স্বার্থের দ্বন্দ্ব: বাঙালীদের জাতিগত অনৈক্য ও র্যাডক্লিফ লাইনের প্রভাব
দেশের স্বার্থ বনাম জাতীয় স্বার্থ: বাঙালীদের ইতিহাস ও বর্তমান সংকট
প্রায় প্রায় আমরা কিছু শব্দ শুনে থাকি যেমন ‘দেশের স্বার্থ’, ‘জাতীয় স্বার্থ’, ‘জাতির স্বার্থ’, ‘জনগণের স্বার্থ’ অথবা ‘জনগণের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা’। এই শব্দগুলো খুবই ব্যবহৃত হয় আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মুখে, বুদ্ধিজীবীদের লেখায় এবং বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে। চায়ের দোকান থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই চর্চিত এই শব্দগুলো আমাদেরকে নিশ্চয় ভাবায়।
প্রশ্ন হলো, এই সমস্ত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দ্বারা মূলত কি বুঝায়? কোনটা দেশের স্বার্থ? কোনটা জাতীয় স্বার্থ? কোনটা জাতির স্বার্থ? বা জনগণ আসলে কে বা কারা? এবং ঐ জনগণ যে কি চায় তা আমরা কীভাবে জানি? জনগণের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কীভাবে আমরা জেনে থাকি? এছাড়াও এত এত ‘স্বার্থ’ বিবেচনায় কোন ‘স্বার্থ’ টা সবার উপরে স্থান করে নেবে?
লায়লা গিফটি আকিতা তিনি তার ‘Think Great: Be Great’ বইটিতে লিখেছেন, “যদি আপনি আপনার সিদ্ধান্ত না নেন, তাহলে অন্যরা আপনার জন্য সিদ্ধান্ত নেবে।” নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে হচ্ছে নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া। নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে হচ্ছে, আমি নিজে আত্মবিশ্বাসী। নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে হচ্ছে, আমার সিদ্ধান্ত ভুল হলে সেটা গ্রহণ করতে সক্ষম ও ঐ ভুল থেকে সংশোধন করতেও রাজী।
সুতরাং আমাদের স্বার্থ কোনটা সে বিষয়ে আমাদেরকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবং এই সমস্ত স্বার্থের মধ্যে কি কি উপাদান লুকিয়ে আছে? এবং সকল স্বার্থ সমূহ কীভাবে মজবুত করা যায় তা নিয়ে আমাদেরকেই ভাবতে হবে। বসে বসে কর্মহীন ও নিষ্প্রাণ জীবনে যদি শুধুমাত্র কারো ‘ভুল’ ধরে ধরে বেড়াতে হয় তাহলে সবার ভুল খুঁজে পাওয়া যাবে। ভুলের সমাধান নয়।
বাঙালীদের কাঁটাতার বা ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ নিয়ে বর্তমানে এবং মোটামুটি সার্বক্ষণিক তাদের যে আর্তনাদ তার কারণ হলো, বাঙালীদের ভৌগোলিক সীমা বাঙালীদের সিদ্ধান্তের বা ইচ্ছার ফলাফল নয়। ১৯৪৭ সালে মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে এই লাইন টেনে দেন। ১৯৪৭ সালের ১৬ আগষ্টে বিকেলে পরিকল্পনা এবং ১৭ আগষ্টে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। ফলাফল মাত্র দুইদিনের মধ্যে নিজের দেশত্যাগ করতে গিয়ে ও ধর্মীয় সহিংসতায় মারা যান ৫-১০ লাখ মানুষ! (একাধিক সূত্র মতে)
এই ক্ষতচিহ্ন আজও দুই বাংলার মানুষদের মনে স্পষ্ট দেখা যায়। এই ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বাঙালীদের হতাশার শেষ নাই। দুই বাংলার মানুষ আজও একে অপরকে দোষারোপ করে এই লাইন বা কাঁটাতারের জন্য। আবার এদের মধ্যে আজও এক ধরণের অম্ল-মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এরা একে অন্যকে সাহায্য করেছে। সর্বশেষ, ২০২৪ সালে জুলাই বিপ্লবেও কিঞ্চিৎ হলেও সমর্থন করতে দেখা যায় পশ্চিম বাংলা কে।
আজও কিছু ভারতীয় ও কিছু বাংলাদেশী মানেন এবং একে অপরকে দোষারোপ করেন এই বলে যে, এই লাইন টেনে দেবার একমাত্র কারণ হলো ‘ধর্ম’; যা পুরোপুরি সত্য নয়। র্যাডক্লিফ লাইন এতটাই রক্তাক্ত লাইন, যে লাইন টানা হয়েছে মোট ৩টি বাড়ির মধ্যে দিয়ে যথাক্রমে মালদা, খুলনা ও মুর্শিদাবাদে।
আজ কাঁটাতারের দুই পাশে দুই বাঙালী ন্যারেটিভের ফাঁদে পড়েছে। তারা তাদের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কথা বলতে চায় না। তারা তাদের জাতিগত অনৈক্যের দায়িত্ব নেয় না। তারা বারবার ভুলে যায়, যে লাইন টানা হয়েছে তাদের হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে তাতে তাদের নিজস্ব চিন্তার, ইচ্ছার ও সিদ্ধান্তের প্রতিফলনে ঘটে নাই।
এই বিভাজনের পক্ষের চিন্তা ক্ষুদ্র অংশ হলেও তারা পুরো বাঙালীদের পৃথক পৃথক মানচিত্র টেনে দিয়েছিলো। তাই আবারও মনে করিয়ে দিতে হয়, “আমরা যখন নিজেদের জন্য সিদ্ধান্ত নেবো না তখন অন্যরা আমাদের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে।” বাঙালীরা বাংলা ভাগেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নাই। নিজেদের মধ্যে ঘটে চলা জাতিগত এই অনৈক্যের গল্প, সন্দেহের গল্প, সংঘাতের গল্প, রক্তাক্ত গল্প নিয়ে আর যাই করা যাক না কেন গর্ব করা যায় না।
তাই আমি যখন বলছি ‘দেশের স্বার্থ’, ‘জাতীয় স্বার্থ’, ‘জাতির স্বার্থ’ বা ‘জনগণের স্বার্থ’ তখন র্যাডক্লিফ লাইন বিবেচনায় বলতে হচ্ছে। র্যাডক্লিফ লাইন থাকা অবস্থাতেও একে অন্যের নূন্যতম কিছু স্বার্থ নিশ্চয় বজায় রাখা যায়। কিন্তু বাঙালিদের জাতিগত স্বার্থ নিয়ে কথাও বলা যায় না। বাংলাদেশীদের স্বার্থ বা ভারতীয় স্বার্থ চিন্তায় শব্দ চয়ন করতে হয়।
সুতরাং কোন স্বার্থ আগে থাকবে বা কোন স্বার্থ পরে থাকবে সে বিষয়েও আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এত এত বেশি কনফিউজড এবং দ্বিধাদ্বন্দে ভোগা মানুষদের জন্য আমার মনে হয় না কেউ আমাদের ভালো ন্যারেটিভ উপহার দিতে পারবে। কারণ, স্বার্থ বা আগ্রহ যে শব্দই বলুন, বারবার অতীতে ফিরে গিয়ে নষ্টালজিয়ায় ভোগা কনফিউজড মানুষদের সাথে স্রেফ কু-তর্ক করা যায়।
যাদের জাতিগত নির্দিষ্ট অবস্থান নেই তাদের জন্য অন্যরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আর বাঙালিদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তহীনতার ইতিহাস বহু পুরনো।