মনোবিজ্ঞান

ডিমেনশিয়া: স্মৃতিভ্রংশের ভয়াবহতা ও প্রতিকার

ডিমেনশিয়া কি? উপসর্গ, কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ডিমেনশিয়া(স্মৃতিভ্রংশ) নিয়ে আমরা অনেকেই কম বেশি কোথাও না কোথাও শুনেছি। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে যে রোগটি আমাদের মস্তিষ্কে বাসা বাধতে পারে সেটা হলো ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ। অন্যভাবে এটাকে মেমোরি লসও বলা হয়ে থাকে।

ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) আসলে কী?

ডিমেনশিয়া হলো এক ধরণের সিনড্রোম যা আমাদের মস্তিষ্কের সাথে জড়িত বিভিন্ন ডিজ-অর্ডারের সাথে সম্পৃক্ত। এটা এমন এক ধরণের রোগ যে এর প্রভাব আমাদের মস্তিষ্কে গ্রথিত স্মৃতির উপর পড়তে পারে, আমাদের কথা বলার উপর পড়তে পারে। এমনকি আমাদের নিয়মিত চিন্তার মধ্যে সমস্যাও তৈরি করতে পারে। ঠিক যেমন আমাদের দৈনন্দিন রুটিন ভুলে যাওয়া এবং বুঝতে না পারা পরবর্তী কাজ কি?

কারণ এই ধরণের সমস্যায় থাকলে আমরা ভুলে যাই বিভিন্ন বিষয়। ফলে কাজকর্ম ও প্রয়োজনীয় রুটিন বা আপকামিং কোন ইভেন্ট মনে না থাকায় এক রকম বিপদে পড়তে হয়। যদি আমরা পরিসংখ্যান দেখি তবে সেটা ভয়াবহ। বর্তমানে সারা বিশ্বে যেসব অসুখের কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে তার তালিকায় ডিমেনশিয়ার অবস্থান ৫ নম্বরে। সারা বিশ্বে প্রতি ৪ সেকেন্ডে কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বিবিসিতে প্রকাশ পাওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, শুধুমাত্র বাংলাদেশে আগামী ২০৩০ সালে এই ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে প্রায় ৯ লাখ মানুষ। সুতরাং বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবার কোন কারণ অন্তত আমি দেখছি না।

ডিমেনশিয়া(স্মৃতিভ্রংশ) এর জিওগ্রাফিক্যাল অবস্থা (মিলিয়ন হিসেবে)

১. ইউরোপে ৯.৯৫% শতাংশ যা ২০৩০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হতে পারে ১৯.৯৫% শতাংশ।

২. অ্যামেরিকাতে ৭.৮২% শতাংশ যা ২০৩০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হতে পারে ১৪.৭৮% শতাংশ।

৩. আফ্রিকাতে ১.৮৬% শতাংশ যা ২০৩০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হতে পারে ৮.৭৪% শতাংশ।

৪. সর্বোচ্চ এশিয়াতে ১৫.৯৪% শতাংশ যা ২০৩০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হতে পারে ৩৩.০৪% শতাংশ।

ডিমেনশিয়া(স্মৃতিভ্রংশ) এর উপসর্গ কি কি?

১. Hallucinations

২. Planning Difficulty

বিজ্ঞাপন

৩. Decision-Making

৪. Anxiety

৫. Depression

৬. Disregarding Manners

৭. Impulsive Behavior

৮. Selfishness

৯. Difficulty Recalling Names

১০. Confused & Disoriented

ডিমেনশিয়ার প্রধান প্রধান লক্ষণ বা উপসর্গ এরুপ হতে পারে। প্রথম দিকে ছোট ছোট বিষয় ভুলে যেতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ের কোন ঘটনা মস্তিষ্ক থেকে হুট করে হারিয়ে যাওয়া। খেয়াল করলে দেখা যায়, ডিমেনশিয়ার রোগী একই কথা বা প্রশ্ন বারবার জিগ্যেস করে বা জানতে চায়।

শুধু তাই নয়, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শব্দ খুঁজে পেতেও সমস্যা হতে পারে। এর ফলে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে সে আটকে যেতে পারে শব্দের অভাবে। কারণ সে চেষ্টা করে হারিয়ে যাওয়া শব্দ উদ্ধার করতে কিন্তু যেহেতু সে উক্ত শব্দ ভুলে গেছে সেহেতু কথা বলার সময় সে হঠাৎ আটকে যায়।

এমনকি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি রুটিন কাজও ভুলে যেতে পারেন। হতে পারে উক্ত ব্যক্তির নিয়মিত কোন কাজ করবার অভ্যেস আছে। যেমন ধরুন, সকালবেলা নাস্তা বানানো, সকালবেলা বের হওয়া বা হাঁটাহাঁটি করা, পরিবারের খেয়াল রাখা, বাজারে সময়মত যাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি।

এসব কিন্তু তিনি ভুলে যেতে পারেন যদি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হোন। ভয়ানক বিষয় হলো, ছোট ছোট কাজেও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যর্থ হোন কারণ তার মাথায় সেসব থাকে না বা বিলুপ্তি ঘটে যায়।

আরো ভয়ানক বিষয় হচ্ছে, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি তার পরিচিত রাস্তাও ভুলে যেতে পারে। অথচ হয়তো ঐ রাস্তা দিয়েই তিনি নিয়মিত বাড়িতে ফিরতেন বা বাজারে যেতেন। হুট করে ঐ রাস্তা “Disoriented” হয়ে যাবার দরুন অচেনা লাগতে পারে। কোথাও কোন জিনিস রেখেছেন কিন্তু পরে আর মনে করতে পারছেন না। যেমন ধরুন, ঘরের চাবি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মোটামুটি আমরা সবাই রাখি। কিন্তু ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগী সেটাও ভুলে যেতে পারেন।

এছাড়াও এই ধরণের রোগীদের মধ্যে মুড সুইং বা মুড চেঞ্জ দ্রুত দ্রুত ঘটতে পারে। কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে কোন বিষয়ে রেগে যাওয়া বা দুঃখ পাওয়া ডিমেনশিয়ার উপসর্গের মধ্যেই পড়ে। পাশপাশি এমন ব্যক্তির মধ্যে বিরুক্তির ছাপ দেখা দিতে পারে কোন কারণ ছাড়াই। অবশ্য শেষের কিছু উপসর্গ তখনই দেখা যায় যখন এই রোগ বাড়তে শুরু করে। এছাড়াও আইডেন্টিটি ক্র্যাইসিস, ডিপ্রেশন, উদ্বেগ ইত্যাদিও দেখা দিতে পারে।

ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) এর স্টেজ সমূহ

ডিমেনশিয়াকে আমরা চার স্টেজে বিভক্ত করতে পারি।

১. Mild Cognitive Impairment

২. Mild Alzheimer’s

৩. Moderate Alzheimer’s

৪. Severe Impairment

এখানে মনে রাখার মত বিষয় হচ্ছে, এই সমস্ত স্টেজ একটার পর একটা ক্রমান্বয়ে উন্নীত হয়। মানে রোগ যত বৃদ্ধি পায় ঠিক সেভাবেই এক নম্বর স্টেজ থেকে শুরু করে চার নম্বর স্টেজে প্রোগ্রেস ঘটতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

এখন এই চার প্রকারভেদের মধ্যে “Severe Impairment” হচ্ছে বেশি ভয়ানক। এই স্টেজে এসে আক্রান্ত ব্যক্তি তার কমিউনিকেশন ক্ষমতা একেবারে ক্ষয়ে বসতে পারেন। এই ধরণের রোগীর জন্য ফুল টাইম একজন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে হয় যিনি তার নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখবেন। এই স্টেজে এসে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ প্রসাব করতে পারেন নিজের অজান্তে বা বেখেয়ালে। মানে ঠিক এতটাই ভয়াবহ রুপ ধারণ করে।

ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) এর প্রকারভেদ

আমার জানা মতে, ডিমেনশিয়াকে চার ভাগে এই পর্যন্ত ভাগ করা গেছে,

(ক) Alzheimer’s (50% – 75%) – এই টাইপে এসে প্রোটিনের ঘাটতির জন্য মস্তিষ্কের সেল ড্যামেজ হতে পারে। এবং মস্তিষ্কের সাইজ ক্রমাগত ছোট হতে পারে। আর এই কারণেই রোগীর মধ্যে ভুলে যাবার রোগ ক্রমাগত উন্নত হতে পারে।

(খ) Vascular (20% – 30%) – এই টাইপ মিক্স ডিমেনশিয়ার মধ্যে পড়ে।

(গ) Lewy Body (10% – 25%) – এই টাইপের জন্যে মস্তিষ্কের মধ্যে অস্বাভাবিক বিষয়গুলো উন্নত হতে পারে।

(ঘ) Frontotemperal (10% – 15%)

ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) এর কারণ ও রোগ চিহ্নিতকরণ

ইতোমধ্যেই আমি বেশ কিছু কারণ উপরে উল্লেখ করেছি এসব কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে। কিন্তু এর বাইরেও বেশ কিছু কারণ আছে। এখন মস্তিষ্কের কোন সেল তো আর এমনি এমনি আর নষ্ট হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাথায় কোন ইনজুরি ঘটলে এমন হতে পারে। ব্রেন টিউমারও একটি অন্যতম কারণ এই ডিমেনশিয়া হবার পেছনে। এছাড়া স্ট্রোক করলে বা কোনোভাবে নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় মস্তিষ্কের সেল ড্যামেজ হলে ডিমেনশিয়া হতে পারে।

যেহেতু ডিমেনশিয়া বয়েস বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে সেহেতু যারা বয়স্ক তাদের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে পঞ্চাশ বা ষাটোর্ধ মানুষদের মধ্যে এই রোগ হতে দেখা যায়। ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে বা মস্তিষ্কের সিটি স্কানের মাধ্যমে আমরা এই রোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি। এছাড়া কগনিটিভ ডিমেনশিয়া টেস্ট বা মিনি মেন্টালিস্ট এক্সামিনেশনের স্কোর এর মাধ্যমে এই রোগ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) এর রিস্ক কমানোর উপায়

স্মোকিং করা বা অ্যালকোহল নিলে এই রোগের দ্রুত প্রোগ্রেস ঘটতে পারে। তাই এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া নিয়মিত থেরাপি বা ঔষধ গ্রহণ করলে কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোল সম্ভব। পুরোপুরি কখনো এই রোগ থেকে বের হওয়া সম্ভব কিনা এ বিষয়ে আমার কাছে বিশেষ কোন তথ্য নেই। যতদূর জানি, এই রোগের পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাওয়া বা সেরে যাওয়া সম্ভব নয়।

আমি মোটামুটি চেষ্টা করেছি এমন এক ভয়ংকর সমস্যা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার জন্য। এই সংক্রান্ত আরো তথ্য জানা থাকলে অবশ্যই এর প্রতিকার এবং কীভাবে এই রোগ এড়নো যায় সে বিষয়ে নিশ্চয় কমেন্টবক্সে জানাতে ভুলবেন না।

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button