প্যারিস ও নিউইয়র্কের বইয়ের দোকান: বই পাগলদের জন্য অপরিহার্য ভ্রমণ
শেক্সপিয়র এন্ড কোঃ থেকে স্ট্যান্ড বুক স্টোর্স: প্যারিস ও নিউইয়র্কের বিখ্যাত বইয়ের দোকানগুলোর ভ্রমণ
এই আর্টিকেলে আমরা প্যারিস ও নিউইয়র্কের বইয়ের দোকানগুলোর ভ্রমণের কথা জানতে পারি। প্যারিসের ঐতিহ্যবাহী শেক্সপিয়র এন্ড কোঃ থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের বাউম্যানস রেয়ার বুকস, আরগোসি, এলাবাস্টার বুকস এবং স্ট্যান্ড বুক স্টোর্সের মতো দোকানগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে। বই পাগলদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পাঠ।
শেক্সপিয়র এন্ড কোঃ
প্যারিসে আইফেল টাওয়ার দেখার পর শ্যেন নদীর তীরে সেই ঐতিহ্যময় শেক্সপিয়র এন্ড কোঃ তে বই ঘাঁটতে যান। এই দোকানটি জয়েস, এজরা পাউন্ড, হেমিংওয়ের মতো বিখ্যাত লেখকদের আড্ডার জায়গা ছিল। বই কেনার নেশারুদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান।
নিউইয়র্কের বইয়ের দোকানগুলো
নিউইয়র্কের ঠিকানা খোঁজা
নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানে ঠিকানা খোঁজা ভীষণ সরল। গোটা শহরে লম্বা লম্বা এগারোটা এভিনিউ এবং আড়াআড়ি পর পর অনেক গুলো স্ট্রীট রয়েছে। ঊনষাট অবধি সোজা, তারপর একটু জটিল। এক স্ট্রীট থেকে আর এক স্ট্রীট পৌঁছতে খুব জোর তিন মিনিট আর এক এভেন্যু থেকে আর এক এভেন্যু পৌঁছতে বড় জোর পনেরো মিনিট।
বাউম্যানস রেয়ার বুকস
সিক্সথ এভিন্যু আর সাতান্ন নং স্ট্রীটের ক্রসিং এ বাউম্যানস রেয়ার বুকস খুঁজে পাওয়া খুব সোজা। এই দোকানটি বিশাল নয়, তবে বাইরে সুদৃশ্য শোকেসে রাখা কয়েকটি পুরানো বই এবং সুন্দর বাঁধাই দেখা যায়। ফকনারের প্রায় নতুন ‘এজ আই লে ডাইং’ বইটিও এখানে পাওয়া যায়।
দোকানের ভিতরে
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে চমৎকার হালকা এসি পাওয়া যায়। গরম ও সরাসরি সূর্যালোকে বই খারাপ হয়ে যায়, তাই এখানে সুন্দরী, সুবেশা তরুণী এগিয়ে এলেন। দোকান তখন খালি, একটিও ক্রেতা নেই।
‘মে আই হেল্প ইউ স্যর?’ মনে প্রচুর আত্মবিশ্বাস, পকেটে পাঁচশো ডলার। বললাম – না, এই একটু ঘুরে দেখছি। সুন্দরীটি একটুও দমলেন না। পরের প্রশ্ন – কোনো বিশেষ সংগ্রহ চাই কি স্যর?
খেয়েছে রে এ যে আরও বিপদ! কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম – এই মডার্ন আর্ট মডার্ন আর্ট মানে ১৯৫০-১৯৫৫ এর পর যে সব বই, তার প্রথম সংস্করণ। ততক্ষণে এই আমি বই পাগলার ধারণা হয়েই গেছে এদের এতো ভাল পুরানো স্টকস – নামই বাউম্যানস রেয়ার বুকস, এদের কাছে নতুন বই কি ভাবে থাকবে!
তরুণী নাছোড়বান্দা – ‘এনি পার্টিকুলার রাইটার?’ এ কি জ্বালা! ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে, জানি রণে, বনে, জলে জঙ্গলে আর সাহিত্য আড্ডায় এবং বইয়ের দোকানে বিপদে পড়িলে গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসের নাম স্মরণ করতে হবে। আমিও করলাম। সুন্দরী ফুরুত করে ভিতরে গেলেন উচ্চারণ করে – এক্সেলেন্ট।
বাঁচা গেল। আমি নিশ্চিন্ত মনে বই দেখায় মনোনিবেশ করলাম। আবার তাঁর আবির্ভাব – এবারে হাতে সাদা গ্লাভস পরা, একটা চাবি সমেত। শো কেস খুলে বার করলেন – ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড’ – প্রথম সংস্করণ।
কি ঝকঝকে চেহারা, এতো নতুন অবস্থায়! মলাটে রয়েছে গাই ফ্লেমিং এর সুবিখ্যাত প্রচ্ছদ ‘ড্রিমারস রাইজ’। এরপরে দেখালেন, অতি সন্তর্পনে খুললেন ব্লার্কের বিখ্যাত ভুল দেখানো বই। গছাবেই গছাবে। বাপ রে বাপ। দাম কত? মাত্র পাঁচ হাজার ডলার। বই পাগলার আত্মবিশ্বাস চুপসে আমশি।
আমার মুখের অবস্থা দেখে তরুণী ডেনিস লিলির মতো দ্বিতীয় বাউন্সার ছাড়লেন – ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ ও আছে। দেখুন দেখলাম সেই বিরল সংস্করণ মাত্র তিনশো কপি ছাপা হয়েছিল – অটোগ্রাফ করা লিমিটেড এডিশন। হলু আর সবুজে সাজানো তার দাম মাত্র ছ’হাজার ডলার! নাঃ! পাঁচশো ডলারের কোন বই নেই।
যুদ্ধে হেরে যাওয়ার মতো অবস্থায় দোকানের বাইরে বেরিয়ে আসার আগে সুন্দরী একটি ক্যাটালগ ধরিয়ে দিলেন। গেলাম বইয়ের দোকান আরগোসি। ঊনষাট তম স্ট্রীটে। এখানে একটু কম দামী বই আছে। দু, তিন ডলারে পেপারব্যাক। অথচ ফকনার এর প্রথম সংস্করণ সাড়ে সাতশো ডলার।
এলাবাস্টার বুকস
আমি বই পাগল এবার গেলাম শহরের অন্য প্রান্তে – এলাবাস্টার বুকস – বারো নং স্ট্রীট। ছোট্ট দোকান, সব সাধারণ বই, পেপার ব্যাক। দুটো আলমারীতে রয়েছে হীরে, জহরত! আলব্যের কামুর বিখ্যাত প্রবন্ধের বই ‘মিথ অব সিসিফাস’ – দুশো ডলার। কিন্তু রেখে দিলাম। দেখি আর কি আছে। সামনেই রয়েছে সেরা দোকান – স্ট্যান্ড বুক স্টোর্স। বিশাল পাঁচ তলা।
স্ট্যান্ড বুক স্টোর্স
আর বাইরে সারি সারি বইয়ের দোকান, কলেজ স্ট্রীটের মতো – সব সেকেন্ড হ্যানড। আর্ট, আর্টিটেকচার, রান্না বিউটি সব বই। আর ভিতরে! বই আর বই। বই পাগলা আমি পাগল হয়ে গেলাম। সরু গলির মতো বইয়ের র্যাক অক্ষর অনুযায়ী সাজানো।
ছিয়াশী বছর বয়সী এই দোকান নিউ ইয়র্কের সাংস্কৃতিক পাড়া গ্রিনিচ ভিলেজে ৪র্থ এভিন্যুতে স্থাপিত হয়েছিল। মাত্র ২৫ বছর বয়সী বেন বাস এটি বিশাল দোকানে পরিণত করেন ও পরবর্তী কালে তাঁর ছেলে ফ্রেড আরও বড়ো করে তোলেন।
দোকানের বিশেষত্ব
- বইয়ের সংখ্যা: দোকানে বই আছে ৩০ লক্ষ।
- কর্মচারী: দোকানের কর্মচারীর সংখ্যা দু’শোর বেশি।
- দুর্লভ বই: গোটা আমেরিকায় এই দোকানের দুর্লভ বই বিখ্যাত।
এতো বড়ো দোকানে ঘুরবো কি ভাবে! কি ছেড়ে কি দেখবো! কি ছেড়ে কি কিনবো।
নাঃ! বেরোই এখান থেকে। চলো যাই অন্য কোনো খানে! গেলাম অন্য দোকানে। সেখানে এতো বইয়ের মাঝে বই পাগল হার্টফেইল না করে! তো হলো সে ব্যবস্থা। পুনরায় সুন্দরীর আবর্ভাব। জিজ্ঞাসা করলাম – আপনাদের রেয়ার বুকস এর স্টক্স কোন জায়গায়?
“এলিভেটারে করে তিন তলায় উঠে যান।” আমাদের লিফট তথা আমেরিকার এলিভেটরে তিন তলায় থতমত খেয়ে গেলাম। এতো বিশাল! হলঘর, তাতে কাচের আলমারি জুড়ে বই। উঃ! এ কি অসামান্য সংগ্রহ!
কামু, মার্কেস, সারামাগো, পামুক – প্রথম সংস্করণ স্বাক্ষরিত বইয়ের ছড়াছড়ি। হেমিংওয়ের সঙ্গে সহবস্থান ফকনার এর – প্রায় নতুন। সাধারণত যাদের দেখা পাওয়া দুষ্কবর সেই গিনসবার্গ বা পিনচন এর সই করা বই রয়েছে। বই পাগল তাকায় যে দিকে, সে দিকে সোনার খনি – সোনার দামে। প্রতিটি বইয়ে এমবস করা স্টিকার ‘স্ট্যান্ড রেয়ার বুকস’।
এই রেয়ার সেকশনে গ্রাহক রা আরামে বই দেখার সুযোগ পান। কোন সুন্দরী এসে বই বাছবার বা বই দেখাবার বা হেল্প করতে এগিয়ে আসেন না কথায় কথায়। ইচ্ছে হলে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। সোফা সেট রাখা আছে।
মার্কেসের সই সহ যে দুষ্প্রাপ্য বই হাতে পেল বই পাগলা, সেটা আর জন আপডাইকের ‘টেররিস্ট’ কিনে ফতুর হয়ে গেল বই পাগলা। নিচে নেমে এলো সে। হাতে খান তিনেক বই হলুদ প্লাস্টিকের ব্যাগে আর মনে বিশ্বজয়ের আনন্দ।
তথ্যসূত্র
শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়
টিপস:
- বইয়ের দোকানে যাওয়ার আগে: আগে থেকেই কোন বিশেষ বইয়ের খোঁজ থাকলে তার নাম এবং লেখকের নাম মনে রাখা ভালো।
- বাজেট নির্ধারণ: বইয়ের দোকানে যাওয়ার আগে বাজেট নির্ধারণ করা উচিত, কারণ দুর্লভ বইয়ের দাম বেশি হতে পারে।
- সময় ব্যবস্থাপনা: বইয়ের দোকানে ঘুরে দেখতে যথেষ্ট সময় নিয়ে যাওয়া উচিত, কারণ বইয়ের সংগ্রহ দেখতে বেশ সময় লাগতে পারে।
টেবিল: নিউইয়র্কের কিছু প্রসিদ্ধ বইয়ের দোকান
দোকানের নাম | ঠিকানা | বিশেষত্ব |
---|---|---|
বাউম্যানস রেয়ার বুকস | সিক্সথ এভিন্যু আর সাতান্ন নং স্ট্রীট | পুরানো এবং দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ |
আরগোসি | ঊনষাট তম স্ট্রীট | কম দামী বই এবং পেপারব্যাক |
এলাবাস্টার বুকস | বারো নং স্ট্রীট | সাধারণ বই এবং পেপারব্যাক |
স্ট্যান্ড বুক স্টোর্স | গ্রিনিচ ভিলেজে ৪র্থ এভিন্যু | বিশাল সংগ্রহ এবং দুর্লভ বই |
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.