Disclaimer: This novel is entirely fictional. It has no resemblance to reality. If by chance any character or any particular event of this novel matches with anyone’s life, then this novel will not be responsible for that in any way. Moreover, this novel is not written to hurt anyone’s religious and political sentiments.
অনেকদিন পর গ্রামে ফেরা। তাই চারপাশটা বেশ নতুন লাগছে। নতুন নতুন সাজে সেজে উঠেছে আমার প্রিয় গ্রাম। কিন্তু কোথাও না কোথাও জানি কিছু একটা নেই… কিছু একটা নেই… চারপাশে ঘুরেফিরে দেখছিলাম আমি আমার গ্রামটাকে। হঠাৎ মনে পড়লো আমার অতি পরিচিত পুরনো চায়ের দোকান। অদ্ভুত এই দোকান। ঠিক কবে থেকে এখানে বিজন দাদা কাজ করছেন সেটা তিনি নিজেও জানেন না। কয়েকবার অবশ্য জিগ্যেস করেছিলাম; কিন্তু তিনি কিছুই মনে করতে পারছিলেন না।
অবশ্য এখন আমার রুটিন হচ্ছে, ঐ চায়ের দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে সন্ধার এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাটাবো। একা, একান্ত একা। ওখানে আমার অনেক স্মৃতি পড়ে রয়েছে। তাই দেরি না করে ফেলে আসা স্মৃতির সন্ধানে পথ ধরলাম বিজন দাদার চায়ের দোকানে। বিজন দাদা প্রথম দেখাতেই চমকে উঠলেন যেন। হ্যা… করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, যেন ভূত দেখেছেন!
– আদাব, বাবু। কড়া লিকার? তাই তো?
– আদাব, দাদা। আহ্ কড়া লিকার! আপনার এখনো মনে আছে!
– বাবু, আমাদের মাথা তো আর তোমাদের ঐ স্মার্টফোনের মত নয় যে, ভাইরাস ঢুকে সব ভুইলা দিবো।
– তা ঠিক বলেছেন। অমিত এখন কী করে?
– ওই আর কি… জমি দেখাশোনা করছে। কিছু জমি বর্গাও নিছে। অনার্স শ্যাষ কইরা তো কোন চাকরি পাইলো না। একটু পর ওর আসোনের কথা…
একটু পরেই গিটারিস্ট অমিতের গলায় গামছা, একেবারে চাষীর বেশে এন্ট্রি নিলো। ওর গিটারের হাত এত ভালো ছিলো যে, মেয়েরা রীতিমত প্রেমের প্রস্তাবে ও কে বিরুক্ত করতো। চায়ের দোকানে ঢুকেই লিকার, সুগার আর গরম জলের কেটলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একেবার পেশাদার চা-ওয়ালার মতন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অমিত ছিলো আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অমিত মানেই আমতলা, একটা নস্টালজিক ক্যারেক্টার। হাতে গিটার আর কোঁকড়ানো চুল। বেশ লম্বা ও সুদর্শন। একটু খামখেয়ালি। সমস্ত হইচই এর মধ্যে এক স্নিগ্ধ কন্ঠে গান ধরতো। নিজে গান লিখতো আর সেসবের সুরও নিজেই দিত।
আশেপাশে জড়ো হয়ে যেত দর্শন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা। কখনো কখনো সে আড্ডায় শিক্ষকদের দেখে প্রাণ ও মন দুটোই জুড়িয়ে যেত। কিন্তু কথা কম বলতো, শব্দ অপচয়ে প্রচুর অনীহা ছিলো। নিজ বিভাগের এক সিনিয়র মেয়ের সাথে প্রায় প্রায় ঝগড়া করতে দেখতাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম ওরা একে অপরকে পছন্দ করে। অমিতের স্নাতক শেষ না হতেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়।
তারপর থেকে ক্লাসে অমিতকে অনিয়মিত এবং আনমনা বা খানিকটা মনমরা হিসেবেই পেয়েছি। কিছুই পরিষ্কার করে বলতো না ফলে অজানা বা ঢাকা পড়তো অনেক কথা। হাজারো সিক্রেটের মাঝে শুধু একটা ওপেন-সিক্রেট ছিলো, সেটা হচ্ছে আমাদের বন্ধুত্ব।
পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেছে। চাকুরীর প্রস্তুতি, জীবিকার জন্য ছোটাছুটি। এতকিছুর মধ্যে বন্ধুত্বের সেসব মধুর দিনগুলো এখন স্রেফ পুরনো ব্যাকেট লিস্ট।
স্মৃতি থেকে ছিটকে পড়তেই দেখি অমিত আমার সামনে আর ওর হাতে দু’কাপ র’চা। “কিহ্, হাসান… বাসায় আসলি অথচ একটা ফোনকল করার প্রয়োজনও বোধ করলি না!” – অমিত বেশ ঠান্ডা গলায় বললো। প্রত্যুত্তর দেওয়া জরুরী নয় বোধহয় ভেবে কথোপকথন শুরু করলাম…
– তা অমিত, এখন থেকে তোকে চা-ওয়ালা মামা বলে চিনবো না কি?
– তোর ইচ্ছে, এখানে বেশ আছি। একেবারে নির্ঝঞ্জাট। গ্রামের মানুষদের চা খাইয়ে ভালোই ইন্টারটেইন করা যায়।
– সে না হয় বুঝলাম কিন্তু হাতে গিটার কই?
– আমাদের শহরে সবাই বড্ড ব্যস্ত। এর মাঝে গান শুনবে আর কে? হাসান, তুই নিজেও গান শোনবার মত সময় পাস?
– হুম… সবাই খুব ব্যস্ত
– তাই বলি কি মামা, চা ঠান্ডা হবার আগে চায়ে চুমুকটা দিয়ে নাও।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন খুঁজছিলাম। বন্ধুকে এভাবে দেখবো সেটা কখনো কল্পনাও করিনি। ওর যা কন্ঠ তাতে এন্ড্রু কিশোরও হার মেনে যাবে। আজকে ওর স্টেজে থাকা দরকার ছিলো, চারপাশে লাইট আর উৎসুক জনতা। স্টেজের সামনে মেয়ে ফ্যানদের ঢল আর কোন এক নামকরা টিভির ক্যামেরা লাইভ করবে অমিতকে। আর তার একটু পরেই অমিত গেয়ে উঠতো,
“নিষ্পাপ নগরীতে, মাথা তোলা যত ঝড়
আমি বন্ধু তাই জানাতে এসেছি
তুমি আজ সফল
হুমম… তুমি আজ সফল
কিন্তু ভুলে গেছি ও… ঝড়
কত জীবিত লাশের তুমি কর্মের ফল…”
এরকম আরো কত অসাধারণ গান! ওর প্রথম অ্যালবাম। নাহ্, বের হয়নি। হঠাৎ আনমনে বলে উঠলাম, “অমিত তুই আবার ইউটার্ণ নিতে পারিস কিন্তু… ।” অমিত কিছু না বলেই উঠে দাঁড়ালো আর বললো, “শোন, দুইজন কাস্টমার বসে আছে। আমি ওদের চা দিয়ে আসি।”
কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, অমিতের উত্তর না নিয়ে আজ ও কে ছাড়বোনা কোনোমতেই তাই বলে উঠলাম, “আর শোন… এবার গানগুলো আমি নিজেই প্রযোজনা করবো, অমিত।” কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। অমিত শুধু বললো,
“দর্শন নিয়ে পড়েছিস, আমিও পড়েছি। হাজারো শব্দ আর কথার প্যাচে তুই হয়তো একটা জীবন দর্শন ভুলে গেছিস। তাই ভালো হয় জেনে রাখ, তোর চোখে হয়তো আমি বাংলার সেরা কন্ঠ শিল্পী। কিন্তু এই পৃথিবীতে অনেক সুদর্শন এবং ভালো অভিনেতাও আছেন যারা এখনো সেলুলয়েডের পাতায় হাজির-ই হোননি। সবচেয়ে ভালো লেখক আজ অবধি হয়তো কোন গল্পই লিখেন নি। আর সবচেয়ে ভালো শিল্পী গানও করেননি। এটাকে ‘করতে পারেনি’ বা ‘করেননি’ যে তকমাই দে কিন্তু এটাই সত্যি। যাকগে, তুই আরো এক কাপ চা নিচ্ছিস, বুঝলি?”
আমি নির্বিকার হয়ে শুধু মাথা নাড়ালাম, “ঠিকাছে”। একটুবাদেই অমিত আবার ফিরে আসলো। তারপর হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, তুই কি আগের মতই এরকম বোরিং আছিস? একটু চিল কর না! শুনলাম তোর বাসায় নতুন পাখি এসে বাসা বেঁধেছে?
– চিল… কোন কাক যে কা…কা… শব্দে এই খবরগুলো আমার কাছের মানুষদের দিয়ে যাচ্ছে আমি এখন ডিটেক্টিভ হয়ে তাকে খুঁজে বের করতে নামবো ভাবছি।
– কিহ্! হাসান? কীভাবে পরিচয়?
– কাকতালীয়… একটু আগে চিল বললি তাই সব কাক-কাক হয়ে যাচ্ছে আর কি!
– যাই বল, মেয়েটা কিন্তু শ্রেয়সী।
– হ্যাঁ, তোদের সম্প্রদায়ের।
– তো? এত চাপ নিচ্ছিস ক্যান? ১৯৪৭ সাল অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। ওসব আর কেউ ধরে নেই।
– অমিত… বামপন্থী ছাত্র নেতার ভাষণ শুনেও লাভ নেই। বাংলায় আর লেনিন চলে না। শেষে দেখবি আমার কপালে বরাবরের মত সম্প্রাদান কারকে শূন্য বিভক্তি লেগে আছে। যেমন ধর, গুরু দক্ষিণা দাও…
– হা হা হা… হায়রে! আমার ডানপন্থী বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দপ্তর সম্পাদকের নাম কি যেন ছিলো! হ্যাঁ, মনে পড়েছে… ‘হাসান’ নামের এক লোক। খুব ডেডিকেটেড ছিলো।
– ক্যাম্পাস নিয়েই যখন এত কথা হচ্ছে তাহলে তোর ঘোমটাও একটু খোল অমিত? বিয়ে-শাদী কিছু করেছিস?
– দেখ দোস্ত, বিয়েটা অন্তত আমার জন্য জরুরী নয়। তাছাড়া ইচ্ছেও নেই।
– আর গিটার?
– ভাঙারির দোকানে কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছি।
– শিল্প-সাহিত্য তবে বুঝি উচ্ছন্নে যাচ্ছে দিনদিন…
– লাভ নেই, পরে কোন এক পত্রিকার হেডলাইনে দেখবি, “বিখ্যাত শিল্পী অমিত এখন উবারের ড্রাইভার!”
– খারাপ বলিসনি…
– তা তুই সিভিল সার্ভিস জবে চেষ্টা করছিস তো? তোর মুখে কারক-বিভক্তি শুনে মনে হলো…
– নাহ, আমার ভিতর থেকে ইচ্ছে নেই। কিন্তু স্নেহার দিকটা আলাদা, মানে এখনো বুঝতে পারিনি পুরোটা…
– ওহ, স্নেহা!… সারনেম কি?
– দত্ত… স্নেহা দত্ত
– সুন্দর নাম, শোন আজ আর কথা বাড়াচ্ছি না। তুই আগামীকাল একবার ফ্রি হয়ে আমার সাথে দেখা কর। অবশ্য যদি সময় হয় তো…
– চেষ্টা করবো, অমিত…
এরপর অমিত তার এই নতুন ঢঙে কাজ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একদম পেশাদার চা-ওয়ালা। আর আমি চায়ের কাপে মনোযোগী হয়ে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত, একরোখা অমিত একরোখাই থেকে যাবে সেটা আমি জানতাম। ওর হিসেব আমি মেলাতে পারিনা। খুব সম্ভবত মিলাতেও চাই না। আমি শুধু আমার বন্ধুকে এভাবে দেখতে পারি না।
আমার আসলে নতুন উপন্যাসে ফোকাস করা উচিত। নতুন নতুন উপাদান নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথম উপন্যাসটা যেভাবেই হোক আগামী বই মেলায় হিট করতেই হবে। কিন্তু বই মেলায় হিট হতে হবে কেন?
ওহ্, মানে বইমেলা ছাড়া এখানে কেউ বই কিনে না বা নেহাৎ দায়ে পরে কেউ কেউ কিনে থাকে। আর এই পূর্ব ধারণা শুধু আমার নয় হয়তো। আচ্ছা, স্নেহাও কি এটাই চায়? স্নেহা কি চায় আমি একজন লেখক হই? না কি করুণার পাত্র মাত্র হয়ে যাচ্ছি?
স্নেহার কথা ভাবতেই ফোনে ওর নাম ভেসে উঠলো। রিসিভ করে ওর কন্ঠস্বর শুনতেই বুঝলাম অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
– হ্যাঁ, স্নেহা
– কি ব্যাপার হাসান সাহেব! নিজের গ্রামে ফিরতেই আমাকে বেমালুম ভুলে গেলেন না কি!
– না, আমার এক বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
– তা তোমার এই বন্ধু কি করে?
– চা-ওয়ালা, আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম…
– আচ্ছা, নাম কি ওর?
– অমিত
– অমিত! দর্শন বিভাগের কেউ?
– হ্যাঁ! তুমি কি ও কে চিনো!
– সবাই চিনে, রাজবাড়ী শহরের বামপন্থী দলের একজন ছাত্র নেতা। রাইট?
– হ্যাঁ! কিন্তু?
– বাসায় এসো হাসান? মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এরপর লাইনটি বিপ শব্দে কেটে গেল। আর আমি হাতড়াতে লাগলাম হঠাৎ গন্ধ পাওয়া কোন পুরনো অসুখ কে।
‘দত্ত পরিবার’ উপন্যাসের ৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুনঃ উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব – ০৬)