ব্যবসা ও বাণিজ্য

আধুনিক ব্যাংকিং: উৎপত্তি, বিবর্তন ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক ও তাদের কার্যক্রমের নীতিমালা

বর্তমানে যত ধরণের অর্থ লেনদেনের বিষয় আছে তা সবই কোনো না কোনো ব্যাংকের অধীনে হয়ে থাকে। ব্যাংক ছাড়া মানুষ তাদের লেনদেনের বিষয়গুলো ভাবতেও পারে না। আমরা গত দিনে ব্যাংকের উৎপত্তি এবং তার বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক

কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক বলতে শুধু একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠানকেই বোঝায় না। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক আছে। এদের কাজের ধরণ, পরিচালনা পদ্ধতি এবং নীতিমালার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাংকগুলো হল:

  • বাণিজ্যিক ব্যাংক
  • বিনিয়োগ ব্যাংক
  • মার্চেন্ট ব্যাংক
  • বিশেষায়িত ব্যাংক
  • সমবায় ব্যাংক
  • সমবায় ভূমি উন্নয়ন ব্যাংক
  • কমিউনিটি উন্নয়ন ব্যাংক
  • ইসলামী ব্যাংক
  • অফশোর ব্যাংক

বাণিজ্যিক ব্যাংক কি?

বাণিজ্যিক ব্যাংক বলতে এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় যেখানে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা হয় এবং তা থেকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বিনিয়োগের জন্য ঋণ প্রদানের কার্য সম্পাদন করা হয়।

অর্থাৎ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের থেকে কম সুদের হারে অর্থ সংগ্রহ করে এবং ঋণগ্রহীতাকে উচ্চ সুদের হারে ঋণ প্রদান করে থাকে। এই উভয় সুদের হারের পার্থক্যগুলোই ব্যাংকগুলোর মুনাফার প্রধান উৎস। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণের কারবারগুলো হয় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদির।

সুতরাং, বাণিজ্যিক ব্যাংক বলতে বোঝায়, যে ব্যাংক আমানত গ্রহণ করে, ঋণ প্রদান করে এবং মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের উদাহরণ:

ক. সোনালী ব্যাংক লিমিটেড

  • প্রতিষ্ঠান: ১৯৭২ সালে
  • শাখা: ১২২৭ টি

খ. জনতা ব্যাংক লিমিটেড

  • প্রতিষ্ঠান: ১৯৭২ সালে
  • শাখা: ৯১৭ টি

গ. অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড

  • প্রতিষ্ঠান: ১৯৭২ সালে
  • শাখা: ৯৬০ টি

ঘ. রূপালী ব্যাংক লিমিটেড

  • প্রতিষ্ঠান: ১৯৭২ সালে
  • শাখা: ৫৮৩ টি

ঙ. বেসিক ব্যাংক লিমিটেড

  • প্রতিষ্ঠান: ১৯৮৮ সালে
  • শাখা: ৭২ টি

চ. বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড

  • প্রতিষ্ঠান: ২০০৯ সালে
  • শাখা: ৪৬ টি

বাংলাদেশে এই ৬টি ব্যাংক রাষ্ট্রয়াত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর মালিকানা শতভাগ অথবা প্রায় শতভাগ বাংলাদেশ সরকারের।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলনীতিগুলো কী?

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনেকগুলো নীতি রয়েছে। যেগুলোকে কেন্দ্র করে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমন:

১. মুনাফার নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে মুনাফা প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠান বলা হয়। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এমনভাবে ঋণদান, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পদ অর্জন করে যাতে সে পর্যাপ্ত আয় নিশ্চিত করতে পারে। এছাড়াও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অন্যান্য সেবা সরবরাহ করে থাকে যাতে তারা পর্যাপ্ত কমিশন এবং সার্ভিস চার্জ আদায় করতে পারে এবং তার জন্য তারা সচেষ্ট থাকে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আয় বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।

২. তারল্যের নীতি

তারল্যের নীতি হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান ও প্রথম অনুসরণীয় নীতি। বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য বলতে দুটি ধারণাকে নির্দেশ করে থাকে। এর প্রথমটি হলো তারল্য বলতে বোঝায় চলতি দায় নির্বাহের সামর্থকে।

আর দ্বিতীয়টি হলো তারল্য বলতে বোঝায় নগদ অর্থ ব্যতীত অন্যান্য সম্পদ দ্রুত ও কম খরচে নগদ অর্থে রূপান্তরের সামর্থ্যকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানত হিসেবে সংগৃহীত এই অর্থ থেকেই ঋণদান করে থাকে।

বিজ্ঞাপন

ব্যাংকগুলো চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে সংগৃহীত এই অর্থ আমানতকারীকে চাওয়ামাত্র ফেরত দিতে বাধ্য। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ অর্থ ও অন্যান্য তরল সম্পদ সংরক্ষণ করতে হয়।

৩. নিরাপত্তার নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অন্যের অর্থ দিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করে থাকে। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানত হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে যে অর্থ সংগৃহীত করে থাকে তা তাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ঋণ হিসেবে বিতরণ করে থাকে।

বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ করে এবং অন্যান্য আর্থিক সম্পদও তাঁরা অর্জন করে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে যদি ঋণ হিসেবে বিতরণকৃত অর্থ আনতে ব্যর্থ হয় বা বিনিয়োগকৃত অর্থ উসুল করতে নাও পারে তবুও তাঁরা আমানতকারীদের নিকট দায়বন্ধ থাকবে।

সুতরাং এই বাণিজ্যিক ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার নীতি অনুসরণ করে থাকে। সেই কারণে তাঁরা আমানতকারীদের দায় পরিশোধ করতে পারে। আর এই নিরাপত্তার নীতি অনুসরণ করে বলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো জামানতের বিপরীতে ঋণ দেয় এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকে।

৪. বৈচিত্রায়নের নীতি

যদি কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেই ঋণদান করা হয় তবে এতে ব্যাংকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে ঋণদান করলে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পে এই বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের আয়ের ও অর্থপ্রবাহের ধারা ঝুঁকিমুক্ত থাকে।

এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ইচ্ছাকৃতভাবেই বৈচিত্রায়ন অর্জনে সচেষ্ট থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে মোট ঋণের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণদান করতে পারবে না।

৫. আর্থিক সম্পদের দ্রুত বিক্রয়যোগ্যতা

বাণিজ্যিক ব্যাংক নগদ অর্থ ছাড়াও অনেক আর্থিক সম্পদ যেমন- শেয়ার, ঋণপত্র, ট্রেজারি বিল প্রভৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল বিনিয়োগ করে থাকে। এ সকল আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংক সেইসব আর্থিক সম্পদকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে যেগুলো দ্রুত বিক্রয়যোগ্য। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এই নীতি তারল্য নীতির সাথে সংগতিপূর্ণ।

৬. ঋণদান ও বিনিয়োগ নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংক তার আয়ের সিংহভাগই অর্জন করে থাকে ঋণদান ও বিনিয়োগের মাধ্যমে। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্ণদান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক উপার্জনশীল, কম ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপদ খাতে ঋণদান করে বিনিয়োগ করে থাকে। এই দান ও বিনিয়োগ নীতির যথাযথ অনুসরণের ওপরই ব্যাংকের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল।

৭. আমানত গ্রহণের নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংকের আরেকটি নীতি হলো আমানত গ্রহণের নীতি। আমানত হিসেবে সংগৃহীত অর্থই হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের তহবিলের প্রধান উৎস। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত মুনাফা অর্জন করে থাকে তুলনামূলক কম সুদে আমানত গ্রহণ এবং তা অধিক সুদে ঋণ হিসেবে বিতরণ করার মাধ্যমে।

সুতরাং দেখা যায় যে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফা অর্জন ও সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে অধিক পরিমাণ আমানত সংগ্রহের ওপর।

৮. দক্ষ ব্যবস্থাপনার নীতি

বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যাংকিং ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জন করার ক্ষেত্রে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। আর এই ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বলতে বোঝায় কম খরচে অধিক সেবা প্রদান করা। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দক্ষতা অর্জনের জন্য দক্ষ কর্মী নিয়োগ, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দান এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে থাকে।

৯. মিতব্যয়িতার নীতি

যে কোনো কিছুতে মুনাফা বৃদ্ধি করতে হলে এর অন্যতম একটি উপায় হলো ব্যয় সংকোচিত করা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেবলমাত্র তখনই গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন এবং অধিক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে যখন তাঁরা স্বল্প ব্যয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং স্বল্প ব্যয়ে গ্রাহকদের উন্নততর সেবা প্রদান করতে পারবে।

১০. সুনামের নীতি

একমাত্র সুনামই যেকোনো ব্যবসায় সাফল্যের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ব্যাংকিং ব্যবসায়ও ঠিক তেমনই। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাজারে সুনাম প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।

১১. উদ্ভবনের নীতি

পৃথিবীর কোনো ব্যবসায় শুধু একটি ধারণা বা পণ্যই চিরস্থায়ী হয় না। কারণ প্রতিনিয়তই ব্যবসায়ের ধরন, মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন পরিবর্তিত হয়ে থাকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যই ব্যবসায়ের প্রকৃতি, ধরন, সেবার মান প্রভৃতিতেও পরিবর্তন আনা আবশ্যক।

সুতরাং, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকেও বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা, উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনে মনোযোগী হতে হবে। উদ্ভাবনী ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহই সাধারণত সাফল্য অর্জন করে থাকে।

১২. সময়ানুবর্তিতার নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংক একটি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। গ্রাহকদের সন্তুষ্টিই এই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক। সেজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সবসময়ই সময়ানুবর্তিতার নীতি অনুসরণ করে থাকে। গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় সময়ে সেবা প্রদান করাকেই তাঁরা আবশ্যক বলে মনে করে।

১৩. গোপনীয়তার নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করে থাকে। তাঁরা গ্রাহকের আমানত, আর্থিক লেনদেন ও সম্পদের হিসাব নিকাশ অন্য কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের নিকট প্রকাশ করে না। এতে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা অনেক বৃদ্ধি পায়।

১৪. সততার নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সততার নীতি অনুসরণ করে থাকে। সততা ব্যাংকের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অধিক আমানত সংগ্রহ এবং গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন।

১৫. প্রচারের নীতি

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রচার-প্রচারণায় অধিক গুরুত্ব দিতে হয়। কারণ নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচিতি ও নতুন উদ্ভাবিত ব্যাংকিং সেবা প্রভৃতি জনসাধারণের নিকট তুলে ধরার জন্য প্রচার-প্রচারণা অপরিহার্য একটি বিষয়।

পরিশেষ

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নীতিমালায় সম্পদ অর্জন ও তার ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। এ সকল নীতিমালা পালনের উপর নির্ভর করে এই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সফলতা।

বিজ্ঞাপন

যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এসকল নীতিমালা পালনে ব্যর্থ হয়, তবে তা প্রতিষ্ঠানগুলোর সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button