কুকি-চিন বিদ্রোহ: পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সশস্ত্র সংগ্রাম ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লড়াইয়ের মঞ্চ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত হলো কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং তাদের সশস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী পার্বত্য অঞ্চলে এক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মত্ত, যা তাদের নৃগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
কেএনএফ, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাদের মূল লক্ষ্য রাঙামাটি ও বান্দরবানের নয়টি উপজেলাকে নিয়ে একটি পৃথক ‘বম রাষ্ট্র’ গঠন। তারা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ এবং সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
কেএনএফ শুধু একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়, এটি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ২০২২ সালের জুনে কেএনএফের সশস্ত্র হামলায় তিনজন নিহত হয়। ২০২৩ সালে তাদের হামলায় বাংলাদেশি দুই সেনা নিহত হয় এবং ১২ জন শ্রমিককে অপহরণের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ৭ জন মুক্ত হয়।
এই হামলাগুলি শুধু স্থানীয় নিরাপত্তা নয়, বরং পুরো দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছে। তাদের কার্যক্রমে হত্যা, লুটপাট, মুক্তিপণ দাবি এবং ভয়ভীতি সৃষ্টি করার মতো সন্ত্রাসী কৌশল স্পষ্ট।
কুকি-চিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। মিয়ানমারের চিন রাজ্য থেকে অস্ত্র সরবরাহ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগসূত্র তাদের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করেছে। তাদের স্বপ্ন—‘কুকিল্যান্ড’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যা ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
বাংলাদেশ সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেএনএফের কার্যক্রম দমনে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করছে। সেনাবাহিনী এবং র্যাবের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর উপর কঠোর দমন নীতির প্রয়োগ চলছে।
কুকি-চিন গোষ্ঠীর এই তথাকথিত ‘স্বায়ত্তশাসনের লড়াই’ আসলে একটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম। তাদের দাবি আদায়ের নামে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, অপহরণ এবং হত্যা কোনোভাবেই ন্যায্যতা দিতে পারে না। এই বিদ্রোহ শুধুই একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সময়োচিত পদক্ষেপ এই বিদ্রোহী কার্যক্রমকে দমন করতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এই সংকট নিরসনে জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কুকি-চিন বিদ্রোহ শুধু একটি জাতিগোষ্ঠীর সমস্যা নয়, এটি পুরো দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।