মুদ্রাস্ফীতি: বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ
মুদ্রাস্ফীতির কারণ, প্রকারভেদ ও এর নেতিবাচক প্রভাব
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো বিশ্বের বাজার ব্যবস্থা চলছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি সমস্যার নাম হলো মুদ্রাস্ফীতি। এটি যখন কোনো এলাকা বা দেশে হয় তখন সেখানের পণ্য ও পরিষেবার মানের বিনিময়মূল্য কমে যায়।
আর সাধারণ মানুষেরা অনেক কিছু কিনতে হিমশিম খান। কারণ এটির মাধ্যমে সাধারণভাবে পণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়ে যায়। অর্থাৎ, মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে পণ্য বা সেবার দাম বেড়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয় কাঙ্ক্ষিত পণ্য পাওয়ার জন্য।
সব মিলিয়ে এটি অর্থনীতিতে ইতিবাচকতার চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব বেশি ফেলে দেয়। নিচে এটির কারণ ও প্রকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
মুদ্রাস্ফীতি কি?
মুদ্রাস্ফীতি মূলত অর্থনীতির একটি টার্ম। ফলে অর্থনীতির ভাষায় এটিকে যদি বলা হয় তাহলে এমন যে, কোনো অবস্থায় পণ্য-সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে গেলে তখন সেটিকে মুদ্রাস্ফীতি বলে।
সাধারণত পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐ পণ্য ক্রয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে আগের পরিমাণ পণ্য কিনতে গেলে পরিমাণে কম পাওয়া যায়।
সুতরাং, মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। একই ভাবে অর্থনীতিতে পণ্যের আসল বিনিময়মূল্য কমে যায়। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি সূচকের মাধ্যমে হিসাব করা হয় যাকে মুদ্রাস্ফীতি সূচক বলা হয়।
উদাহরণ
- ২০২১-২২ অর্থবছরে: রেস্টুরেন্ট থেকে একটি বার্গার কিনতে মূল্য দিতে হয় ১০০ টাকা।
- পরের অর্থবছরে: মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায় ১০ শতাংশ তাহলে একই বার্গার কিনতে খরচ হবে ১১০ টাকা।
মুদ্রাস্ফীতির কারণ
মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার কারণ মূলত দুটি। তা হলো:
- চাহিদা
- মূল্য
চাহিদা জনিত কারণ
বাজারে যখন কোনো পণ্য বা সেবার চাহিদা বেড়ে যায় তখন সেটির দামও বেড়ে যায়। ফলে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যখন পণ্যের পরিমাণের তুলনায় চাহিদা অধিক হারে বেড়ে যায়। এটি হওয়ার জন্য কয়েকটি কারণ লক্ষ্য করা যায়:
- কালোবাজারি বেড়ে গেলে
- কালো টাকা বেশি হলে
- সরকারের খরচ বৃদ্ধি হলে
- বৈদেশিক ঋণের মাত্রা বেড়ে গেলে
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে
মূল্য জনিত কারণ
একটি পণ্য তৈরি করতে মূলত চারটি জিনিসের প্রয়োজন হয়। তা হলো:
- ভূমি
- মজুর
- ক্যাপিটাল
- উদ্যোগ
এই চারটির মূল্যকে এক কথায় বলা হয় ফ্যাক্টর প্রাইস। এটি বেশি হলে তখন পণ্যের দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। এরপর সরকারি অপ্রত্যক্ষ কর আরোপ করে।
পরবর্তীতে এটির মার্কেট প্রাইস ধরে বাজারজাত করা হয়। এসময় সরকার আবার ট্যাক্স বসালে সেটির দাম বেড়ে যায়। এছাড়া আরো কিছু কারণে মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে সেসব নিম্নে দেওয়া হলো:
- মজুরির দাম বৃদ্ধি
- একচেটিয়ে ব্যবসা করার ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার
- প্রাকৃতিক নানা ধরনের দুর্যোগ
মুদ্রাস্ফীতির প্রকারভেদ
১. চাহিদা-পুল মুদ্রাস্ফীতি
কোনো পণ্যের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু সেই অনুপাতে তার উৎপাদন অথবা যোগান বাড়েনা বা অপরিবর্তিত থাকে, তখন সেই দ্রব্যের দাম বাড়ে। করোনা পরিস্থিতিতে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বহুগুণ বেড়েছে।
এর কারণ লকডাউনের ফলে শ্রমিক, কাঁচামাল ইত্যাদির যোগান বা সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত। উৎপাদনশীলতা ধাক্কা খেয়েছে, এদিকে চাহিদা খুব একটা কমেনি। কারণ খাদ্য মানুষের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন।
২. উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি
যখন কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রীগুলো লাগে তার দামের যখন বৃদ্ধি ঘটে, তখন সামগ্রিকভাবে দ্রব্যটির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এছাড়া যদি সরকার ট্যাক্স বাড়ায় তাহলেও জিনিসের দাম বাড়বে।
আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। খনিজ তেলের দাম বাড়া মানেই ট্রান্সপোর্ট বা পরিবহনের দাম বেড়ে যাওয়া।
৩. হাইপারইনফ্লেশন
যখন মূল্যবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, তখন তাকে বলে ‘হাইপারইনফ্লেশন’। মাসিক মূল্যবৃদ্ধির হার অন্তত ৫০% হলে তবেই এই সঙ্কটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। হাইপারইনফ্লেশন ঘটার প্রধান কারণই হল সরকার কর্তৃক অনিয়ন্ত্রিতভাবে নোট ছাপানো।
যত বেশি নোট ছাপানো হতে থাকে, তত বেশি টাকা লোকের পকেটে আসে, অন্যদিকে উৎপাদন সীমিত। এর ফলে চাহিদার পরিমাণ বাড়ে, সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সেই বৃদ্ধিকে সামাল দিতে সরকার আবার নোট ছাপালে, মুদ্রাস্ফীতি আরো বেড়ে যায়।
স্বাভাবিকভাবেই হাইপারইনফ্লেশনের ফলে স্টক মার্কেটের দাম বেড়ে যায় এবং একই সাথে ব্যক্তির জমানো পুঁজির মূল্যের অবনমন ঘটা অথবা তার সঞ্চিত অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
পরিশেষ
সুতরাং দেখা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থনীতিতে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদি মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলো সঠিকভাবে বোঝা যায় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যাবে।
আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.