বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রজন্ম মিলেনিজেনের যুদ্ধ ঘোষণা
মিলেনিজেন: নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা
প্রেক্ষাপট
ছোটবেলা থেকে একটি পুরো প্রজন্ম বাংলাদেশের রাজনীতির বিভৎস সংস্কৃতি দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। এই তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বেশি ‘ক্ষমতা’ কেন্দ্রিক। একবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে যে-ই পেয়েছে, সে-ই কিন্তু আর ক্ষমতা থেকে নামতে চায়নি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে চায়নি; ইতিহাস সাক্ষী। ক্ষমতার জন্য বর্তমান বাংলাদেশে এমন কোনো দল নেই যাদের হাতে রক্ত নেই। এরা ক্ষমতার জন্য বারবার সাধারণ মানুষদের ব্যবহার এবং তাদের চাওয়া-পাওয়া ও অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রজন্মের মনোভাব
এই প্রজন্ম বড় হয়েছে রাজনীতিকে ঘৃণা করে। আরো স্পষ্ট করে বলা উচিত, তথাকথিত রাজনীতিকে এই প্রজন্ম ঘৃণা করে। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রজন্মকে ঘিরে অনেক কটু কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এরা এই গতানুগতিক এবং তথাকথিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে মানুষের স্বার্থে অন্তত ৩টি সফল আন্দোলন করতে সক্ষম হয়েছে (একটি চলমান)। অনেক রক্ত বাহিত হয়েছে বা হচ্ছে। অথচ, এদের নিকট প্রজন্ম এদেরকে কতবার অথর্ব, নিষ্ক্রিয়, ঘরকুনো, অনলাইন যোদ্ধা ইত্যাদি বলে নিজেদের সুপিরিয়র ভেবে আরাম পেয়েছে।
মিলেনিজেনের সংজ্ঞা
প্রথমত, এই প্রজন্ম রাজনীতির সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রজন্ম আন্দোলন কীভাবে করতে হয় তা নতুন করে শিখিয়েছে। আমি এই প্রজন্মের নাম দিচ্ছি ‘মিলেনিজেন (Millenigen)’। মানে মোটাদাগে দুই প্রজন্মের একটি অংশ। মিলেনিয়াম প্রজন্মের শেষের অংশ এবং জেন জি প্রজন্মের শুরুর অংশ।
রাজনীতির সংজ্ঞা পাল্টানোর উপায়
আমার মতে, বেশিরভাগ মিলেনিজেনরা কোনো বিশেষ দল সমর্থন করেন না, অন্তত কট্টরপন্থী নয়। গতানুগতিক এবং তথাকথিত কিছু রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন তো করেই না এবং এই সংখ্যা বর্তমানে বেড়েই চলেছে। এজন্যই দেখবেন, সরকার পক্ষ এদের মধ্যে দলীয় সূত্র খুঁজে বের করার বহু চেষ্টা করলেও শেষমেশ মোটাদাগে বড় কোনো সূত্র বা লিংক খুঁজে পায়নি। মানে যেটা নেই, সেটা খুঁজে পাবেন কীভাবে?
মিলেনিজেনের বৈশিষ্ট্য
১. রাজনীতিতে সচেতন নাগরিকের ভূমিকা: চারপাশে যা চলছে সে সম্পর্কে অবগত থাকা। যতদূর সম্ভব বিশ্বস্ত সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তথ্যগুলো সবার সাথে শেয়ার করা। এটাও তো একধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার। গত এক যুগে নাটকীয়ভাবে শুধুমাত্র ফেসবুকে যে বিকল্পধারার অবতারণা তার গ্রাফ যদি লক্ষ্য করা যায় তাহলে চমকে উঠতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশে তথ্যের দ্বাররক্ষী হিসেবে সামনে এসে খুব বেশি সুবিধা কেউ করে যেতে পারবে বলে আমার মনে হয় না; সম্ভব নয়।
২. কমন ইন্টারেস্টের জায়গা তৈরি করা: ফেসবুকীয় গণতান্ত্রিক মডেল অধিক গণতান্ত্রিক হলেও এই প্রজন্ম এই ‘Overloaded Information’ এর মধ্যেও এক ধরণের কমন আগ্রহের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সত্য এটাও যে, এরা একে অন্যের সাথে তর্ক-বিতর্কে জড়িত থাকলেও দিনদিন বরং কমন আগ্রহের জায়গা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা একে অন্যের সাথে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে শক্রুতে পরিণত হয় নাই, উল্টো এরা চেক এন্ড ব্যালেন্স ততক্ষণ অবধি করছে যতক্ষণ অবধি মীমাংসা না হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, এতে করে এদের পড়াশোনাও করতে হচ্ছে।
৩. প্রশ্ন করছে: এদের নিকট প্রজন্ম ঠিক যতটা দাসত্বের প্রমাণ দিয়েছে মিলেনিজেন ঠিক ততটাই গণতান্ত্রিক অধিকার চাচ্ছে, প্রশ্ন করছে, সিস্টেমকে বারবার চ্যালেঞ্জ করছে। আরো কঠোরভাবে যদি বলা যায় তাহলে প্রায় রোজ দুর্নীতি নিয়ে, লুটপাট নিয়ে, দারিদ্রতা নিয়ে, মূল্যস্ফীতি নিয়ে, টাকা পাচার নিয়ে, চাকুরী নিয়ে, অব্যবস্থাপনা নিয়ে অক্লান্ত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এই দলে যারা আছে অধিকাংশই শিক্ষিত। অন্তত আমাদের তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত। একটি অন্যায় ঘটলে হাজারো কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও স্যাটায়ারে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে ফেসবুক। শুধু ফেসবুক হলেও হত, এদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ করছে ন্যায় ও ন্যায্যতার জন্য। প্রয়োজনে কেউ মনে রাখুক বা না রাখুক এরা জীবন পর্যন্ত দিচ্ছে।
৪. নেতৃত্ব দেবার সাহসী মনোভাব: সর্বশেষ চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে একটি শব্দ বেশিরভাগ রাজনীতিবিদরা বুঝছেন না। অন্তত টেলিভিশন ও অনলাইন টকশোতে বসা বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষগুলো। এই আন্দোলনে একটি আলোচিত শব্দ ‘সমন্বয়ক’। ভালো করে আবার পড়ুন, ‘সমন্বয়ক’, নেতা নন। মানে হলো, গণতান্ত্রিক মডেলে এরচেয়ে ভালো শব্দ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কি হতে পারতো আমার জানা নেই। কেন ‘নেতা’ শব্দ নেতিবাচক তা নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ হতে পারে কিন্তু সমন্বয়কারী কখনোই নেতার মত করে ব্যক্তি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন না। একইসাথে একজন সমন্বয়কারীর অনুপস্থিতিতে আরেকজনের সেখানে দাঁড়িয়ে যাওয়া ‘নেতা’ শব্দের তুলনায় কম ভারি এবং অধিক গণতান্ত্রিক।
৫. নেটওয়ার্কিং ও যোগাযোগ: এদের মধ্যে কমন আগ্রহ আছে কিন্তু এরা কীভাবে নেটওয়ার্কিং করছে বা যোগাযোগ করছে তার নির্দিষ্ট কোনো প্যাটার্ন নেই। অন্তত আমি ব্যর্থ কারণ এরকম কোনো প্যাটার্ন আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু এরা যে যেখানে আছে সেখান থেকে সে তার অংশটুকু করছে। বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে, এখানে কোনো ‘ডট’ আছে এবং তা কানেক্ট করা সম্ভব। না, কানেক্ট করা সম্ভব না। দীর্ঘদিনের ডায়ালগে এদের মধ্যে শেয়ারড কিছু মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে। সুতরাং যখন এরা কথা বলছে তখন মনে হতে পারে যে, এরা একে অপরকে ‘Echo’ করছে; যা ভুল।
৬. বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা: কোটা সংস্কার আন্দোলন তো সরকারি চাকুরীর জন্য। কিন্তু এই আন্দোলনে এমন কিছু ছেলে-মেয়ে যোগদান করেছে যারা হয়তো বাংলাদেশে সরকারি চাকুরীর ফর্ম পর্যন্ত উঠাতেন না। ‘উঠাতেন না’ – এমন বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। মানে এই আন্দোলন কোনোভাবেই শুধুমাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়। এটাই তো সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এটাই তো বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ভাই শহীদ হয়েছেন। তারা কি চাইছিলেন?
উপসংহার
তারা কি চাইছিলেন সেটা তো আমি জানি না। কিন্তু চাকুরী পেলেও আমরা সবাই তো আর পাবো না। আমাদের মধ্যে হয়তো ৩% শতাংশ সরকারি চাকুরী পাবেন। কিন্তু বাকিদের কি হবে? ওরা এদেশের সন্তান নয়? ওরা খুব সম্ভবত চেয়েছিলেন যে, কোনভাবে একসাথে সবাই দাঁড়ানো যায় না! এমন কোন সংস্কার কি নেই যা শুধুমাত্র ৩% শতাংশের জন্য নয় বাকি ৯৭% শতাংশের জন্যও কাজ করবে!
(উল্লেখ্য, এই প্রবন্ধ অপূর্ণ কারণ আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা খুবই কম রাখি। আর আমারও সরকারি চাকুরী না হলেও এক জীবন চালানোর মত দক্ষতা আছে।)