Uncategorized

বৈকাল হ্রদ: বিপন্ন স্বর্গ

মৃত্যুর দ্বারে ঠেলে দিচ্ছে বৈকাল হ্রদ

বিজ্ঞাপন

বৈকাল হ্রদ রাশিয়ার সর্ব-উত্তরের অঞ্চল সাইবেরিয়ার দক্ষিণে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন হ্রদ। এটির চারদিক পাহাড় ঘেরা। ধারণা করা হয়, ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন আগে বৈকাল ফাটল এলাকা’র ভূগর্ভে তীব্র আলোড়নের ফলে ভূপৃষ্ঠে একপ্রকার ফাটলের সৃষ্টি হয়, আর তারই ফলে এই বিশাল বৈকাল হ্রদের সৃষ্টি।

বৈকাল হ্রদের আয়তন

আয়তনের মতো গভীরতার বিচারেও এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হ্রদ। ৫ লাখ ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা ২ লাখ ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এর অবস্থান। এই হ্রদ লম্বায় ৬৩৬ কিলোমিটার; চওড়ায় সর্বোচ্চ ৮১ কিলোমিটার।

এর গড় গভীরতা ৭৪৪.৪ মিটার আর সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৪৪২ মিটার। সৈকত বা বেলাভূমির দৈর্ঘ্য ২ হাজার ১০০ কিলোমিটার। বৈকাল হ্রদ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ১৮৬.৫ মিটার ফুট নিচে।

উত্তর সাগর কি?

বৈকাল হ্রদ পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ স্বচ্ছ, সুপেয় পানির হ্রদ। বিশালতার কারণে প্রাচীন চীনা পান্ডুলিপিতে এই হ্রদকে ‘উত্তর সাগর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বহুকাল ধরে ইউরোপের মানুষ সাগরসদৃশ এই হ্রদের খবর জানতো না।

রাশিয়া এই অঞ্চলে তাদের রাজ্য সম্প্রসারিত করলে সর্বপ্রথম কুরবাত ইভনিভ নামক এক রুশ অনুসন্ধানী গবেষক ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই এলাকায় পৌঁছেন। তার মাধ্যমে প্রকৃতির অপরুপ বিস্ময় ও সৌন্দর্যের লীলাভূমি বৈকাল হ্রদ এবং তার পায়ে জীববৈচিত্র্যর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়।

বিজ্ঞাপন

হ্রদের পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ১ হাজার ৭০০ এরও বেশি জাতের গাছপালা ও জীবজন্তু রয়েছে। যার এক-তৃতীয়াংশ পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না।

প্রকৃতির বিষ্ময় ‘বৈকাল হ্রদ’

এখানে রয়েছে অমূল, গোলেমিংকা, স্যামন প্রভৃতি মাছ এবং নানাজাতের শামুক, শ্যাওলা ইত্যাদি। এর পূর্ব পাড়ে বাস করে বুরিয়াত নামক আদিবাসী সম্প্রদায়। বৈকাল শীতপ্রধান এলাকা। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস নেমে যায়; আর গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়।

প্রকৃতির বিষ্ময় বৈকাল হ্রদে সারাবছর অনুসন্ধানী গবেষক আর সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি এই বৈকাল হ্রদকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয় ইউনেস্কো।

ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার বৈকাল হ্রদের পানি সীমা গড়িয়েছে সাইবেরিয়ার ইর্কুৎস্ক অঞ্চল ও বুরিয়াতিয়া প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত। রুশদের কাছে বৈকাল সাইবেরিয়ার মুক্তা নামে পরিচিত। রাশিয়ায় প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ বৈকাল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সাইবেরিয়ার মুক্তা বৈকাল হ্রদ

সাইবেরিয়ার এই বৈকাল হ্রদ ছাড়াও গোটা রাশিয়ার বিশেষ করে ইয়াকুতিয়া ও টমস্ক অঞ্চলে আরও বেশ কয়েকটি বড় হ্রদ রয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, আয়তনে বড় এমন কয়েকটি হ্রদের নামও বৈকাল। গ্রীষ্মকালই বৈকাল হ্রদে বেড়ানোর ভালো সময়। এ সময় হ্রদের আকর্ষণীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের ভিড় বেশি হয়।

বিজ্ঞাপন

বৈকাল হ্রদের নামকরণ নিয়েও নানা মত রযেছে। তবে রাশিয়ায় সবচেয়ে প্রচলিত ধারনা হচ্ছে, তিইউরস্কি ভাষার ‘বাই-কুল’ আজ্ঞলিক শব্দ থেকেই বৈকাল নামের উৎপত্তি। যার রুশ ভাষায় অর্থ দাঁড়ায় ‘বাগাতোয়ে অঝেরা’ অর্থাৎ, সম্পদশালী হ্রদ।

বৈকাল হ্রদ ভূমিকম্প প্রবণতা

বৈকাল হ্রদ ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলো ভূমিকম্প প্রবণ। বৈকালের তলদেশে বছরে কয়েকশ বার ভূমিকম্প হয়। তবে এর অধিকাংশই মৃদু ভূমিকম্প। বৈকাল হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৬৪২ মিটার। এটি নিশ্চিত করতে গবেষকেরা ২০০২ সালে হ্রদের ১৩ লাখ ১২ হাজার ৭৮৮ টি স্থানে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

স্বচ্ছ পানির হ্রদ হিসেবেও বিশ্বজুড়ে বৈকালের সুনাম রয়েছে। বৈকালের পানি এতোটাই স্বচ্ছ যে এর উপরিভাগ থেকে হ্রদের তলদেশের সর্বোচ্চ ৪০ মিটার পর্যন্ত খালি চোখেই দেখা যায়। পৃথিবীর ১৯ ভাগ বিশুদ্ধ পানি রয়েছে এই হ্রদে।

চারিদিকে সবুজ পাহাড় আর দিগন্তজোড়া নীল জলরাশি বৈকাল হ্রদকে করেছে আরও আকর্ষনীয়। শীতকালে হ্রদের পানি বরফের আস্তরনে ঢেকে যায়, বরফের স্তরগুলো এতই পুরু থাকে যে কোন প্রকারের মাঝারি ধরনের গাড়ি নিয়ে বৈকালের বুকে ঘুরে বেড়ানো যায়।

অন্তত ৩৬০ টি নদীর পানি এসে বৈকালে পড়ে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় নদী সেলেঙ্গার উৎপত্তি মঙ্গোলিয়ায়, যার দৈর্ঘ্য ১০২৪ কিলোমিটার। অন্যদিকে, শুধু আঙ্গারা নদীর মাধ্যমে হ্রদের পানি বাইরে নিষ্কাশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

ছোট-বড় মিলিয়ে বৈকালে রয়েছে ৩০ টি দ্বীপ। সবচেয়ে বড় দ্বীপটি ওলখন, যার অবস্থান বৈকালের একদম প্রাণকেন্দ্রে। দ্বীপটি লম্বায় ৭১ দশমিক ৭ কিলোমিটার আর চওড়ায় ১৪ কিলোমিটার। বৈকালের অন্যান্য দ্বীপের চেয়ে এই দ্বীপের পর্যটকদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি থাকে।

রাশিয়ার রহস্যময় বৈকাল হ্রদ

রাশিয়ার রহস্যময় বৈকাল হ্রদের কথা একাধিকবার তুলে আনা হয়েছে সেলুলুয়েডের পর্দায়। তৈরি করা হয়েছে অনেক তথ্যচিত্র, কমেডিও গবেষণাধর্মী ছবি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র ‘বৈকালহীন’ নির্মান করেন ইর্কুৎস্কের পরিচালক আলেঙন্দার গারনোভস্কি।

বৈকালের তীরে বাস করা একদল লোকের গল্প নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে। এই হ্রদ ও আশেপাশের পরিবেশ রক্ষায় কীভাবে তারা নিজেরাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা-ই ছবিতে দেখানো হয়েছে।

প্রকৃতির এক আর্শ্চয বিস্ময় এই হ্রদটি মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ এবং এর আশপাশ অরণ্য অঞ্চল জীববৈচিত্র্যের এক বিপুল প্রাকৃতিক সম্ভার। সেই বৈকালের পাশেই চব্বিশ হাজার বছর ধরে শুয়ে ছিল তিন বছরের এক বালক।

অ্যানথ্রোপলজিস্টদের খননে পাথরের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে তার লাশ। তার ডিএনএ পরীক্ষা বিজ্ঞানীদের সামনে এনেছে তথ্যের নতুন দিগন্ত। এই বালকের ডিএনএ মিলে গেছে আধুনিক পশ্চিম ইউরোপীয়দের সঙ্গে। এর থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করেছেন, গত তুষার যুগের শেষ দিকেই আজকের ইউরোপ থেকে মানুষ পাড়ি দিয়েছিল এশিয়ার উদ্দেশ্য।

বিজ্ঞাপন

জিন পরীক্ষার পাশাপাশি চেষ্টা করা হচ্ছে ওই বালকের চেহারা সম্পর্কে কিছু আন্দাজ পাওয়ার। যদিও তার দেহে চুল বা মাংস কিছু অবশিষ্ট নেই তবু বিজ্ঞানীদের ধারণা, সেই আদি মানবের চুল আর চোখের মনি ছিল বাদামী। ত্বক ছিল ফাটা ফাটা।

দূষণ ও বৈকাল হ্রদ

দূষণের ফলে হারাতে চলেছে বৈকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যে স্বচ্ছ পানির জন্য বৈকালের খ্যাতি, ক্রমশ সেই পানির স্বচ্ছতা হারিয়ে যাচ্ছে। হ্রদের তলা ঢেকেছে পচা শ্যাওলায়। একেক পর এক হারিয়ে যাচ্ছে জলজ মাছ, প্রাণী। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।

এমন অদ্ভুতুরে পরিবর্তনের জন্য কিছুটা হলেও আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অতিরিক্ত মাছ শিকারকেই দূষছেন তারা। আর বাকিটা রহস্য! অক্টোবরের শুরুতেই হ্রদে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জানি করেছে সবকার। অমুল নামে এক বিশেষ ধরনের স্যালমন মাছ, যা গত ১৫ বছর ধরে একমাত্র বৈকালেই পাওয়া যেত, সংখ্যা কমেছে তারও।

মৎস্যবিজ্ঞানী অ্যানাতলি মামন্তভ মনে করেন, অতিরিক্ত মাছ ধরার জন্যই বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক জীবন। তার উপর বদলাচ্ছে আবহাওয়া। উষ্ণ হচ্ছে সমুদ্রের পানি। ইউনেস্কো জানাচ্ছে, গত কয় মাসে যে হারে মাছের সংখ্যা কমেছে তা উদ্বেগজনক।

বৈকাল হ্রদ নিয়ে ওলেগ টিমোস্কিন

বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারনা, যেভাবে হ্রদের স্বচ্ছ পানি পচা শ্যাওলার মোটা চাদরে ঢেকেছে, তা পরিবেশ দূষনের কারনেই। হ্রদের পানি আর মানুষের দূষণ নিতে পারছে না, তারই ইঙ্গিত এই শ্যাওলা। রাশিয়ার জীববিজ্ঞানী ওলেগ টিমোস্কিনের কথায়, “আমি নিশ্চিত এলাকায় দূষিত পানি এসে মিশছে হ্রদে।”

বিজ্ঞাপন

যার জন্য এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উপরে দোষ চাপাচ্ছেন টিমোস্কিন। প্রত্যেক বাড়ি থেকে কাপড় ধোয়া সাবান মেশানো পানি এসে মিশছে বৈকালে। ফসফেট মেশানো সবার গোলা পানিতেই উত্তরোত্তর বংশবিস্তার শ্যাওলা-পরিবারের।

পানির নিচে জমে থাকা শ্যাওলা এখন পর্যন্ত পানির কতটা ক্ষতি করেছে, তা জানতে সম্প্রতি গোটা বৈকাল পরিদর্শন করেন টিমোস্কন। তারা জানান, এখন বৈকালকে দেখে তার ওই স্ফটিক সৌন্দর্য বোঝার উপায় নেই। গত বছরও ১৭০ রকম স্পঞ্জের খোঁজ মিলেছিল এখানে। এখন তার একটিরও দেখা মেলে না। ওই অঞ্চলে ফসফেট মেশানো পানির ব্যবহার বন্ধ না হলে, বৈকালকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে, বলেই মনে করছেন টিমোস্কন।

বৈকালকে রক্ষা করতে ১৯৯৯ সালে আইন চালু করেছিলো রাশিয়া সরকার। চালু হয়েছিলো স্বচ্ছতা অভিযান প্রকল্প ও। কিন্তু তাতে কোনো উন্নতি হয়নি বৈকালের। তাই মরতে চলেছে প্রকৃতির দান বৈকাল।

শেষকথা

প্রকৃতির এক বিস্ময়কর নিদর্শন বৈকাল হ্রদ। প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি এই হ্রদ জীববৈচিত্র্য আর মৎস্যসম্পদের বিপুল সম্ভার। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কারনে আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে এই হ্রদ সেসব নিয়েই এই লেখা।

ছবি: Image by wirestock on Freepik

বিজ্ঞাপন


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

আবদুল্লাহ আল মাসুদ

ছাত্র, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী

Leave a Reply

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading