স্বাস্থ্য

অনিদ্রা (ইনসোমনিয়া): কারণ, প্রভাব এবং মুক্তির উপায়

অনিদ্রার কারণ ও প্রভাব, হরমোনাল ইমব্যালেন্স এবং অনিদ্রা থেকে মুক্তির ১০টি কার্যকরী উপায়

- Advertisement -

অনিদ্রা (ইনসোমনিয়া) একটি ঘুমের ব্যাধি যার কারণে মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়। ইচ্ছে অনুযায়ী ঘুমাতে না পারা বা অনিয়মিত ঘুম হওয়াকে সাধারণত আমরা অনিদ্রা বলে থাকি। এই ব্যধিটি স্বল্পমেয়াদি (Acute) বা দীর্ঘস্থায়ী (Chronic) হতে পারে। স্বল্প মেয়াদী ইনসোমনিয়া (অনিদ্রা) এক রাত থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা

যদি সপ্তাহে অন্তত তিন রাত অনিদ্রা হয় এবং এটি তিন মাস অথবা এর বেশি স্থায়ী হয় তখন এটাকে দীর্ঘস্থায়ী (Chronic) অনিদ্রা বলে। অনিদ্রার ফলে সাধারণত রাতে ঘুম হয় না অথবা সঠিকভাবে হয় না। যার ফলে আমাদের শরীর ও মনে নানা রকম সরল থেকে জটিল রোগ বাসা বাঁধতে পারে।

রাতে ভালো ঘুম না হওয়ার কারণে দিনে কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ প্রদানে ব্যাঘাত ঘটে। অলসতা, দুশ্চিন্তা, ঝিমঝিম ভাব ও মেজাজ সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। জীবনের সার্বিক পারফর্মেন্স স্থিমিত হয়ে পড়ে।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের জটিল ও কঠিন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। হরমোনাল ইম্ব্যালেন্স, ডায়াবেটিস, বিভিন্ন ইনফ্লামেটরি ডিজিজ, স্থূলতা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কেননা এই রোগ গুলোর রোগীদের ইতিহাস ঘাটলে অনেক ক্ষেত্রেই অনিদ্রার পূর্ব ইতিহাস পাওয়া যায়।

হরমোনাল ইমব্যালেন্স

সঠিক সময়ে নিয়মিত না ঘুমালে হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক থাকে না। যদি সঠিক সময়ে নিয়মিত ঘুমানো হয় তাহলে শরীরের হরমোন ব্যালেন্স সঠিক থাকে। রাত দশটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত ঘুমানো শরীর বৃত্তীয় হরমোনাল সিস্টেমের জন্য অত্যান্ত জরুরী।

- Advertisement -

এক্ষেত্রে ঘুমানোর ঘর অবশ্যই অন্ধকার হতে হবে। কেননা রাত দশটা থেকে দুইটা পর্যন্ত অন্ধকার ঘরে ঘুমানোর গেলে আমাদের মস্তিষ্ক মেলাটোনিন নামক এক ধরনের হরমোন রিলিজ করে যা আমাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বিক্রিয়া সঠিক ভাবে সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অনিদ্রা ও আলোক উজ্জ্বল ঘরে ঘুমানোর ফলে এই হরমোন ঠিকমতো নিঃসরণ হতে পারে না। এই মেলাটোনিন হরমোন যদি দীর্ঘদিন অস্বাভাবিকভাবে নিঃসৃত হয় সেক্ষেত্রে ক্যান্সার পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।

সুতরাং সঠিক ঘুম ও অনিদ্রা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের সিরিয়াসলি ভাবা উচিত এবং সঠিক পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অনিদ্রা থেকে মুক্তি পেতে নিচের উপায়গুলো আপনি অবলম্বন করে উপকার পেতে পারেন:

অনিদ্রা থেকে মুক্তির উপায়

১. ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলুন: অতিরিক্ত চা, কফি ইত্যাদি উত্তেজক পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

২. সন্ধ্যার পর ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন: সন্ধ্যার পর ভারী কোনো খাবার খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। এতে আপনার স্থূলতাও কিছুটা কমে যাবে আর রাতে ভালো ঘুম হবে।

- Advertisement -

৩. পানির পরিমিতি বজায় রাখুন: সন্ধ্যার পর পানি পানেও পরিমিতি বোধ অনুশীলন করা উচিত কেননা অতিরিক্ত পানি পান করলে রাতে প্রস্রাবের বেগে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

৪. ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন: সন্ধ্যার পর সকল প্রকার ইলেকট্রিক ডিভাইস যেমন টিভি, টাচস্ক্রিন ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ নিজের থেকে দূরে রাখতে হবে অর্থাৎ সন্ধ্যার পর স্ক্রিনটাইম ওয়েস্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. সঠিক সময়ে ঘুমাতে যান: রাত নয়টা থেকে এগারো টার মধ্যে বিছানায় যেতে হবে ঘুমানোর জন্য। কেননা দশটা থেকে দুইটা ঘুমানোর সঠিক সময়।

৬. ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠুন: রাতে যদি ঘুম নাও হয় তবুও ভোরবেলা বিছানা ত্যাগ করতে হবে এবং মিনিমাম ৩০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা সকালের নির্মল বাতাসে ঘাম ঝড়িয়ে হাঁটতে হবে।

৭. দিনে ঘুমানো এড়িয়ে চলুন: সাধারণত রাতে ঘুম না হলে বা সঠিকভাবে না হলে দিনে ঝিমঝিম ভাব হয় এবং ঘুম আসে। তবে দিনে যতই ঘুম আসুক না কেনো কোনো ভাবেই ঘুমানো যাবে না। দিনে ঘুম থেকে বিরত থাকতে হবে এবং রাতের ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

- Advertisement -

৮. শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন: ভালো ঘুমের জন্য আমরা দুইটি এক্সারসাইজ করতে পারি যা খুবই উপকারী। একটি শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং অন্যটি শারীরিক ব্যায়াম।

৯. স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন: স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে কেননা একটি অস্বাস্থ্যকর ডায়েট পরোক্ষভাবে আমাদের ঘুমের স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে। অর্থাৎ একটা সঠিক স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেইনটেইন করে চলার চেষ্টা করুন।

১০. পজিটিভ চিন্তা করুন: পজিটিভ চিন্তাভাবনা করুন, দুশ্চিন্তা করা থেকে দূরে থাকুন, জীবনকে উপভোগ করুন এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন।

ডাক্তার উইলের শ্বাস প্রশ্বাসের পদ্ধতি

শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়ামটির আবিষ্কারক ডাক্তার উইল। এজন্য এই ব্যায়ামটিকে ‘Dr Weils Breathing Technique’ (ডাক্তার উইলের শ্বাস প্রশ্বাসের পদ্ধতি) বলে। ডাক্তার উইল এর শ্বাস-প্রশ্বাসের এই টেকনিক টিকে ৪-৭-৮ ব্রিথিং (Breathing) এক্সারসাইজ ও বলা হয়।

এটি ভালো ঘুমের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী একটি অনুশীলন। এই ব্যায়াম করলে শুধু ভালো ঘুমই নয় আরো অনেক ধরনের শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে এবং শারীরিক কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

- Advertisement -

এই পদ্ধতি টি হলো:

(ক) আপনার মুখ বন্ধ করে চার সেকেন্ড নাক দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করুন। (খ) ৭ সেকেন্ডের জন্য আপনার শ্বাস ধরে রাখুন। (গ) এরপর ৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এক্ষেত্রে শ্বাস ছাড়ার সময় আপনার জিহ্বার ডগা আপনার মুখের ছাদে সরাসরি আপনার সামনের উপরের দাঁতের পিছনে রাখুন এতে ধীরে সুস্থে শ্বাস ছাড়তে আপনার জন্য সুবিধা হবে।

এভাবে আপনার একসেট পূরণ হবে। একসাথে আপনি চার থেকে আট সেট পর্যন্ত করতে পারেন। দিনে দুই থেকে তিনবার করা যেতে পারে। বিছানায় শুয়ে ঘুম না আসা পর্যন্ত এই ব্যায়াম করতে পারবেন। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে ভরা পেটে এই ব্যায়াম করা একেবারেই উচিত নয়।

High Intensity Interval Training

এছাড়া ভালো ঘুমের জন্য আরেকটি অত্যন্ত উপকারী শারীরিক ব্যায়াম হল ‘HIIT (High Intensity Interval Training)’ এক্সারসাইজ। এই ব্যায়ামটি আপনি সপ্তাহে কয়েকদিন করতে পারবেন। এই ব্যায়ামটি অতিরিক্ত করা যাবে না, অতিরিক্ত হিট এক্সারসাইজ হাড় ও মাসলের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।

তবে পরিমিত মাত্রায় সপ্তাহে এক, দুই সর্বোচ্চ তিন দিন এই ব্যায়ামটি করতে পারেন। পরিমিত মাত্রায় হিট এক্সারসাইজ করলে এটা আপনার ঘুমের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে।

- Advertisement -

এই ব্যায়ামের পদ্ধতিটি হল:

(ক) ৩০ সেকেন্ডের জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দৌড়াতে হবে এরপর ২০ সেকেন্ডের জন্য রেস্ট নিতে হবে। আবার ৩০ সেকেন্ড দৌড়াতে হবে ২০ সেকেন্ড রেস্ট নিতে হবে। এভাবে পাঁচ মিনিট কন্টিনিউ করতে হবে।

আশা করা যায় উল্লেখিত শ্বাসের ব্যায়াম ও HIIT এক্সারসাইজ করলে আপনার ঘুম ভালো হবে।

শেষকথা

উপরে উল্লেখিত দশটি টিপস অনুযায়ী সঠিকভাবে কিছুদিন চললে অনিদ্রা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। যদি এতেও কাজ না হয় সেক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

ছবি: Image by pvproductions on Freepik

- Advertisement -
- Advertisement -

আব্দুস সাদিক

কন্টেন্ট রাইটার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- Advertisement -
Back to top button