়ী ছিল কারন তখন এই ধুমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কের সবাই ভালোভাবে অবগত ছিল না এবং ধুমপানের তামাকজাত পন্যর সহজলভ্যতাও ছিল অনেক। তারপর ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানি স্যার রিচার্ড ডল গবেষনার মাধ্যমে ধূমপান এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মধ্যে এক যোগসুত্র আবিষ্কার করেন। আর তখন থেকে ধুমপানের হার দিন দিন কমতে দেখা যায়।

অন্যদিকে US, UK, JAPAN এর তামাক কোম্পানিগুলোতে ব্যান বসিয়ে এবং লোকজনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তামাকের ব্যাবহার দিন দিন কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে। এছাড়াও তারা তামাকজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে, প্রকাশ্যে ধূমপান করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং রেস্টুরেন্ট সহ সকল জায়গা ধূমপানের প্রচার ও বিজ্ঞাপন বাতিল করে দিছে।

যার কারনে ধারনা করা যাচ্ছে ২০৩৫ সালের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর জনগনের গড় আয়ু ৫ বছর করে বৃদ্ধি পাবে। আর এর জন্যাই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এখন তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যাবসা দক্ষিন এশিয়ায় শিফট করতে দেখা যাচ্ছে।

যার মধ্যে দেখা গেছে ইন্দোনেশিয়াতেই সবথেকে বেশি মানুষ ধূমপায়ী। ২৭৩.৪ মিলিয়ন লোকের মধ্যে ৫৭ মিলিয়ন। যেটা তামাক কোম্পানির জন্য অনেক বড় একটা মার্কেট। আর এশিয়ার মধ্যে ধুমপানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আছে ৮ম।

একটা প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্মোক ফ্রি করার কথা, তো উক্ত লক্ষ্য পূরন করতে হইলে অবশ্যই আমাদের পশ্চিমা দেশগুলোকে মডেল হিসাবে নিয়ে তাদের মত কঠোর আইন বাস্তবায়ন করা উচিত।

অন্যথায় বাংলাদেশের বর্তমান  যে পরিস্থিতি তাতে আর কয়েক দশকের মধ্যেই ধূমপান এদেশের যুবসমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়বে আর তখন ধূমপান বন্ধ করা একরকম অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যাবে বলে আমি মনে করি। আপনাদের মতামত কি?

ছবি: Image by drobotdean on Freepik

চন্দ্রকান্ত সেন

I'm Chandrakant Sen. I'm a student, striving to acquire knowledge. I'm currently studying at the Nursing and Midwifery College in Jessore (2nd year). My district is Narail. I also write for Ovizatri, a news and magazine website or online portal, focusing on health-related issues.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button