বিশেষ প্রতিবেদন

মেন্টাল মাস্টারবেশন: আধুনিক সমাজের এক নতুন আসক্তি

গার্বেজ কন্টেন্ট, মনোযোগের চুরি এবং আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য

আমার ব্যক্তিগত কোন গাড়ি নাই। সুতরাং আমাকে একাধিক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে হয় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। বাস, ট্রেন ও অটো তার মধ্যে অন্যতম। সাধারণত যাতায়াত বা ভ্রমণের সময় প্রয়োজনের বেশি কথা বলি না, কিন্তু গভীরভাবে আশেপাশের সিটে বসা মানুষদের একটু পর্যবেক্ষণ করি। প্রথম কারণ হচ্ছে, আমার মানিব্যাগ এবং দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ‘গল্প’। প্রত্যেকটি মানুষ এবং তাদের ড্রেসিং সেন্স, কথা বলার ধরণ, তাদের ব্যবহার করা ফোন, অন্য যাত্রীর সাথে তাদের আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো আমার জন্য একটি সুন্দর ‘গল্প’ হতে পারে।

আমি কিছু বিষয় সকল যাত্রীর মধ্যে কমন পেয়েছি,

১. স্মার্টফোনের সাথে ইয়ারফোন নিয়ে গান শোনা

২. ফেসবুক ফিড স্ক্রলিং

৩. রিলস্ দেখা

৪. ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিং করা

৫. ইউটিউবে ভিডিও দেখা

যদিও এই কার্যকলাপ করতে নতুন প্রজন্মের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করেছি কিন্তু এই বিষয়টি শুধুমাত্র বয়সের রেঞ্জে আবদ্ধ নয়। বয়স্কদের মধ্যেও এমন প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। আমরা ‘Spotify’, ‘YouTube Music’, ‘Netflix’, ‘Amazon Prime’, ‘Facebook’, ‘Instagram’, ‘WhatsApp’… প্রধানত অবসরে বেশি ব্যবহার করছি (আমাদের এরকম মনে হয়)। এই সমস্ত প্লাটফর্মে এত এত কন্টেন্ট বিদ্যমান যে এখন শুধুমাত্র ‘Netflix’ এ এই পরিমাণ কন্টেন্ট আছে যে, এখানে লগইন করার পর থেকে আমি ঠিক বুঝতেই পারছি না কি দেখবো? কোনটা আগে দেখবো?

আজ হঠাৎ মনে প্রশ্ন আসলো, চারপাশে এত এত কন্টেন্ট যদি থাকে তাহলে নিশ্চয় এসবের চাহিদাও আছে। কিন্তু এর পেছনের মেকানিজম কি? তারপর খুঁজে পেলাম ইলন মাস্ক স্বীকার করেছেন, “মেট্রিক্স বিদ্যমান।” এই সকল প্লাটফর্ম আমাদের ‘Attention (মনোযোগ)’ চায়। খেয়াল করে দেখলাম, আমি নিজেও ‘ডোপামিন ডেটক্স’ ব্যবহার নিশ্চিত করলেও পরিবারের সাথে/বন্ধুদের সাথে আর খুলে কথা বলছি না, বা, ৫ মিনিট ঠাহর হয়ে মনের কথাগুলো শেয়ার করছি না। সর্বোচ্চ কিছু ফটো স্মৃতি হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দিচ্ছি। আমাদের সবার মধ্যে ভয়ানক ‘Detachment’ তৈরি করা হয়েছে। আমাদের একাকীত্ব বেড়েছে। আমাদের মধ্যে ডিপ্রেশন বেড়েছে।

কিন্তু এখানেই কৌতুহল শেষ হচ্ছে না। কারণ সবার ‘মনোযোগ’ কেন কেড়ে নিচ্ছে এই সব টেক জায়ান্ট? অথবা, আমাদেরর এত এত কন্টেন্ট এক জীবনে কি সত্যিই দরকার? এত এত সিনেমা বা গান কি সত্যিই দরকার? এবার কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর ভয়ানক হতে যাচ্ছে। সত্যি বলতে, আমাদের এক জীবনে এত কন্টেন্ট কনজিউম করার কোনো প্রয়োজন নাই। কিন্তু আমরা তো প্রতিদিন কনজিউম করছি। আমার মতে, সব বই পড়ারও দরকার নাই। কারণ প্রতিদিন হাজার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে এবং প্রতি বছরে এই অঙ্ক ২২ লাখেরও বেশি।

আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, একজন পুরুষকে দূর্বল তৈরি করার জন্য এবং একজন নারীকে ‘ক্রিটিকাল থিংকিং’ থেকে দূরে রাখার জন্য। আমরা সবাই একটি মায়ার জালে আবদ্ধ আছি। এই নিয়ে ‘Matrix’ সিনেমা হলিউডে আছে। কিন্তু এই ইল্যুশন বা মায়ার কথা বাঙালী বহু লেখকদের লেখায় পাওয়া যায়।

কিন্তু পুরুষ ও নারীকে এমন দূর্বল কেন করা হচ্ছে?

এজন্য ভালো ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। আমি একটু আগে বলেছি, আমি যাতায়াতের সময় যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু আরো ভালো করে দেখলাম তারা যেসব কন্টেন্ট কনজিউম করছে তার বেশিরভাগই অনর্থক এবং যথেষ্ট ‘Creepy’। এখান থেকে ‘Netflix’ এবং ‘YouTube’ ট্রেন্ডিং আরো ভয়াবহ রকমের এবজার্ড (অনর্থক) কন্টেন্টে ভরপুর। আচ্ছা ভাবুন তো, “Why This Kolaveri Di? (The Soup of Love)” এবং “PSY – GANGNAM STYLE (강남스타일)”, “Despacito” – গানগুলো বাঙালীদের কাছে জনপ্রিয় ক্যামনে হয়? আরো একটি মজার বিষয় হচ্ছে, যেসব গানে গালি আছে সেসব গান তুলনামূলক বেশি চলছে। মানে খুল্লাম খুল্লা নোংরামি।

সূত্র মতে, শুধুমাত্র ২০২০ সালে প*র্ণ ভিডিও বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪২ বিলিয়ন লোক দেখেছেন। বাংলাদেশের ডাটা পাচ্ছি না। কারণ সবাইকে ভিপিএন ব্যবহার করতে হয়। লিংক খুঁজতে হয়। কিছু এক্সক্লুসিভ থাকলে আমাকেও ইনবক্স করবেন। যাকগে, আবার এই সমস্ত প্লাটফর্ম ‘নগ্নতা’ কে প্রোমোট করছে। ইনস্টাগ্রামে বোল্ড নামক নগ্ন ফটো, এমন ফটো যেসব আমরা আগে ‘MMS’ হিসেবে পেয়ে যৌন উত্তেজনা অনুভব করতাম। আবার এমন নয়, শুধু নারীদের শরীর দেখানো হচ্ছে, পুরুষদেরও নগ্নতা প্রকাশ করা হচ্ছে। সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছেন জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা ‘রণবীর সিং’। গান আর গালি একতালে বাজছে। আর এরই সাথে ‘মাস্টারবেশন’ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলায় ‘হস্তমৈথুন’।

পুরুষ এবং নারীর কথোপকথনে কোনো ‘নুয়ান্স’ তৈরি হচ্ছে না। আমার এক কাজিন আছে, মামুনুর রশীদ (সাগর)। তার সাথে কথোপকথনে গেলে আমি বারবার স্লিপ করি। ও জানতে চাইছে সালমান খানের পরবর্তী সিনেমা কি? আমি ভাবছি শহীদ কাপুরের পরবর্তী ছবি কি হতে পারে! এরপর আমরা অভিজাত শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলাম। সর্বশেষ, আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরে ‘আইডিয়া’ নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। বড় ভাই সাগরের কাছে একাধিক দুর্দান্ত আইডিয়া আছে। আমরা দুই ভাই মিলে জমপেশ আইডিয়া সমূহ নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলাম। একবার শুরু হলে যেন আমাদের আড্ডা থামতেই চায় না।

কিন্তু এই আইডিয়া নির্ভর কথপোকথন শুধু যে আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যেই হয় তা কিন্তু নয়। আমি বাকিদের সাথেও চেষ্টা করেছি আইডিয়া নির্ভর আলাপ করতে এবং সেটার প্রতিফলন ঘটাতে। সর্বশেষ, আমার প্রচুর গবেষণা ভিত্তিক আইডিয়া ‘লিখুন আর আয় করুন’ এখন ইনভেস্টরের অভাবে গোল্লায়। মানে হলো, আমরা ‘অ্যাকশন’ কম ‘আইডিয়া’ নির্ভর কথপোকথনে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। অনেক খুঁজে এটির নাম পেলাম ‘Mental Masturbation (মেন্টাল মাস্টারবেশন)’। এবং এই যে এতকথা তার ডটগুলো যদি মেলান তাহলে আমি আপনাকে এই পর্যন্ত কিছুটা হলেও বুঝাতে পেরেছি।

এখন এই ‘মেন্টাল মাস্টারবেশন’ আবার কি? মেন্টাল মাস্টারবেশন হচ্ছে, ‘Unproductive’ এবং ‘Repetitive’ চিন্তার এক ধরণের প্যাটার্ন। এই ধরণের মানুষ শুধু আইডিয়া নির্ভর বড় বড় গপ্পো করতে পারে কিন্তু অ্যাকশনের বেলায় বড় আকারের ‘শূন্য’। কিন্তু এরা এমনি এমনি এরকম হয়নি। এই যে একটু আগে বললাম, হাজারো গার্বেজ কন্টেন্ট একের পর এক কনজিউম করার ফলাফল। এরা এত তথ্য জানে যা কোন কাজের না। শুধু তাই নয়, এরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুধু চিন্তাই ভাসতে থাকে, একের পর এক আইডিয়া করতে থাকে কিন্ত কাজকর্ম করে না।

মেন্টাল মাস্টারবেশন কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিক্যাল টার্ম নয় কিন্তু এরচেয়ে ভালো আর শব্দ আমি বিষয়টি বুঝানোর জন্য খুঁজে পাইনি। এই মেন্টাল মাস্টারবেশনে আক্রান্ত মানুষগুলো নিম্নোক্ত সমস্যায় আজীবন ভুগবেন,

১. কাজে মনোযোগ না পাওয়া

২. ডিপ্রেশন বেড়ে যাওয়া

৩. অসামাজিক হয়ে পড়া

৪. বন্ধুত্ব বা প্রেম ঘটিত সম্পর্ক টিকে রাখতে না পারা

৫. পার্থিব জগতের কোনকিছুরই মধ্যে উদ্দেশ্য খুঁজে না পাওয়া

 

“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?”

— কুসুম কুমারী দাশ

 

দুঃখিত, যতদিন এই মেন্টাল মাস্টারবেশন চলমান আছে ততদিন তো মুক্তি মেলা ভার। এই ধরণের মানুষেরা এক ফ্যান্টাসি কিংডমে বাস করে। তবে কিছু কাজ করলে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে,

★★★ ১. প্রতিদিন কিছু কিছু তো অ্যাকশন নেন?

★★★ ২. হাজার/লাখো গার্বেজ কন্টেন্ট মাথায় না নিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করুন। নিজের চারপাশটা নিয়ে ভাবতে শুরু করুন। যদি কোনো সমস্যা পান সেটা ফিক্স করুন। অন্তত পরিবারের কারো কাজে সাহায্য করুন।

★★ ৩. ডায়েরি লিখার অভ্যেস গড়ে তুলুন।

★★ ৪. মেডিটেশন করুন

★★ ৫. একবারে তো আর এই আসক্তি থেকে বের হতে পারবেন না তবে যেসব ভিডিও বা প*র্ণগ্রাফি আপনি সাধারণত দেখেন সেসব বাদ দিতে হবে। কিছু ফেসবুক পেজ বা ইন্সটাগ্রামে সুন্দর নর বা সুন্দরী নারীদের আনফলো করতে হবে। কিছু ইউটিউব চ্যানেল আন-সাবস্কাইব করতে হবে। মানে নোংরামি এবং নগ্নতা থেকে শুরু করে গার্বেজ কন্টেন্ট থেকে নিজেকে হঠিয়ে নিতে হবে।

দেখুন, মেন্টাল মাস্টারবেশন ঘটছে কেন? কারণ, আপনি যা খান তা-ই-তো দূষিত এবং নোংরা সুতরাং আউটপুট ভালো হবে কি করে? দুনিয়ার মানুষ যখন ‘Stress after Stress’ টেকনিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে শুধুমাত্র আইডিয়া নির্ভর জীবনযাপন অন্তত কারো জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়।

উপর আল্লাহ্/ঈশ্বর কে কি মানেন? তাহলে তো জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া আরো সহজ। আর সংশয়বাদী বা নাস্তিক হলে জাপানীজ দর্শন ‘ইকিগাই’ অনুসরণ করতে পারেন। আমাদের সবার জীবন হোক কর্মমুখর!

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button