উপন্যাস: দত্ত পরিবার

উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব – ০৬)

ফিরে দেখা শৈশব ও বর্তমানের টানাপোড়েন

Disclaimer: This novel is entirely fictional. It has no resemblance to reality. If by chance any character or any particular event of this novel matches with anyone’s life, then this novel will not be responsible for that in any way. Moreover, this novel is not written to hurt anyone’s religious and political sentiments.

একটু বাদেই রাজু আসলো আমাদের ব্যাগগুলো নেবার জন্য। ছোট থেকেই আমাদের বাড়িতেই রাজু বড় হয়েছে। ওর মা স্তন্যদায়িনী ছিলো। এরপর ব্রেস্ট-ক্যান্সারে তিনি মারা যান। তারপর থেকে রাজু আমার ছোট ভাইয়ের মত করে আমাদের বাড়িতেই থাকে।

মানে শিহাব আর রাজুর মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক সহোদর ভাইয়ের মত। এখন অনার্স করছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, দ্বিতীয় বর্ষ। ছেলেটা বেশ বিনয়ী। আমাদের দেখে খুব খুশী হয়েছে, সেটা ওর চোখেমুখে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

– তা ভাইয়া, কিছু খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি?

– আগে তো বাড়ির ভিতরে যেতে দে? কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? অনেক দিন আপনার কোন খোঁজখবর নেই? মা প্রত্যেকদিন আপনার জন্য দোয়া করেন আর কাঁদেন।

– রাজু, শোন? স্নেহা কে ওর রুমটা দেখিয়ে দে?

– কেন? আপনারা কি আলাদা রুমে থাকবেন না কি!

রাজুর এই শেষ কথা শুনে স্নেহা লজ্জায় লাল। অন্যদিকে মা হাসিতে ফেটে পড়েছেন যেন। সত্যি বলতে আমি যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে কোনো দ্বন্দ্ব-ই ঘটছে না। অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে, মা স্নেহার জন্য আলাদা পূজো করার রুম বানিয়েছেন। আর একজন গ্রামের বৃদ্ধ ঠাকুর ঠিক করে রেখেছেন।

তিনি সময় সময় করে এসে পূজা পাঠ করাবেন স্নেহা কে। আর অন্যদিকে স্নেহা মায়ের জন্য নামাজের অজুর জল প্রস্তুত রেখেছে। বুঝতে পারছিনা এসব দেখে কি আমার মাথা খারাপ হওয়ার কথা না কি খুশী হবার কথা!

স্নেহা সকাল থেকে মায়ের সাথেই আছে। কী সব আলাপ চলছে উপরওয়ালা ভালো বলতে পারবেন। স্নেহা কে একটু একা পাবো বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু মন্দ কপাল আমার। অবশ্য দুপুরের খাবার শেষে বিকেলে স্নেহা বললো, “আমি মা কে ফোন করে এখানে আসার কথা বলেছি। আর উনি কয়েকটা দিন আমাকে এখানেই থাকতে বলেছেন।”

হুম, মিসেস দত্তের মাথাটাও খারাপ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই কয়েকদিনে এই হবু বউ-শ্বাশুড়ীর একটা ঝগড়া আর কে আটকায়! হঠাৎ করে শিহাব আমার রুমে এসে বললো, “ভাইয়া, আপনাকে মা ডাকছে।”

দেরি না করে তাদের কীর্তি দেখতে গেলাম,

– স্নেহা! এসব কি বানাচ্ছো?

– কেন? ফিরনি, পায়েস আর ভাপা পিঠা…

সম্পর্কিত নিবন্ধ

– মা, স্নেহা একজন ডাক্তার! ওকে দিয়ে এসব কী করাচ্ছো? হাত পুড়বে? তার উপর মাটির চুলা!

– আমি সেটা জানি, হাসান। তুই একটু গ্রামটা ঘুরে দেখ না? অনেকদিন পর গ্রামে ফিরলি!

– হ্যাঁ, তাই তো! আর তোমরা ভাপা পিঠার ক্লিনিক খুলে বসো… সত্যিই যাচ্ছি কিন্তু… একবার ভেবো দেখো…

গ্রামে বের হতেই অতীতের বহু স্মৃতি জাপটে ধরা আরম্ভ করলো। খানিকটা খামখেয়ালি হওয়ায় চিন্তার মধ্যে অসংখ্য তথ্য এসে হাজির হচ্ছে আর জানান দিচ্ছে নানান কথা। কীভাবে যেন সেই শৈশব পেরিয়ে আজ আঠাশে অবস্থান করছি তা সময়ের নেহাৎ দোষ। শৈশব আরো একটু দীর্ঘ হলে পুরো ব্রক্ষ্মান্ডের কোন সমস্যা হত কি!

হয়তো হত, তাই আমাকে সেই স্বর্ণালী শৈশব থেকে সময় আমাকে ডিস্কার্ড করেছে। এই সুদীর্ঘ সবুজ ধানের ক্ষেত, এই দীঘি, এই তালগাছ, লম্বা মেঠোপথ, খেজুর গাছের রস, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের বিস্তৃত বাগানের আম চুরি করে খাওয়া আর চকোলেটের বন্ধুত্ব। যদিওবা সেই প্রাইমারী আজ মরি-বাঁচি করে বাজে ইলেক্ট্রিক বাল্বের মত আচরণ করছে।

একটু বাদেই হুজুরের কথা মনে পড়লো। উনি ইসলাম ধর্ম পড়াতেন। খুব যত্ন নিয়ে পড়াতেন। ভুল করলে বা দুষ্টুমি করলে কান ধরে ক্লাসের বাহিরে বসে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখতেন। আর দুই লাইন সুন্দর করে পবিত্র আল-কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করলে খুশীতে দিশেহারা হয়ে উনার চোখে জল চলে আসতো। আর বারবার বলতেন, “সাচ্চা মুসলমান হতে শিখ। বিশ্ব জুড়ে আগুন জ্বলছে। ধর্মের নামে অর্ধম করিস না।”

ওনার স্বপ্ন ছিলো, আমাকে এই প্রাইমারীতে শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবী থেকে প্রস্থান করবেন। প্রয়োজনে সার্টিফিকেটে জালিয়াতি করে আমাকে উনার সন্তান বানিয়ে দিবেন, তবুও উনার পোস্টিংটাই আমাকে দেবেন।

ওনার অন্ধ বিশ্বাস আমার প্রতি যে, আমি ছাড়া ইসলাম ধর্ম কেউ ভালোভাবে বুঝাতে পারবে না। আমি পারিনি, আমি উনাকে নিজের অজান্তে অনেক কষ্ট দিয়েছি। পবিত্র আল-কুরআন তেলওয়াত করে বছর শেষে প্রতিবার প্রথম হবার পুরষ্কার আমি জিতে নিতাম। আসলে রহস্য হচ্ছে বিচারকের সিটে সবসময় উনি ছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন ইসলামিক স্কলার কেন এভাবে ছোট্ট গ্রামে পড়েছিলেন সেটা আজও বুঝিনি। সকাল বেলা পান মুখে দিয়ে পিক ফেলতে ফেলতে বলতেন, “জানিস হাসান, আমাকে ওরা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিলো না। আমি নামাজ পড়াই, লম্বা দাঁড়ি আর এই টুপিটাই তার কারণ। আমি অবশ্য মন খারাপ করিনি, বুঝিসনি… এই হাতে একদিন বাধ্য হয়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম। আমার ভাষা, আমার দেশ… কিন্তু গর্বিত আমি বাঙালী এবং একজন সাচ্চা মুসলমান। এটা প্রমাণ করার জন্য সার্টিফিকেট দিবা কি দিবা না তোরা বোঝ।”

এই কথাগুলো শুনতাম আর বুঝতাম উনার মনের মধ্যে চাপা একটা তীব্র অভিমান আছে। মিজানুর রহমান শুধু একজন শিক্ষক নয়, তিনি যেন এই সমাজের একজন আদর্শ। আচ্ছা, তিনি কি বেঁচে আছেন? থাকলেও বা কি! কি মুখ নিয়ে আমি উনার সামনে দাঁড়াবো। সবকিছু না কি চলে যাবে নষ্টের হাতে। হঠাৎ দূর থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় খুব কষ্ট করে ডাকলেন, “এই হাসান… এই হাসান… তুই এসেছিস…”

পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম একজন বৃদ্ধ। হাতে লাঠি নিয়ে খুব কষ্ট করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। প্রথম দিকে চিনতে সমস্যা হচ্ছিলো। একটু পর টের পেলাম, আমার মিজান হুজুর!

– হুজুর, আপনি! আমাকে চিনতে পারলেন কি করে?

– তোর মায়ের কাছে শুনলাম তুই বাড়িতে এসেছিস। চায়ের দোকানে না পেয়ে বুঝলাম এই সুবর্ণ দীঘিতে থাকবি। অনুমান ঠিক ছিলো না কি সেডা কও?

হতভম্ব হয়ে আমি উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। একটু এগিয়ে উনাকে ধরে এনে বাঁশের চরাটের ওপর আস্তে করে বসালাম। বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছেন।

– (একটু মাথা নত করে) স্লামালেকুম হুজুর! কেমন আছেন? আপনার শরীর কেমন?

– আগে তো সালাম দেওয়া ভালো করে শিখ। ওটা “আস-সালামু আলাইকুম” হবে রে গাধা। শুনলাম এক হিন্দু মেয়ে কে ধরে এনেছিস?

– ইয়ে মানে… জি, হুজুর।

– ভালোবাসিস ও কে?

– জি, হুজুর

– হুম, চাকরী জুটলো?

– জি না, হুজুর

– আমার পোস্টিংটা এখনো খালি আছে রে ব্যাটা। তুই যাবার পর ঐ পোস্টে কাউকে ঢুকতে দেয়নি। অপেক্ষায় ছিলাম তুই একদিন আসবি।

– কিন্তু হুজুর আমি কর্পোরেট কোন জবের প্রতি আগ্রহী।

– আরেহ্ দূর! আমার বেত কই? থাকলে দুটো পাছায় কষে মারতাম।

– হুজুর, আমি আসলে বুঝিনি!

– গাধা কখনো ঘোড়া হয় রে! বিয়ে করে কি খাওয়াবি? তার উপর শুনলাম মেয়েটা ডাক্তার। আচ্ছা, এটা কও কীসের ডাক্তার? হাড়-হাড্ডির হলে আমার খুব ভালো হত। কোমরে খুব ব্যাথা করে সময় সময়।

– কিন্তু হুজুর, একে তো মেয়ে তার উপর হিন্দু। চলবে?

– দৌঁড়াবে, একদিন ও কে আমার বাড়িতে নিয়ে আনিস। তোর আন্টি দারুণ বিরিয়ানি বানায়।

– কিন্তু…!

– কিন্তু কি? ধর্ম শিখিয়েছি তাই অধর্মের কথা বলায় শিউরে উঠছিস? মানবধর্ম নামে তোদের দর্শনে কী জানি একটা শব্দ আছে। সময় সময় আমিও পইড়া দেখি তোদের প্রেসক্রাইবড লেখা।

– হুজুর, একটা অনুরোধ ছিলো…

– এত ভদ্রতা কবে থেকে শিখলি! না কি সব ঐ হিন্দু মেয়েটা কিছু আদর্শলিপি তোর মনে গাঁথতে পারছে!

– না, তা নয়। ইয়ে মানে…

– কি ইয়ে মানে…!

– ইয়ে মানে… হুজুর আমাদের বিয়েটা আপনি যদি পড়াতেন?

– তুই কি অন্য হুজুর ঠিক করেছিস না কি?… বিয়েটা আমি পড়াবো… আমার ছেলের বিয়ে আমি পড়াবো…

– হুজুর বেয়াদবি নিবেন না, হিন্দু মেয়েটাকে আমাদের গ্রাম মেনে নিতে পারবে তো!

– হা…হা…হা… যে গ্রামের মানুষ তোর চায়ের বিল পর্যন্ত দ্যায়না তাদের তুই এখনো তোয়াক্কা করিস!

– না, হুজুর… ভয় হয় এই এক বিয়ে আপনার পুরো জীবনকে কলঙ্কিত করে দেবে। এই সমাজ কিছুতেই মেনে নিবে না।

– বলছিস! তাইলে এটাও কও, আমার কবরে তুই থাকবি? থাকবি না তো! উপর আল্লাহর সাথে আমি মিটমাট করে নিবানি। কিন্তু তোকে এভাবে দেখে যেতে পারবো না রে…

– কিন্তু…

– শোন, সময় হলে একবার চায়ের দোকানটায় আসিস। এখন উঠি তোর আন্টি আবার আমায় ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। আর পোস্টিংটা এখনো খালি আছে তাছাড়া বেতনও বাড়াই দিছে সরকার।

আস্তে আস্তে বাঁশের চরাট থেকে উঠে প্রস্থান নিচ্ছেন আমার মিজান হুজুর। এখনো প্রায় অন্ধকার কিন্তু আলোর সৎকার এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। উনার নিজের কোন ছেলে মেয়ে নেই। আমাকেই নিজের ছেলের মত মানুষ করেছেন, খেয়াল রেখেছেন।

চোখের এক কোণে জলবিন্দু জানান দিলো আমি খুব কষ্ট দিয়েছি ওনাকে। আমার অজান্তে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। অস্ফুটে বলে উঠলাম, “মাফ করে দিবেন প্রিয় মিজান হুজুর, আমি আপনার একজন ব্যর্থ ছাত্র।”

‘দত্ত পরিবার’ উপন্যাসের ৫ম পর্ব পড়ুনঃ উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব – ০৫)

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও চেক করুন!
Close
Back to top button