হীরা জ্বলজ্বলে, জল অমূল্য: মূল্যবোধের প্যারাডক্সের বিশ্লেষণ
অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে হীরা ও জলের মূল্যবোধের তুলনা
আপনার নিকট যদি দুটো বস্তু উপস্থিত করে বলা হয় কোনটার দাম বেশি হওয়া উচিত?
- (ক) জল
- (খ) হীরা
উত্তর সহজ হবার কথা ছিলো কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো। আমরা সবাই জানি কোনটার দাম বেশি। কিন্তু বিষয়টি কি একটুও অযৌক্তিক বলে মনে হয় আমাদের কাছে? খুব সম্ভবত নয়। জলের অপর নাম তো জীবন। জল যেখানে নাই সেখানে তো জীবন সম্ভব নয়। ঠিক তেমন করে আমাদের জল ছাড়া বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। ঢাকা, রাজশাহী সহ একাধিক শহরাঞ্চলে জল ক্রয় করে খেতে হয়। কিন্তু জলের মূল্য সবচেয়ে কম। খাবারে আইটেম দুটো কম হলেও চলবে কিন্তু জল না হলে কিন্তু খাবার মুখে দেওয়া সম্ভব নয়।
হীরার মূল্যবোধ
আবার হীরার ক্ষেত্রে বিষয়টি এরকম নয়। হীরা আমাদের নিয়মিত কোন কাজে লাগে না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যা কিছু চাওয়া-পাওয়া সেটা কিন্তু হীরা ছাড়াও পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু তারপরেও হীরার দাম পৃথিবীর যে কোন জায়গায় জলের চেয়ে বেশি, জলের চেয়ে মূল্যবান এবং অনেক অনেক বেশি আকাঙ্খিত বস্তু।
মূল্যবোধের প্যারাডক্স
অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলা হয়, ‘মূল্যবোধের প্যারাডক্স (Paradox of Value)’ বা, ‘ডায়ামন্ড-ওয়াটার প্যারাডক্স (Diamond-Water Paradox)’। একদিকে জল ছাড়া জীবন সম্ভব না হলেও হীরা শুধুমাত্র অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই মূল্যের বিশাল তারতম্যের ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু যুক্তি সামনে পাওয়া যায়। সেটা হলো, জলের বিকল্প কিছু না থাকলেও জলের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ পৃথিবীতে জলের প্রয়োজনীয়তা যতই হোক না কেন এটার দাম সবসময় কম-ই আছে এবং থাকবে।
হীরার চাহিদা ও যোগান
কিন্তু হীরা কে ঘিরে আমাদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির যে সম্পর্ক, যে অভিজাত হবার তীব্র ইচ্ছে তার বিপরীতে হীরার যোগান খুবই কম। এই চাহিদা ও যোগানের অনুপাত অনুযায়ী হীরার মূল্য সবসময় বেশি আছে এবং থাকবে। অর্থনীতির ভাষায় বেশকিছু টার্ম আছে যা আমাদেরকে কিছু ব্যাখ্যা করে এই তত্ত্ব সম্পর্কে। যদিও এ সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন অ্যাডাম স্মিথ তাঁর বিখ্যাত বই ‘The Wealth of Nations (১৭৭৬)’ -এ।
অ্যাডাম স্মিথের মূল্যবোধের প্যারাডক্স
প্রশ্ন হলো, তিনি ‘মূল্যবোধের প্যারাডক্স (Paradox of Value)’ বা, ‘ডায়ামন্ড-ওয়াটার প্যারাডক্স (Diamond-Water Paradox)’ বিষয়ে কী কী পয়েন্ট নিয়ে তাঁর বইতে আলোচনা করেছেন?
ব্যবহারিক মূল্য বনাম বিনিময় মূল্য
১. ব্যবহারিক মূল্য বনাম বিনিময় মূল্য: এখানে ‘Value in USE’ হচ্ছে, বাস্তবতায় আমাদের জন্য যা কিছু প্রয়োজন হয় সেসব বস্তুকে তিনি উল্লেখ করেছেন। যেমন, জলের বিষয়ে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন যে, জল আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জল ছাড়া জীবন সম্ভব নয়। অন্যদিকে, ‘Value in Exchange’ হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করবার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় যে বস্তুর দরকার হতে পারে সেসবের ক্ষেত্রে হীরা হচ্ছে অন্যতম। কারণ বাজারে এর পরিমাণ সীমিত এবং চাহিদা ব্যাপক। এছাড়াও হীরার সাথে সরাসরি আমাদের বেঁচে থাকার কোনোরুপ সম্পর্ক নাই। সুতরাং এমন বস্তু ব্যবসা-বাণিজ্য বা বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত সুবিধার হতে পারে।
অর্থনৈতিক ধারণার উদাহরণ
২. অর্থনৈতিক ধারণার উদাহরণ: অ্যাডাম স্মিথ তিনি তাঁর বইতে বলার চেষ্টা করেছেন যে, কোনো বস্তু তা যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন তার মূল্যের ক্ষেত্রে জরুরী নয় তা কীভাবে নির্ধারিত হবে। এটা ‘Arbitrary (এলোপাতাড়ি)’ -ও হতে পারে। কারণ জল ছাড়াও বাংলাদেশের বাজারে ইলিশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাছ হওয়া সত্ত্বেও এটার মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন অনুযায়ী হয় না বা হচ্ছে না বরং বাজারমূল্য অনুযায়ী হচ্ছে। ঠিক তেমনি প্রয়োজনীয় সব বস্তুর মূল্য নির্ধারণ তার কতটুকু আমাদের প্রয়োজন সে হিসেবে নাও হতে পারে বরং তার বাজারমূল্য অনুযায়ী হবে।
প্রান্তিক উপযোগ তত্ত্বের ভিত্তি
৩. প্রান্তিক উপযোগ তত্ত্বের ভিত্তি: যদিও অ্যাডাম স্মিথ এই তত্ত্ব দেননি কিন্তু তাঁর ‘The Wealth of Nations’ বইতে আলোচনা করছেনে বস্তুর মূল্য নির্ধারণের একটি সুন্দর গ্রাউন্ডওয়ার্ক। পরবর্তীতে তাঁর এই বিখ্যাত বই ধরেই একাধিক অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্ব আমাদের সামনে এনেছেন। এই তত্ত্বের সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, অতি কম প্রয়োজনীয় বস্তুর বাজারে উচ্চ মূলের কারণ ও তার প্রভাব ইত্যাদি।
অর্থনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি
৪. অর্থনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি: এই অংশে স্মিথ বলার চেষ্টা করেছেন, মানুষের আগ্রহ বাজারের ডাইনামিকস্ নির্ধারণ করতে পারে। এ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত একটি উক্তি দেখে নেওয়া যাক,
“Nothing is more useful than water: but it will purchase scarcely anything; scarcely anything can be had in exchange for it. A diamond, on the contrary, has scarcely any use-value; but a very great quantity of other goods may frequently be had in exchange for it.”
- এডাম স্মিথ (The Wealth of Nations)
মনস্তাত্ত্বিক পয়েন্ট
অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি বস্তুর মূল্য নির্ধারণ উপরোক্ত খুবই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় স্পষ্ট না হলেও মনস্তাত্ত্বিক কিছু পয়েন্ট তুলে ধরলাম:
১. দুর্লভতার ধারণা ২. প্রাচুর্য প্রভাব ৩. প্রান্তিক উপযোগ ৪. প্রতীক ও মর্যাদা ৫. সামাজিক মর্যাদা ৬. আবেগমূলক মূল্য ৭. জ্ঞানগত পক্ষপাত ৮. অ্যাঙ্করিং প্রভাব ৯. স্বত্ব প্রভাব
বাংলাদেশের বাজারে ইলিশ মাছের দাম বৃদ্ধির কারণ: অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
ইলিশ মাছ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু মাছ। এটি শুধুমাত্র খাদ্য হিসেবে নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশ মাছের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনৈতিক কারণ
১. সরবরাহ সংকট: ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুম এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এর সরবরাহ কমে যায়। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা কমে যায়, যা দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ২. উচ্চ চাহিদা: ইলিশ মাছের চাহিদা সবসময়ই বেশি থাকে, বিশেষ করে উৎসব এবং বিশেষ উপলক্ষে। উচ্চ চাহিদা এবং সীমিত সরবরাহের কারণে ইলিশের দাম বৃদ্ধি পায়। ৩. রপ্তানি বৃদ্ধি: ইলিশ মাছের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে এর প্রাপ্যতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ার কারণে দেশের বাজারেও এর দাম বৃদ্ধি পায়। ৪. সংরক্ষণ ও পরিবহন খরচ: ইলিশ মাছ সংরক্ষণ এবং পরিবহনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা খরচ বৃদ্ধি করে। এই অতিরিক্ত খরচও ইলিশের দাম বৃদ্ধির একটি কারণ।
মনস্তাত্ত্বিক কারণ
১. দুর্লভতার ধারণা: ইলিশ মাছ মৌসুমী এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলে সহজলভ্য। এর প্রাপ্যতা কম থাকায় মানুষের মনে এর মূল্যমান বৃদ্ধি পায়। দুর্লভতা মানুষের মনে ইলিশের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। ২. প্রান্তিক উপযোগ: মৌসুমী এবং উৎসবের সময় এর প্রান্তিক উপযোগ বৃদ্ধি পায়। ৩. সামাজিক মর্যাদা: ইলিশ মাছ খাওয়া সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ। বিশেষ উপলক্ষে ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে, যা এর প্রতীকী মূল্য বাড়ায়। এটি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ৪. আবেগমূলক প্রভাব: বিশেষ উপলক্ষে এবং উৎসবে ইলিশ মাছ খাওয়ার কারণে এর মানসিক প্রভাব মানুষের মনে বৃদ্ধি পায়। মানুষ এটিকে বিশেষ এবং মূল্যবান হিসেবে দেখে।
কার্যকর পদক্ষেপ
ইলিশ মাছের দাম নিয়ন্ত্রণে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. প্রজনন মৌসুমে সঠিক নিয়ন্ত্রণ: প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে এবং সরবরাহ সংকট কমবে। ২. সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি: ইলিশ মাছ সংরক্ষণ এবং পরিবহনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে সংরক্ষণ ও পরিবহন খরচ কমবে এবং বাজারে ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ৩. রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ: ইলিশ মাছের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে দেশের বাজারে এর প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশের বাজারে ইলিশের দাম কমবে। ৪. সচেতনতা বৃদ্ধি: ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুম এবং এর সংরক্ষণ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর ফলে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা কমবে এবং ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার
ইলিশ মাছের দাম বৃদ্ধির পেছনে অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক উভয় কারণই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরবরাহ সংকট, উচ্চ চাহিদা, রপ্তানি এবং পরিবহন খরচের পাশাপাশি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও ইলিশের দাম বৃদ্ধির কারণ। এই কারণগুলো বিবেচনা করে ইলিশ মাছের দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর ফলে ইলিশ মাছের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.