Disclaimer: This novel is entirely fictional. It has no resemblance to reality. If by chance any character or any particular event of this novel matches with anyone’s life, then this novel will not be responsible for that in any way. Moreover, this novel is not written to hurt anyone’s religious and political sentiments.
দীর্ঘ কয়েক মাস মায়ের সাথে কথা হয় না। কোনো চাকুরীও করছি না। তাই হাতে টাকা না থাকায় ঠিক বুঝে আসে না যে, কীভাবে আমি আমার পরিবারের পাশে বড় ছেলে হিসেবে দাঁড়াবো। আমার ছোট ভাই এখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে কিন্তু রাজনীতির বলয়ের মধ্যে ওর এখন বাস। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতি আজকাল ব্যক্তি উন্নয়নে অদৌ কোন ভূমিকা রাখে বলে মনে হয়। সেখানে সমাজ-রাষ্ট্র তো ছাড়।
এখানে আজ রাজনীতি হয় মৃত লাশ নিয়ে, অধর্মের প্রচার নিয়ে। রাজনীতি হয় ঘৃণা নিয়ে, এক সম্প্রাদায়ের সাথে আরেক সম্প্রাদায়কে উসকে দেবার মাধ্যমে। ব্রিটিশদের যাবার দু’শ বছর পরেও উপনেশবাদে ঢাকা এই ‘রাজবাড়ি’ শহরে এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি যে, মসজিদ এবং মন্দিরের জায়গা ঠিক কোথায় হবে? এই রাজনীতি লাখো বেকারদের জন্য নয়; ধনীদের প্রচারে প্রসারিত হতে থাকা ঘৃণা এবং উপনেশিক ধারার মানসিকতা ধরে।
দ্বিতীয়বার মুঠোফোনে রিং হতেই স্ক্রিনে আমি আবার আমার মায়ের নাম দেখতে পেলাম। তারপর সবুজ বোতামে হালকা চাপ দিয়ে মুঠোফোন টি কানে ধরলাম,
– স্লামালেকুম, মা। তুমি ঠিক আছো?
– ওয়ালাইকুম-সালাম, বাবা। হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। কিন্তু কয়েক মাস ধরে তোর যে কোন খবর নেই… তোর বন্ধুরাও কিছু জানে না…
– একটা চাকুরী পেয়েছি মা। তোমার কিছু লাগবে?
– বাবা… কিছু টাকা লাগতো। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডাক্তার বললো, “ছোটখাটো একটা অপারেশন করলে ভালো হয়।”
– কি বলছো এসব! আমি শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা করছি…
– হাসান… তুই কি আর গ্রামের বাড়িতে ফিরবি না?
– আমি খুব দ্রুত ফিরবো, মা। ছুটি পেলেই ফিরবো… তুমি শুধু কষ্ট করে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো…
– আচ্ছা, খোদা হাফেজ!
এরপর বিপ শব্দে লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ঠিক আমার মন্দ কপালের মত। মা কে ডাক্তার দেখাতে হবে। আমি এই বাড়ির পরিচারক না হলেও মিসেস দত্ত আমাকে মাসে মাসে যে মাইনে দেন তা অতি সামান্য। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। সেটা তো হাত খরচেই চলে যায়। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আসলে আঠাশ বছর বয়েস কত ভয়াবহ! আর চাকুরী বিহীন হলে তো বিভৎস।
স্নেহা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আমায়। আর কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– ডাক্তার বউ থাকতেও এত চিন্তিত হলে চলে না…
– ওহ্… তাহলে তুমি আমার সাথে আমার মায়ের কথাগুলো শুনছিলে?
– শ্বাশুড়ী মা হয় আমার, হাসান!
– এখনো হয়নি স্নেহা, তার উপর তুমি ভিন্ন ধর্মের…
– তাতে কি? এক কাজ করো, কিছু টাকা ওনাকে আগেই পাঠিয়ে দাও। তারপর আমি নিজে একদিন তোমার সাথে গিয়ে ওনাকে দেখা আসবো… ঠিকাছে?
– কিন্তু সেই টাকা কি আমি এখন চুরি করবো?
– ধূর, না। চুরি করবে কেন? আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি…
– দয়া দেখাচ্ছো! এমনিতেই এই পরিবার যা করছে আমার জন্য সেটার ঋণ এক জীবনে শোধ করতে পারবো কি না!
– হায় রে! টিপিক্যাল বাঙালীদের মত কথাবার্তা।
– তা তুমি কত জমিয়েছো? কত টাকা তোমার শুনি? হবু স্বামী তোমার আমি…
– খামোখা রেগে যাচ্ছো…
– না, আমি সত্যিই প্রশ্নটা করেছি?
– ঠিকাছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর জমানো সব গহনা দিয়ে এক কোটির মত হবে।
– তাই! আস্ত জমিদার দেখছি!
– হ্যাঁ, যা ইচ্ছে বলো। এর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা আগামীকাল মা কে পাঠাবে।
– তা এই ঋণ কি করে শোধ করবো? তোমায় বিয়ে করে?
– নাহ্, আমার মা যদি তোমায় মাসে মাসে পাঁচ হাজার করে দেন তাহলে আরো দশমাস বিনা পয়সায় এখানে খাটবে। আর এর মধ্যে কোনো চাকুরী পেলে বা তোমার লেখা বই হিট হয়ে গেলে টাকাগুলো শোধ করে দিও।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতেই স্নেহাকে নিজের রুমে খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম হয়তো সে তার নিজের রুমে ফিরে গেছে। ডিসিপ্লিনড্ ও কমপ্লেন গার্ল হয়তো এজন্য। তাছাড়া রাতভর এত ভারি গল্পে যে কারো মাথা ব্যাথা করতে বাধ্য।
একটুপরে অবশ্য কেউ একজন দরজায় এসে দাঁড়ালো। হ্যাঁ, স্নেহা। হাতে এক কাপ গরম কফি। সকালটা স্নেহার কফি না দিয়ে শুরু হলে ঠিক জমে না। দিনটাও কেমন কেমন জানি যায়।
– উঠো হাসান! এখন সময় কত হয়েছে খেয়াল আছে?
– না, স্নেহা একদম খেয়াল নেই। তবে এই সাদা-লাল শাড়ীতে তোমায় বেশ মানিয়েছে।
– এটা আমার মায়ের শাড়ি। তুমি বরং কফি নাও?
– নিশ্চয়, বেলাশেষের যাত্রী যে তুমি আমার।
– ঢপ… হাসান? শোন? তোমার টেবিলের উপর একটা চেক রাখা আছে। তারিখটা একটু বসিয়ে নিও। তুমি আজ-ই বের হচ্ছো, ঠিকাছে?
– মানে? মিসেস দত্ত কী ভাববেন?
– মা কে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।
– স্নেহা! বলছিলাম… আমার সাথে যাবে?
– কোথায়!
– কেন তোমার হবু স্বামীর বাড়িতে?
– আচ্ছা! এইবার মনে হয় মিসেস দত্ত মাইন্ড করবেন ফর শিওর।
স্নান করে উঠা স্নেহার লম্বা মেঘচুল আমার চেহারায় পড়তে বুঝতে পারছিলাম, সু-প্রভাতের চুমু বাদ পড়ে গেছে। আর এটাও বুঝতে পারছিলাম কেন লেখক আর কবিগণ লম্বা কালোকেশের বর্ণনা তাঁদের লেখায় দীর্ঘ করেন।
তারপর ওর ঠোঁটের হালকা মুচকি হাসি আমায় যেনো অনুমতি দিলো। অনেকদিন পর ফিরবো আমার সবুজ গ্রামে। তাও আবার স্নেহার মত কারো সাথে। যেখানে শহরের ছোঁয়া এখন অবধি লাগেনি। মেঠোপথ দেখে স্নেহার নিশ্চয় ভালো লাগবে।
আর ফেলে আসা আমার কিছু বন্ধুরা। ওদের কথাও মনে পড়ে গেল। কেমন আছে ওরা! না কি সবাই রাজধানীতে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে! জানিনা, কিচ্ছু জানি না।
– তা, তুমি স্নান করে তৈরি হয়ে নাও হাসান? আমি গাড়ি বের করছি। সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের আবার ফিরতে হবে।
– ওকে, আপনার যা মর্জি, ম্যাডাম
ক্লাসে একদিন স্যার বিবর্তনের পাঠে বুঝিয়েছিলেন, কীভাবে একজন নারী সমাজের বিবর্তনের অংশ? একজন নারী নির্ধারণ করেন পরবর্তী প্রজন্ম কেমন হবে? আবার ওরা ভুল প্রেমের ফাঁদে পড়ে না তাও নয়। কিন্তু জীবনকে বর্ধিত করার দায়িত্ব ওদের হাতে থাকায় বিবর্তনের এই অংশে নারীরা পুরুষদের অনেক ডোমিনেট করার ক্ষমতা রাখে।
একজন পুরুষ চাইলেই তার পছন্দের নারীকে বিছানায় পেতে পারে না। কিন্তু একজন নারী চাইলে? গল্পটা ভিন্ন হতেও পারে। তাই উপসংহারে হয়তো এটা বলে স্যার শেষ করেছিলেন, “বিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীরা নির্ধারণ করেন পরবর্তী সমাজ কেমন হবে, পুরুষরা নয়।”
শহর থেকেই গ্রামে প্রবেশ করতেই গ্রামের মেঠোপথের এবড়ো-থেবড়ো চেহারা স্নেহার একটু হলেও বিরুক্তির কারণ হলো। মোটামুটি তিনঘন্টার লং ড্রাইভে স্নেহা ক্লান্ত তো বটেই তবে মুখে পেপসির বোতল নিয়ে জানান দিলো সে বেশ উৎসুক এবং খুবই আনন্দিত এখানে আসতে পেরে। আমি ওর হাতে হাত রেখে সায় দিলাম যেনো, “তোমার এই কষ্টের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত!”
আমাদের বাড়িটা গ্রামের বাড়িগুলোর আদলে তৈরি। মাটির এই বাড়িগুলো বাংলার সমাজের এখনো ঐতিহ্য। আর তো ক’টা দিন তারপর এসবও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অবাক হতে হয়! চারপাশে যেভাবে ইট-পাথরের বাড়ি গড়ে উঠছে। এখন আর বোঝার জো নেই ক’টা দিন আগেও এটা একটি গ্রাম ছিলো।
মা কে পূর্বেই ফোন দিয়ে জানিয়েছিলাম। ফোনেই বুঝতে পারছিলাম, মা অনেক খুশী হয়েছেন। হাজারহোক আঠাশ বছর বয়স হলেও কেউ জুটেছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই মা কে একটি সত্য কথা বলতে পারিনি। আর তা হলো, ‘ধর্ম’।
বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতেই কারের উইন্ডশিল্ড দিয়ে সামনে মা কে দেখতে পেলাম। ঠিক কত মাস পর আবার মা কে দেখছি মনে পড়ছে না। কিন্তু স্নেহা না থাকলে আজ হয়তো এটাও সম্ভব হত না। স্নেহাকে ইশারা করলাম, “ঐ যে শাড়ি পড়ে মাথায় কাপড় দেয়া মহিলাটি হচ্ছেন আমার মা”। স্নেহা টের পেতেই কারে ব্রেক কষলো। তারপর গিয়ারে হাত দিয়ে এক ধাপ পিছনে হটিয়ে কারটি পার্ক করলো বাড়ির সামনের আঙ্গিনায়।
স্নেহার টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরা দেখে মা চমকে যাবেন বলে আমার ধারণা ছিলো। কিন্তু ঘটলো তার উল্টো। চোখমুখ তার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কার থেকে নেমেই স্নেহা সোজা গিয়ে আমার মা কে “আদাব” জানালো এরপর সোজা গিয়ে পায়ে সালাম নিতেও ভুললো না। একমূহুর্তের জন্য মনে হলো, “এই নারী জাতি বড্ড অদ্ভূত।” মা তখন এত বকবক করছিলো, যে ওসব আমি থোড়াই কেয়ার করি।
“তুমি স্নেহা! তাই না? হাসান তোমার কথা ফোনে আমাকে কতবার জানিয়েছে। সত্যিই তুমি অনেক সুন্দরী, মা। আমি অত্যন্ত দুঃখিত মা যে, তোমাদের মত করে বরণ করার নিয়ম-রীতি আমাদের নেই। কিছু মনে করোনি তো?”
বুঝলাম না, মা কে তো ধর্ম-অধর্মের কথা কিচ্ছু বলিনি। কীভাবে টের পেলেন? তার ওপর এই ঢালিউড সিনেমার ডায়ালগ দিচ্ছেন কেন? উফ্! ঠিকাছে দেখি তোমাদের হবু বউ-শ্বাশুড়ীর কতক্ষণ চলে!
হ্যাঁ, এবার স্নেহার পালা…
“মা, রাস্তা একটু খারাপ ছিলো। তানাহলে সকাল দশটার মধ্যেই পৌঁছে যেতাম। আর আমি অতসব ধর্ম-কর্মও মানি না। প্লিজ! এভাবে বলবেন না।”
স্নেহা প্রায় আশির গতিতে গাড়ি টেনেছে। আর বের হয়েছি সাতসকালে। নূন্যতম এতটুকু সময় তো লাগতো-ই। আদিখ্যেতা… তবে দত্ত বাড়িতে নিয়মিত পূজো পাঠ কে করে? স্নেহার ভূত? সেখানেও মিথ্যে কথা। কী জানি শুরুতেই হয়তো প্যাচ লাগানো ঠিক হবে না। পরে যখন একপাশে মা নামাজ পড়বেন আর অন্য পাশে তার শ্রদ্ধেয় বউ মা পূজো করবে তখন দেখা যাবে।
‘দত্ত পরিবার’ উপন্যাসের ৪র্থ পর্ব পড়ুনঃ উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব – ০৪)