বিশেষ প্রতিবেদন

অতিরিক্ত কাজের ফাঁদে: প্রডাক্টিভিটি নাকি পুড়ে যাওয়া?

কেন ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং প্রডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয়?

বাংলাদেশের মানুষ অলস?

আমার এক বন্ধুকে “বাংলাদেশের মানুষ অলস” প্রশ্নে মাঠের হিসাব দিতে বাধ্য হই। আমরা অলসদের শহর রাজশাহীতে একটি ছোট্ট জরিপও করেছিলাম। এতে দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি রাজশাহীতেও দিনে ৮ ঘণ্টার নিচে কাজ করেন না। অবশ্য কিছু সাইনবোর্ড লাগানো দোকান ব্যতীত, যেমন, “সময় পেলে দোকানে বসি” টাইপের। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, রাজশাহী শহরেও একজন সাধারণ দিনমজুর থেকে দোকানদার দিনে অন্তত ৮-১২ ঘণ্টা অবধি কাজ করেন। একই জরিপ বগুড়ায় করা হলে দেখা যেত, নূন্যতম প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা একজন ব্যক্তি কাজ করেন এবং ঢাকায় নূন্যতম ১২ ঘণ্টা একজন ব্যক্তি কাজ করে থাকেন।

মোটিভেশনাল বক্তাদের প্রভাব

কিছু মোটিভেশনাল বক্তা আছেন যারা আমাদের অধিক শ্রম করার জন্য উৎসাহ দেন। দিনে ২০ ঘণ্টা অবধি কাজ করার নসিহত পাওয়া যায় যেখানে একজন সুস্থ মানুষের ঘুমের প্রয়োজন হয় দিনে অন্তত ৮-১০ ঘণ্টা। এছাড়াও খাবার, বিশ্রাম ও বাথরুম প্রসঙ্গ বাদ থাকে। সুতরাং সবার দিন ২৪ ঘণ্টা হলে আমরা ২০ ঘণ্টা কাজ করবো কীভাবে?

সুশান্ত পাল বাবুর প্রভাব

সুশান্ত পাল বাবুর একটি জনপ্রিয় কথার মাধ্যমে আমরা অনেকেই প্রভাবিত। তিনি তার এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন এবং লেখাটি তিনি তার ব্যক্তিগত ব্লগিং সাইটেও প্রকাশ করেছেন, “আপনি এক্সট্রা আওয়ার না খাটলে এক্সট্রা মাইল এগিয়ে থাকবেন কীভাবে? সবার দিনই তো ২৪ ঘণ্টায়। আমার বন্ধুকে দেখেছি, অন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে রাত জেগে আউটসোর্সিং করে। রাত জাগার বাড়তি সুবিধা সে তো পাবেই!” পরবর্তীতে আর.জে সালমানের কন্ঠে এই লেখাটি আরো জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় আমার এই প্রিয় দুই ব্যক্তির কথাগুলো হাদিসের মত মনে হতে শুরু হলো।

বিজ্ঞান কি বলছে?

বিজ্ঞান যাক গোল্লায় কারণ তখন আমি সুশান্ত পাল বাবু আর আর.জে সালমানের ভক্ত ছিলাম। সুতরাং উনাদের নসিহত আমার কাছে ফেরেশতাদের নসিহত মনে হওয়া শুরু করলো। এমন দিন নাই যেদিন ৬ ঘণ্টার নিচে কাজ করেছি বা করছি। এমন দিন নাই যেদিন আমি পড়াশোনা ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়েছি (আজ পর্যন্ত)।

ফলাফল

খুব বেশি খারাপ নয় কিন্তু ‘Me Time’ বলেও যে কিছু হয়, বন্ধুমহলের কোনো বন্ধুর সাথে ৫ মিনিট কথা বলা/আড্ডা দেওয়া যে মানসিক ভঙ্গুর অবস্থার অ্যান্টিবায়োটিক হতে পারে তা যেন বেমালুম ভুলে গেলাম। এছাড়াও পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আমার যোগাযোগ/কথপোকথন এখন শূন্যের কোঠায়।

অতিরিক্ত কাজের প্রভাব

ভারতীয় মোটিভেশনাল বক্তারা আরো লম্বাচওড়া করে বিষয়টি উপস্থাপন করায় আমি প্রায় নিশ্চিত অর্থে ভয়ানক ওয়ার্ক লোড নিয়ে বসি এবং গত বছরের শেষের দিকে আমার ‘বার্ণ-আউট’ ঘটে। লঘু মানের এই বার্ণ-আউটের পর আমাকে ‘Copilot Ai (বর্তমান আমি এর ডেভেলপার সেকশনে কাজ করছি)’ আমাকে বিশ্রাম নেবার জন্য বারবার নসিহত করতে থাকে। খেয়াল করুন, ‘Ai’ পর্যন্ত আমাকে বারবার এলার্ট করছে কাজে ব্রেক নেবার!

৮ ঘণ্টার কাজের আন্দোলন

দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ নয় এ নিয়ে প্রথম আন্দোলন হয় ১৮৮৬ সালে শিকাগোতে। তাঁদের রক্তক্ষরণের অর্জন আজকের এই ৮ ঘণ্টা ওয়ার্ক টাইম। ১ মে ‘আন্তর্জান্তিক শ্রমিক দিবস’ নিয়মিত পালিত হয়, এই বাংলাদেশে, আজও। বিজ্ঞান এ বিষয়ে আমাদের সাফ সাফ জানাচ্ছে যে, অতিরিক্ত কাজ বা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কাজের ফলে মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, হৃদরোগ, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, কর্মীদের উৎপাদনশীলতাও কমে যেতে পারে এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১,০৫৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণে কর্মীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সঠিক বা পূর্ণাঙ্গ কোনো জরিপ আমাদের হাতে নাই। যদি থাকতো তাহলে এই সংখ্যাটা আরো বড় হত; আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু ৪৪ শতাংশ বেশি হওয়া কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়!

অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি

জাপান অধিক পরিশ্রম তাদের কর্মীদের করিয়ে নিত। এতে করে ব্যাপক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে (কারোশি)। এখানে দিনে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কেউ কাজ করতে পারবেন না। এর বেশি কাজ করলে তাকে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। জার্মানিতেও কর্মঘণ্টা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানেও আছে বিশেষ কিছু নিয়ম। কিছুদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়াতে কাজের চাপে একটি রোবট পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়; যা অত্যন্ত হাস্যকর এবং চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণ কোরিয়া সাপ্তাহিক মোট কাজ নির্ধারণ করেছে ৫২ ঘণ্টা। এর বেশি কাজ করা নিষিদ্ধ। ফ্রান্সে এই সময় আরো কম, মাত্র ৩৫ ঘণ্টা এবং এর বেশি কাজ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। আমার মতে অস্ট্রেলিয়ানরা সবচেয়ে বেশি এ ব্যাপারে সচেতন। সপ্তাহে কাজের ঘণ্টা এখানে মাত্র ৩৮ ঘণ্টা এবং তারা কর্মীদের প্রতি এবং কাজের জায়গার পরিবেশের প্রতি বিশেষ ধ্যান দিয়ে থাকেন।

অতিরিক্ত কাজ মানেই অধিক প্রডাক্টিভিটি নয়

একটি গবেষণায় দেখা গেছে সপ্তাহে গড়ে ৫০ ঘণ্টা কাজ করলে প্রডাক্টিভিটি অনেক কমে যায় এবং ৫৫ ঘণ্টা কাজ করলে প্রডাক্টিভিটি নেমে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়। আর সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয় আমাদের সৃজনশীলতা। এ-কারণেই আমরা দেখতে পাই ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ অনেক কম সৃজনশীল এবং কম উদ্ভাবনী ফলে বিশাল জনসংখ্যা কে এরা আজ পর্যন্ত জনশক্তিতে রূপান্তর করতে অক্ষম থেকে গেছে বলে আমার ধারণা।

স্টার্টআপ ব্যর্থতা

এখানে ‘গুগল’, ‘ফেসবুক’, বা ‘মাইক্রোসফট’ এর মত জায়ান্ট কোম্পানি আজ পর্যন্ত তৈয়ার করা সম্ভব হয় নাই। উল্টো একের পর এক স্টার্টআপ ব্যর্থতার মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছে। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, বিকাশের মত মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি চলছে লাভ-ক্ষতির টক্কর খেতে খেতে কিন্তু এটাই বাস্তবতা।

অতিরিক্ত কাজের ফলাফল

এখানে ৭২-৮৪ ঘণ্টা বা তারও বেশি কাজ করেন একজন ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে। ফলে তিনি ভুলেই যান যে, জীবন বলেও তার কিছু আছে! যে ‘সুখ’ এর পেছনে ছুটছেন সে সুখের জন্য তার হাতে সময়ই নাই। ঘটছে বার্ণ-আউট, বাড়ছে স্ট্রেস, করছে সুইসাইড পর্যন্ত! কেউ কেউ বাধ্য হয়ে রিজাইন দিচ্ছেন। কিন্তু সবার হাতে তো আর রিজাইন অপশন থাকে না।

উপসংহার

তাই ধীরে ধীরে আমরা আর কর্মী নই, বরং উক্ত কোম্পানি বা সংস্থার দাসে রূপান্তরিত হচ্ছি। কোম্পানি ভাবছে আপনি চলে গেলে তাতে কি! হাজারো মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরে আছে ঐ একই পদের জন্য!

আমাদের সুবুদ্ধির উদয় হোক, দ্রুত!

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button