মনোবিজ্ঞান

মানসিক স্বাস্থ্য: শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব

শরীর ও মনের যত্ন: সুন্দর জীবনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

আমরা আমাদের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটা চিন্তিত থাকি, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তার কিছুই ভাবি না। অথচ শরীর ও মন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। শুধুমাত্র শারীরিক সুস্থতার মাধ্যমে যেমন সুন্দর জীবন পাওয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি শুধুমাত্র মানসিক সুস্থতার দ্বারাও সুন্দর জীবন পাওয়া সম্ভব নয়।

তাই একটা সুন্দর জীবন উপভোগ করার জন্য এই দুটো বিষয়ই অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু আমরা সবসময়ই মানসিক সমস্যা নিয়ে নয় বরং শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই বেশি উদ্বীগ্ন।

আমরা মানসিক অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেই না কেন?

১. অজ্ঞ এবং উদাসীন

এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, মানুষ মনের সমস্যা ও মানসিক সমস্যা সম্পর্কে অজ্ঞ এবং উদাসীন। শরীরের অসুস্থতার মতোই মনও যে অসুস্থ হতে পারে সে বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই স্পষ্ট ধারণা রাখেন না। এছাড়া আবার অনেক মানুষই মানসিক অসুস্থতা মানেই পাগল বলে দাবি করেন।

আর সাইকিয়াট্রিস্টকে মনে করেন পাগলের ডাক্তার। আসলেই কি বিষয়টা তেমন? না, মানসিক সমস্যা মানেই পাগল নয়। আর এই ডাক্তাররাও পাগলের ডাক্তার নয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সাইকিয়াট্রি ও সাইকোথেরাপিস্ট ডা. আহসান উদ্দিন আহমেদ এই প্রসঙ্গে লেখেন যে,

মানসিক ব্যাধি বা রোগগুলো মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়:

  • গুরু মানসিক ব্যাধি (Major Psychiatric Disorder)
  • লঘু মানসিক ব্যাধি (Minor Psychiatric Disorder)

গুরু মানসিক ব্যাধি বলতে যারা পাগল তাদেরকেই বলে। এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু লঘু মানসিক ব্যাধি অর্থাৎ বিষন্নতা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদিতে আক্রান্ত সংখ্যা অনেক বেশি। আর এই সমস্যার মানুষগুলো কেউই পাগল নয়। এই সমস্যার জন্য যে চিকিৎসকরা আছে তাদেরকে বলা হয় সাইকিয়াট্রিস্ট।

ডা. আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৬.০৫% মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আর এদের মধ্যে ১% গুরু মানসিক ব্যাধির রোগী। বাকি সব লঘু মানসিক ব্যাধির রোগী।

২. কলঙ্ক

এই সমস্যার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে কলঙ্ক যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘stigma’। অর্থাৎ কোনো পরিবারের কেউ যদি কোনো মানসিক সমস্যার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায় চিকিৎসা নেয় আর এটা যদি মানুষ জানতে পারে তাহলে লোকে কী বলবে এমন একটা ভয় কাজ করে।

সেই পরিবারকে নিয়ে মানুষ নানা কথা বলবে। এই যে একটা ভয় এর ফলে দেখা যায় যে অনেকই এই বিষয়টাকে এড়িয়ে যায়। অনেক সময় নিয়ে এবং সাবধানতা অবলম্বন করে তারপর তারা এর জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান। কিন্তু এতে সেই ব্যক্তির সমস্যা আরও অনেক বেড়ে যায়।

৩. ভ্রান্ত ধারণা

এই সমস্যার আরও একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। এখনও প্রায় অনেক মানুষই আছে যারা জ্বীন-ভূত আছে বলে বিশ্বাস করে। শুধু তাই নয়, তারা বিভিন্ন ভাবে জাদুটোনা করা যায় বলেও বিশ্বাস করে থাকেন। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেও এখনও এটা বিশ্বাস করা হয়।

বিজ্ঞাপন

ফলে তারা এই মানসিক সমস্যাকে এসবেরই একটি কারণ বলে মনে করেন এবং চিকিৎসার জন্য কেনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে না গিয়ে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ ইত্যাদির মাধ্যমগুলো খুঁজে থাকেন। আর এমনই অনেক বিভিন্ন কারণে মানুষ মানসিক সমস্যাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। অথচ ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিষয়টি জানা সকলের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই সম্পর্কে এটাও জানা জরুরি যে, মানসিক সুস্থতা মানেই তার কোনো মানসিক সমস্যা নেই তা নয়।

এই প্রসঙ্গে ডা. আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন যে, মানসিক সমস্যাগুলো এমন যে একই বিষয় কখনো স্বাভাবিক আবার কখনো রোগের লক্ষণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার কথা। যখন আপনি কোনো কিছু পাচ্ছেন না তখন তা দিনে দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ হওয়াটা স্বাভাবিক।

তখন যদি এই দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ না হয় এটায় বরং অস্বাভাবিক মনে হবে। কখনো কখনো এটি কোনো রোগের লক্ষণ। যেমন; Panic Disorder, OCD ইত্যাদি রোগের লক্ষণ এই উদ্বেগ। আবার কখনো কখনো উদ্বেগ নিজেই একটি রোগ বা ব্যাধি।

এজন্য মানসিক সমস্যা সম্পর্কে সবারই জানা উচিত। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে যেমন সবাই সচেতন তেমননি মানসিক সমস্যা নিয়েও সবার সচেতন হওয়া জরুরি। জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া উচিত।

কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে?

ক. মনের স্থিতিশীলতা

মনের স্থিতিশীলতর ওপরই নির্ভর করে মানুষের ভালো বা খারাপ থাকাটা। কারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য তখনই অচল হয়ে যায় যখন কারো চিন্তাধারা তার বিপরীতে চলে যায়। এজন্য নিজের চিন্তা ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি।

খ. প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করা

পৃথিবীতে কোনো জীবনই সমস্যামুক্ত নয়। তাই সমস্যামুক্ত জীবনের কথা কখনোই কল্পনা করা উচিতও নয়। যতদিন পৃথিবী এবং জীবন আছে ততদিন সমস্যাও থাকবে। এজন্য সবকিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।

মানুষ সবসময়ই যে তার প্রতিটা কাজেই সফলতা লাভ করে এমনটা নয়। তাই প্রতিদিন এমন প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত যেন সব কিছু মেনে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়ে যায়।

গ. অভ্যাস

নিজের মধ্যে ভালো অভ্যাসগুলো তৈরি করা উচিত। কারণ কোনো কিছুই হঠাৎ করে হয় না। যেমন; ভালো থাকা, সুন্দর থাকা, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা এগুলো সবই একটি চর্চার বিষয়। তাই এই অভ্যাসগুলো তৈরি উচিত।

ঘ. নিজের ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেয়া

সবসময় নিজের ইচ্ছে বা শখগুলোকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। একটি সুন্দর শখের শেষ মানেই একটি সুন্দর জীবনের পরিসমাপ্তি। এজন্য নিজের ইচ্ছে বা শখগুলোকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

ঙ. ব্যায়াম করা

ব্যায়াম শুধু শারীরিক সুস্থতায় নয় মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতেও সহায়তা করে। এজন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করা উচিত।

চ. নিজেকে মূল্যায়ন করা

প্রত্যেকটা মানুষেরই উচিত প্রতিদিন তার নিজেকে একটু হলেও সময় দেয়া। যে সময়ে সে তার নিজেকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। এসব কাজের মাধ্যমে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব। কিন্তু এরপরও যদি সমস্যা দূর না হয় তখন কি করবেন? তাহলে চলুন জেনে আসি কখন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন এবং পরামর্শ নেবেন?

কখন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন?

যদি কারো পারিবারিক, সামাজিক, কর্মজীবন বা শিক্ষাজীবন ইত্যাদি জীবনের নানা ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধাগ্রস্ত সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিতে হবে।

লক্ষণসমূহ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে?
বিষন্নতা হ্যাঁ
উদ্বেগ হ্যাঁ
দুশ্চিন্তা হ্যাঁ
ঘুমের সমস্যা হ্যাঁ
খাদ্যগ্রহণের সমস্যা হ্যাঁ

আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।


নোট: এই নিবন্ধটি শুধুমাত্র তথ্যের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button