অনলাইন

মেয়েদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং: স্বাধীনতার নতুন দিগন্ত

ফ্রিল্যান্সিং কি? সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং মেয়েদের জন্য এর গুরুত্ব

ফ্রিল্যান্সিং কি?

ফ্রিল্যান্সিং বলতে বোঝায় কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে স্থায়ী না থেকে স্বাধীনভাবে নিজের মত কাজ করা। বর্তমানে কন্ট্রাক্ট ভিত্তিক কাজ বোঝানো হয় এই ফ্রিল্যান্সিং শব্দটি দ্বারা। এই ক্ষেত্রে তার নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে।

আরও সহজ ভাবে ফ্রিল্যান্সিং বলতে বোঝায়, কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে না থেকেই যখন কোনো ব্যক্তি তার নিজের দক্ষতা, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একাধিক ক্লায়েন্টের কাজ করে তখন ওই কাজকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সিং। আর সেই ব্যক্তিকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার।

এই কাজের সবচেয়ে বড় একটি দিক হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কাজগুলো ঘরে বসেই করা যায়।

মেয়েরা কেন ফ্রিল্যান্সিং করবেন?

ফ্রিল্যান্সিং শেখা সব মানুষের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি তা ধনী ব্যক্তির ক্ষেত্রেও। জীবনে যারা বড় কিছু করতে পেরেছে, তা অবশ্যই কাজের মাধ্যমেই করতে সফল হয়েছে। ঘরে থেকেও ভালো কিছু করা সম্ভব এই ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে। চলুন জেনে আসি ফ্রিল্যান্সিং মেয়েদের জন্য কেনো গুরুত্বপূর্ণ?

১. ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ভয়

বর্তমানে ধর্ষণের সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। এর ফলে ঘরের বাইরে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এতটাই এই ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে যে, নারীদের জন্য বাইরে কাজ করা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, বরং সুযোগটাও কমে আসছে।

তাই নিরাপদে ঘরে বসে কাজ করার এমন একটা পথই খোলা আছে। আর তা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং।

২. পুরুষতান্ত্রিক সমাজ

অনেক সময় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলেরা চায় যে, মেয়েরা ঘরে থাকুক। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই ধারণাটার অনেক বদল হয়েছে। এখন অনেক পুরুষই চায় তার স্ত্রী বাইরে কাজ করুক। কিন্তু যদি কেউ একান্তই বাইরে যেতে না চায়, তাহলে সে ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে উপার্জন করতে পারবে। ফ্রিল্যান্সিং ঘরে বসে উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ার।

এর ফলে পুরুষের পাশাপাশি আপনিও পরিবারের জন্য কাজ করতে পারবেন এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে যথেষ্ট ভূমিকাও রাখতে পারবেন।

৩. পর্দা প্রথা মেনেও কাজ করা সম্ভব

বাংলাদেশ সহ আরও অনেক দেশের মেয়েরা পর্দা করে। আর বাড়ির বাইরে গিয়ে তাদের জন্য কাজ করাটা প্রায় অসম্ভব। তাই সেই ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিং শিখলে ঘরে বসেই কাজ করতে পারবেন সেই সকল নারীরাও। এতে যেমন তাদের পর্দা ভঙ্গ করা হবে না তেমনি তারা স্বাবলম্বীও হতে পারবে।

২০০ প্রকারেরও বেশি কাজ রয়েছে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। এর যেকোনো একটি কাজ শিখে আপনারা ফ্রিল্যান্সার লাইফ শুরু করতে পারেন। একবার অনলাইনে কাজ শিখে নিলে তারপর অনেকটায় সহজ হয়ে যায়। তখন আর সারাদিন মোবাইল বা কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকার প্রয়োজন হবে না।

কোনো একটা কাজ যখনই পাবেন তখনই শুধু কাজটা করবেন। এমন অনেক সফল মেয়ে ফ্রিল্যান্সার আছে অনলাইনে। আপনারা চাইলে তাদেরও অনুসরণ করে দেখতে পারেন।

ফ্রিল্যান্সিং এর সুবিধাগুলো কি কি?

১. স্বাধীনতা ভাবে কাজের সময় নির্ধারণ করা যায়। কোন প্রাতিষ্ঠানিক বাঁধাধরা নিয়ম নেই। যখন ইচ্ছা কাজ করা যায় নিজের সুবিধা মতো।

২. প্রাতিষ্ঠানিক অফিস না হওয়ায় কাজের স্থান নিজের সুবিধা মতো নির্ধারণ করা যায়। যেকোন স্থানেই এটা হতে পারে।

৩. শুধু ভাল মানের ল্যাপটপ বা কম্পিউটার, কিছু সফটওয়্যার, নিরবিচ্ছিন্ন ও দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং বৈদেশিক অর্থ লেনদেনের জন্য অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন হয় এই কাজ শুরু করতে

৪. এর গ্রাহক সংখ্যা অগণিত এবং কাজের সুযোগও বেশি। কারণ এই ব্যবসার ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী। তাই কখনো থেমে থাকতে হয় না।

৫. এখানে যোগ্যতা এবং দক্ষতার মূল্য অনেক বেশি। যা স্থানীয় বাজারে কয়েকগুণ কম হবে।

নারীদের অংশগ্রহণ কম কেন?

১. ফ্রিল্যান্সিং জগত সম্পর্কে মেয়েরা কম জানে

অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ অনেকটা কম। মেয়েরা পড়াশোনা বেশিদূর চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না, সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে। নারীরা যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রেই অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, সেখানে প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পর্কে তারা অজ্ঞাত থাকবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

অথচ বাংলাদেশের মেয়েরা কম মেধাবী নয়। তারা একটু সুযোগ পেলেই পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় খাতেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। আমাদের দেশের মেয়েরা ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে খুব কম জানে।

কারণ তারা যথেষ্ট প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পর্কে অবগত নয়। যার ফলে এতো সুযোগ থাকার পরেও সম্ভাবনাময় এই খাতে তাদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। যা কখনই একটি দেশের জন্য কাম্য নয়।

২. আত্মবিশ্বাস অনেক কম

কিছু কমন প্রশ্ন, “আমি কি পারবে?” বা “লোকে কি বলবে?” এই সকল প্রশ্নগুলোর জন্যই মেয়েরা এই ফ্রিল্যান্সিং এ এতো বেশি পিছিয়ে। অধিকাংশ মেয়েই বর্তমানের এই আধুনিক যুগে এসেও এই চিন্তাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

ফলে যেকোন কাজ শুরুর পূর্বেই বিভিন্ন নেতিবাচক ধারণাগুলো তাদের সফলতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান সহ আরও অন্যান্য দেশে অনেক সফল মেয়ে ফ্রিল্যান্সার আছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সাথে ফ্রিল্যান্সিং করছে।

তাই আত্মবিশ্বাস আনাটা সবচেয়ে বেশি জরুরী। পারিবারিক অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তারা যেভাবে ফ্রিল্যান্সিং এ বেশ ভালো সফলতা অর্জন করছে, ঠিক একই ভাবে আপনার দ্বারাও সম্ভব।

৩. কীভাবে শুরু করবেন তা জানেন না

একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হল অনলাইনে এই কাজগুলো কীভাবে শুরু করবে তা অনেকেই জানে না। অথচ অনেক মেয়েদেরই ইন্টারনেট সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আছে অথবা অনেক মেয়েরাই কিছু কিছু কাজও জানে। শুধু শুরু করবে কিভাবে তা জানে না।

অনেক সময় দোখা যায় যে, কিছু শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেয়ে নিজেদের জাহির করতে বেশি পছন্দ করে। এবং তা করেও থাকে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের সেভাবে শেখা হয় না কিছুই। আগ্রহ থাকা সত্বেও অনেক মেয়েরা এই পেশায় আসতে পারে না। এর কারণ হলো ভালো শিক্ষকের অভাব।

৪. সঠিক গাইড লাইনের অভাব

ফ্রিল্যান্সিং মানেই ওয়েব ডিজাইন কিংবা গ্রাফিক ডিজাইন বলে মনে করে থাকে অনেকেই। তারা ভাবে, তারা তো এগুলোর কিছুই পারে না। তাহলে তারা কিভাবে কাজ করবে? কিন্তু তাদের এই ধারণা একদমই সঠিক নয়। ফ্রিল্যান্সিং মানেই শুধুমাত্র ওয়েব ডিজাইন কিংবা গ্রাফিক ডিজাইন নয়। এগুলো ফ্রিল্যান্সিং এর দুইটি কাজের নাম মাত্র।

প্রকৃতপক্ষে, ফ্রিল্যান্সিং অনেক বৃহৎ একটি ধারণা। আপনি যেকোনো কাজের মাধ্যমেই ফ্রিল্যান্সিং দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারেন। যেমন; ভালো লিখতে জানা। যদি কেউ ভালো লিখতে পারে তবে সে আর্টিকেল লেখার কাজ পাবে। যদি কেউ ভালো ছবি আঁকতে জানে, তাহলে সে এখানে আর্টিস্টের কাজ পাবে।

আবার যদি কারো ভয়েস অনেক সুন্দর হয় তাহলে বিভিন্ন ভিডিওতে তার কণ্ঠ ব্যবহার করেও উপার্জন করতে পারবে। সুতরাং ফ্রিল্যান্সিং এমন এক অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র যেখানে সকল মেধা ও প্রতিভারই মূল্য দেওয়া হয়। যার ফলে যোগ্যতা অনুসারে ব্যক্তি কোন না কোন কাজ ঠিকই পেয়ে যাবে।

তাই বলা যায় যে, বর্তমান সময়ে ফ্রিল্যান্সিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনাময় সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েদের জন্য।

ফ্রিল্যান্সিং এর কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)

১. ফ্রিল্যান্সিং কি নিরাপদ?

হ্যাঁ, ফ্রিল্যান্সিং নিরাপদ। বিশ্বের অনেক মানুষ ফ্রিল্যান্সিং দিয়ে তাদের জীবন যাপন করে। তবে, কিছু সাবধানতা মেনে চললে আরও নিরাপদ হয়।

২. ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে কি কি লাগবে?

ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে একটি ভাল মানের ল্যাপটপ বা কম্পিউটার, কিছু সফটওয়্যার, নিরবিচ্ছিন্ন ও দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং বৈদেশিক অর্থ লেনদেনের জন্য অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন হয়।

৩. ফ্রিল্যান্সিং এ কি কি কাজ করা যায়?

ফ্রিল্যান্সিং এ অনেক ধরনের কাজ করা যায়, যেমন ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইন, কন্টেন্ট রাইটিং, ভয়েস ওভার, ভিডিও এডিটিং ইত্যাদি।

৪. ফ্রিল্যান্সিং এ কতটা উপার্জন করা যায়?

ফ্রিল্যান্সিং এ উপার্জন কতটা হবে তা আপনার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং কাজের ধরনের উপর নির্ভর করে। অনেকেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেশ ভালো উপার্জন করতে পারে।

৫. ফ্রিল্যান্সিং এ কি কি সুবিধা আছে?

ফ্রিল্যান্সিং এ অনেক সুবিধা আছে, যেমন স্বাধীনতা ভাবে কাজের সময় নির্ধারণ করা যায়, কাজের স্থান নিজের সুবিধা মতো নির্ধারণ করা যায়, গ্রাহক সংখ্যা অগণিত এবং কাজের সুযোগও বেশি।

উপসংহার

ফ্রিল্যান্সিং একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র যেখানে মেয়েরা নিজেদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করতে পারে। এটি নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাধীন কাজের সুযোগ প্রদান করে। ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে মেয়েরা পর্দা প্রথা মেনেও কাজ করতে পারে এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালন করেও আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে পারে। তাই, মেয়েরা যদি ফ্রিল্যান্সিং এ আগ্রহী হয়, তাহলে তারা এই ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে এবং নিজেদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারবে।

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button