বিশেষ প্রতিবেদন

আদিবাসী বনাম উপজাতি: বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ও সার্বভৌমত্ব

বাংলাদেশে আদিবাসী ও উপজাতি শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের ঐতিহাসিক ও আইনি প্রেক্ষাপট

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী (Indigenous)’ ও ‘উপজাতি” (Tribe)’ শব্দদুটির ব্যবহার, জাতীয়তাবাদ, এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই আলোচনায় অনেকেই আবেগ বা অর্ধসত্যের ভিত্তিতে অবস্থান নিচ্ছেন, যা সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এই সংকটের মূলে রয়েছে ঐতিহাসিক দাবি, আন্তর্জাতিক আইন, এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা।

‘আদিবাসী’ শব্দটি বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ ‘আদি’ (প্রাথমিক, মূল) ও ‘বাসী’ (বাসিন্দা) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘মূল’ বা ‘প্রাচীন বাসিন্দা’। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘Indigenous’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলায় ‘আদিবাসী’ ব্যবহৃত হয়। তবে এই শব্দটির ব্যবহার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে (যেমন ভারত ও বাংলাদেশ), যেখানে সরকারি পর্যায়ে ‘আদিবাসী’ শব্দের স্বীকৃতি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।

জাতিসংঘের ILO Convention 169 এবং UNDRIP অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য হলো। তাদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা, স্ব-পরিচয় এবং ভূমি ও সম্পদের সাথে সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিন্নতা এবং ভূমি ও সম্পদের অধিকার ধরে রেখেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং ভূমি ও সম্পদের উপর নির্ভরশীল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, ভারত সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দের পরিবর্তে ‘Scheduled Tribes’ ব্যবহার করে, কারণ ভারতের সব সম্প্রদায়ই আদি বাসিন্দা। বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ শব্দটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য ব্যবহৃত হলেও সরকারি ভাবে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বলা হয়।

আদিবাসী ও উপজাতি: সংজ্ঞার পার্থক্য ও প্রাসঙ্গিকতা

  • উপজাতি (Tribe):
    • একটি বৃহত্তর সমাজের অংশ, কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামোতে স্বতন্ত্র।
    • বাংলাদেশে উপজাতি বলতে পার্বত্য চট্টগ্রামেরচাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো এবং সমতলের সাঁওতাল, ওরাওঁ, গারো প্রভৃতি সম্প্রদায়কে বোঝায়।
    • সংবিধানে এদেরক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে (অনুচ্ছেদ ২৩ক)।
  • আদিবাসী (Indigenous):
    • আন্তর্জাতিক আইন (UNDRIP, ২০০৭) অনুযায়ী, আদিবাসীরা হলো কোনো অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা যারা বহিরাগত উপনিবেশ বা আধিপত্যের সম্মুখীন হয়েছে।
    • তাদের দাবি: ভূমির মালিকানা, স্বায়ত্তশাসন, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি।
    • বাংলাদেশ সরকারআদিবাসী শব্দটি এড়িয়ে যায়, কারণ এটি ভূমি অধিকারের দাবিকে শক্তিশালী করতে পারে।

ঐতিহাসিক পটভূমি: কে কতটা প্রাচীন?

  • বাঙালি জাতির উৎস:
    • আধুনিক বাঙালি জাতির গঠন শুরু হয় আনুমানিক ১,২০০-১,৫০০ বছর আগে, আর্য-অনার্য ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মিশ্রণে।
    • প্রাচীন নগরীপুন্ড্রনগর (মহাস্থানগড়) প্রায় ২,৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল, যা বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত।
  • পার্বত্য অঞ্চলের গোষ্ঠীগুলির আগমন:
    • চাকমা, মারমা, মগ:মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে ১৬-১৭শ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন শুরু করে।
    • ম্রো:আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করে।
    • বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে বাঙালিরাই দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করলেও পার্বত্য গোষ্ঠীগুলির ইতিহাসও কয়েকশত বছরের।

বিতর্কের মূল ইস্যু: আদিবাসী স্বীকৃতি কেন প্রত্যাখ্যাত?

  • সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন:
    • সরকারের যুক্তি: ‘আদিবাসী’ শব্দটি আন্তর্জাতিক আইন (UNDRIP) অনুসারে, স্বায়ত্তশাসন বা ভূমি অধিকারের দাবিকে বৈধতা দিতে পারে, যা রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হুমকি।
    • পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরও অস্থিরতা চলমান। জেএসএস, ইউপিডিএফ-এর মতো গোষ্ঠীর বিদ্রোহী কার্যক্রম (হামলা, চাঁদাবাজি) রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ।
  • সংবিধান ও জাতীয়তাবাদ:
    • সংবিধানে বাংলাদেশকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ -এর ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
    • ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি বহুজাতিক পরিচয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যা রাষ্ট্রীয় একত্বের সাথে সাংঘর্ষিক।

সাম্প্রতিক সংঘাত ও পাঠ্যপুস্তক বিতর্ক

  • ২০২৩-২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন:
    • ২০২৩ সালে সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দটি অপসারণ করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ব্যবহার করে। আদিবাসী সংগঠনগুলির বিক্ষোভ এবং সহিংসতা।
    • ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সালে গ্রাফিতি নিয়ে সমস্যা এবং আদিবাসী সংগঠনগুলির বিক্ষোভ ও পাল্টা বিক্ষোভে সহিংসতা।
  • মনিপুর ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ:
    • প্রতিবেশী অঞ্চলে জাতিগত সংঘাত (যেমন: ভারতের মনিপুর, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট) বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে।
    • সরকারের আশঙ্কা: আদিবাসী দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

উপজাতি সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য: বাস্তবতা ও করণীয়

  • ভূমি ও উন্নয়ন সংকট:
    • পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বন্দোবস্ত জটিলতা, বাঙালি বসতি স্থাপন, এবং স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য উত্তেজনার কারণ।
    • সমতলের সাঁওতাল, ওরাওঁ সম্প্রদায়ের জমি দখল ও সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনক।
  • সমাধানের পথ:
    ১.ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা।
    ২. সাংবিধানিক স্বীকৃতি: ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’দের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা।
    ৩. শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন: ১৯৯৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী স্থানীয় পরিষদগুলিকে ক্ষমতা হস্তান্তর।

সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ

  • আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা:
    • UNDRIP-এ বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করা (বর্তমানে এটি অনুসমর্থন করেনি)।
    • বিদেশি এনজিও ও মানবাধিকার সংস্থার কার্যক্রম মনিটরিং।
  • সামাজিক সম্প্রীতি শক্তিশালীকরণ:
    • মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহুসংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা শেখানো।
    • উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ।

ঐক্য নাকি বিভাজন?

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো জাতিগত পরিচয়ের জটিলতাকে সামাজিক বিভাজনে পরিণত না করে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা। আদিবাসী বনাম উপজাতি বিতর্কের সমাধান হতে পারে কেবল ন্যায়ভিত্তিক নীতি, আইনের শাসন, এবং সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে। একই সাথে, রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো গোষ্ঠীর অধিকারের নামে ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার সুযোগ নেই।

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button