এই রহস্যময় গল্পে আমরা দেখতে পাবো গবেষক আদিত্যকে, যে এক মাস ধরে নার্সিং হোমে আছে। একটি সেমিনার থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় আহত হয় সে। গভীর মস্তিষ্ক আঘাতে আক্রান্ত আদিত্য ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার’-এর শিকার হয়। স্মৃতি হারিয়ে সে অচেনা ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয়। হাতে হ্যামার নিয়ে কার মাথায় আঘাত করবে সে, তা জানার জন্য পড়ুন এই রোমাঞ্চকর গল্পটি।
নার্সিং হোমে আদিত্য একটানা এক মাস ধরে রয়েছে। সে ঠিক কোমায় নেই, কিন্তু আচ্ছন্ন অবস্থায় আছে। ‘কেয়ার’ নার্সিং হোমে রয়েছে সে, সঙ্গে বান্ধবী কেয়া। দুজনে গিয়েছিল একটি সেমিনার এটেন্ড করতে সুন্দরগঢ় উপজেলায়, আমন্ত্রণমূলক আহ্বানে।
কেয়া আইসিউতে বসে আছে আদিত্যর পাশে। আদিত্যর সারা শরীরে ভেন্টিলেটর, ইন্ট্রাক্রানিয়াল প্রেশার মনিটর, ইনফিউশন পাম্প, ফিডিং টিউব, ক্যাথেটার এতো সব লাগানো। আদিত্য উপাধ্যায় ও কেয়া বণিক, ময়নাপুর স্টেটের বাসিন্দা। পড়ালেখা সমাপ্ত দুজনেরই গবেষক হওয়ার ইচ্ছে। মেন্টরের কাছে উপযুক্ত পেপারস জমা দিয়েছে, তিনি অনুমোদন করলে তারা এগোতে পারবে।
ইতিমধ্যে সেই সেমিনার থেকে ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা। তাদের গাড়ি চলছিল সমতল, মসৃণ রাস্তায়, হঠাৎ যেন এক ভূমিকম্প, বিরাট এক আর্তনাদ! বহুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল এক মিনি ট্রাক তাদের গাড়ির পিছনে পিছনে আসছে। সেই ট্রাকই কি তাদের অনুসরণ করছিল? কেন? কি কারণে? কোনোরকম শত্রুতাবশে না কি কোনো দুরভিসন্ধি!
কিন্তু তাদের কোনো শত্রু আছে বলে তো কেউই জানে না!
এটাও এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার, কেয়ার শরীরে এতটুকু আঁচড় লাগেনি, অথচ আদিত্য আক্রান্ত হয়েছে গভীর মস্তিষ্ক আঘাতে। ড্রাইভ করছিল আদিত্য, কেয়া পাশে বসে টুকটাক কথা, গুনগুন গান, ভবিষ্যতের প্ল্যান প্রোগ্রাম করছিল মাঝে একবার গাড়ি থামিয়ে সঙ্গে রাখা টিফিনও খেয়ে নিয়েছিল।
দুঃসংবাদ পেয়েই আদিত্যর কাকা এসেছেন মিঃ নরেশ উপাধ্যায়, আদিত্যর মা-বাবা নেই, তাঁর কাছেই মানুষ। কেয়ার অভিভাবক তার বাবা বিদেশে, তিনিও কোনো গবেষণাগারে এক প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ত, কাজ সামলে আসবেন জানাচ্ছেন ক্রমাগত।
বর্তমানে আসা যাক…
“আজ অবস্থা কেমন?”
আইসিউর বাইরে মিঃ উপাধ্যায় জিজ্ঞাসা করেন কেয়াকে, “ভেন্টিলেশন কি লাগানো এখনো?”
কেয়া বিমর্ষ মুখে বলে, “শুনেছিলাম আজ সেমি ভেন্টিলেশনে দেবে।”
আদিত্য কাকা বলেন, “গুড।” কেয়া বলে, “কিন্তু ওর তো ‘আউটপুট’ (ইউরিন) নর্মাল হচ্ছে না, যার কারণে মাঝে মাঝে ‘ডায়ালিসিস’ দিতে হচ্ছে ‘আংকল’!”
“হুঁ,” চিন্তান্বিত মুখে চুপ করে থাকেন নরেশ উপাধ্যায়।
কাউন্সিলিং এর সময় ডঃ বিপিন প্রসাদ বলেন তাঁর অফিসে বসে, “ততোটা হোপ আমি আপনাদের দিতে পারছি না যতোটা আপনারা আশা করছেন!” এরা দুজনে ডঃ এর মুখের দিকে আশার আলো নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
“আসলে পেশেন্টের ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার’ এর যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাতে….” ডঃ একটু থেমে বলেন, “ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড… পেশেন্টের ‘মেমোরি’ ‘লুজ’ করেছে পার্টলি।”
“হোয়াট?” নরেশ উপাধ্যায় চেঁচিয়ে বললেন, “হোয়াট ডাজ ইউ মিন বাই ইট?”
“শুনুন, পেশেন্টের স্মৃতি শক্তি ‘লস্ট’ নয় কিন্তু দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তবে ভয় পাবার কিছু নেই, এক্সিডেন্টের পরে কারও কারও এমন হয় টেম্পোরারিলি, ডাক্তারি ভাষায় একেই বলা হয় ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার’।”
কেয়া তো হাঁ করে ডঃ এর কথা শুনছে, নরেশ জিজ্ঞাসা করেন, “একই সাথে দুটো ব্যক্তিত্ব কি সিঙ্ক্রোনাইজ হয়?”
ডঃ প্রসাদ বলেন, “বুঝিয়ে দিচ্ছি, পেশেন্ট অতীত মনে করতে পারছে কিন্তু এখন বর্তমানের আপনাদের ঠিক রেকগনাইজ করতে অক্ষম হচ্ছে। আপনাদের সঙ্গে কি কানেকশন মনে করতে খানিকটা সময় লাগবে। একে ইংরেজিতে বলে ‘Dissociative Amnesia’।”
পরদিন আদিত্যকে সেমি ভেন্টিলেশনে শিফট করা হলো। আজ তাকে বাইরে থেকে দেখে মোটামুটি ভাল লাগছে, মাথায় ব্যান্ডেজ নেই, কপালের এক পাশে ‘স্টিচ স্টিকার’ লাগানো, চোখও খোলা বড় করে, তাকাচ্ছে এ দিক, ও ওদিক।
কেয়ার টেকার নার্স এসে মুসুম্বির জুস ফিড টিউবে পুশ করলো।
আস্তে আস্তে আদিত্য সেটা ‘সিপ’ করছে বোঝা গেল। বেলা তখন ন’টা, কেয়া পাশে দাঁড়িয়ে, আদিত্যর কাকা তাঁর অস্থায়ী বাসস্থান থেকে তখনো আসেননি। এমন সময় আদিত্য হঠাৎ ‘বেড রেস্ট’ টা ধাক্কা মেরে ফেলে সটান উঠে বসলো। পরিষ্কার বললো, “আমায় একটা ‘হ্যামার’ দেওয়া যাবে?” কেয়া হতভম্ব হয়ে বলে, “কেন?”
তার দিকে অচেনা নজরে চেয়ে আদিত্য বলে, “সেটা আমি বলতে বাধ্য নই! হ্যাঁ, তবে কারো হেড পুরোপুরি ইনজিওর করা যায়, এতো ভারী হ্যামার চাই আমার।”
কেয়া শান্ত ভাবে বলে, “তোমার বডিতে… এই মনিটর, পার্টস, লাগানো, কিভাবে উঠবে?” বলে সব নামগুলি বললো।
আদিত্য তেমনই অচেনা ভঙ্গিতে জবাব দেয়, “সে দায়িত্ব আমার!”
কেয়া “দেখছি চেষ্টা করছি” বলে বেরিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে আদিত্যকে দেখা গেলো পেশেন্টের সবুজ ইউনিফর্ম পরিধানে, হাতে এক মাঝারি হাতুড়ি নিয়ে সে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে পার্কিং এর দিকে কোন গাড়ীর উদ্দেশ্যে।
পিছনে কেয়া ও নরেশ উপাধ্যায় তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।