Disclaimer: This novel is entirely fictional. It has no resemblance to reality. If by chance any character or any particular event of this novel matches with anyone’s life, then this novel will not be responsible for that in any way. Moreover, this novel is not written to hurt anyone’s religious and political sentiments.
বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় তখন রাত দশটা। গ্রামের মানুষজন রাতের খাবার একটু আগেভাগেই সারিয়ে নেন। এই মোটামুটি রাত ৮টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে। কারণ, আবার সাতসকালে উঠে ক্ষেত-খামারে যেতে হয় চাষবাস করবার জন্য।
মা আমার গায়ে রক্ত দেখে বুঝলেন আমি আবার কোনো বাজে অভিজ্ঞতার সাথে মুখোমুখি হয়েছি। আর এই ভয়েই মা আমাকে শহরে পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। তারপর ভালো একটা চাকুরী পেলে আরো দশজনের মত সাধারণ জীবনযাপন করতে পারবো বলে তার মনে হয়েছিলো।
কিন্তু স্নেহা এমন অবস্থায় আমাকে দেখে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়লো। দ্রুত ওর পুরনো এক ব্যাগ ঘর থেকে এনে জায়গা মত প্রাথমিক ভাবে ব্যান্ডেজ করে দিলো। মোট তিনটে সেলাই পড়লো। হালকা অ্যালকোহল ঢেলে খুব দ্রুত অবস্থার ব্যবস্থা নিচ্ছিলো আর ওর হাত কাঁপছিলো।
স্নেহার মুখে কোনো কথা নেই; প্রশ্নও নেই। ব্যান্ডেজ করা শেষে আমার দিকে একবার তাকালো, আর রাগে হিস হিস করতে লাগলো। একটুবাদে অবশ্য মুখ খুললো,
– এত রাতে বাইরে না থাকলেই নয় বুঝি? কি এমন মহান কর্ম সম্পন্ন করছিলে?
আমি বুঝতে পারছি, এভাবে আক্রমণ করা বোধহয় ঠিক হয়নি। এড়িয়ে যাবার সুযোগ ছিলো। কিন্তু যে রক্ত বিপ্লবের রক্ত, যে রক্ত যৌবনের রক্ত তা নিজেকে ঢাকতে দেয় না। মুখোমুখি হতে বাধ্য করায়।
জানি, মা আমার পুরনো চেহারা একদম পছন্দ করেন না। আমি আবার সেই রঙ পাল্টাবো সেটা তার চিন্তার বাহুল্য। তিনি বরং ভাবেন যে, আমি সাদামাটা কোনো সরকারি চাকর হবো আর সাধারণ মানুষ স্যার… স্যার… বলে ডাকবেন সেটাই বরং অধিক গ্রহণযোগ্য।
তাই আস্তে করে শুধু বললেন, “আমরা এখনো কেউ কিছু খাইনি। রাতের খাবার নষ্ট হবার পথে। ফ্রেশ হয়ে খাবারের টেবিলে এসো।” হঠাৎ শিহাব নির্বিকারভাবে বললো, “ভাইয়া, আপনি আমায় আমায় একবার এস.এম.এস করলেও পারতেন… ।”
খাবার শেষে নিজ রুমে ফিরে এলাম। আমি জানি আজ আমার সাথে কেউ কথা বলবে না। যা ঘটেছে তার জন্য আমার লজ্জা লাগছে। আবার রাগও হচ্ছে। সেল্ফ ডিফেন্স কী খারাপ কিছু! মনে হয় না। ড্রয়ার থেকে পুরনো ডায়েরি বের করলাম। ধূলোয় জমাট বাঁধা ডায়েরি থেকে একটা ছবি নিচে পড়লো।
সূবর্ণা! আমার প্রথম প্রেম। শৈশব থেকে যৌবনের চলার পথ পর্যন্ত আমার হাত ধরেছিলো। তারপর একদিন হঠাৎ আমার জীবন থেকে চলে যায়। চেয়ারম্যানের মেয়ে, খুব অহংকারী ছিলো। পাড়ার কোনো ছেলেই ওর কাছে পাত্তা পেত না। কিন্তু আমার মধ্যে কি এমন দেখেছিলো কে জানে। একদিন ওর বিয়েও হয়ে যায়।
বাবা না থাকাটা অথবা মাঠে বড় অঙ্কের জমি না থাকলে সূবর্ণা নামের এমন কাউকে এই গ্রামে কিনতে পারা যায় না। যদিওবা সূবর্ণা আত্মহত্যার কথা একবার তুলেছিলো কিন্তু আমি তা চাইনি। বুঝিয়েছি আমি আসলে ধোকাবাজ। আমার জন্য নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট কোরো না।
আমার এমনিতেই কোনো গন্তব্য নেই। তুমি এসে সব জাদুর মত করে ঠিক করে দিতে পারবে না। আমি হলাম অন্য জগতের মানুষ। নিষ্পাপ দেখতে কিন্তু পাপে অন্ধকার। হঠাৎ দরজায় কেউ একজন নক করছে… আমি কখন যে সূবর্ণার চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম তা ভুলেই গেছি। কয়েকবার নক করবার পড় দরজাটা খুললাম। হ্যাঁ, ডায়েরিটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। একি! স্নেহা!
সহজ হলাম তারপর আমিই প্রথমে কথা শুরু করলাম,
– কিহ্! ম্যাডাম! মোবাইলে ফোর-জি নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না? মাটির বাড়ি তো, দুঃখজনক!
– হাসান! একটু চুপ করবে?
– এই তুমি রেগে আছো যে!
– তো? রাগবো না তো কি নাচবো?… আচ্ছা, হাসান, তুমি আসলে কে?
– ওমা, এতদিন ধরে তোমার বাড়িতেই পড়ে ছিলাম। তবুও চিনতে সমস্যা হচ্ছে?
– হ্যাঁ, হাসান। তোমায় চিনতে এখন সমস্যা হচ্ছে। আজকের অ্যাক্সিডেন্ট বাদ দিলেও তোমার রুমে এত বড় লাইব্রেরি কেন? মার্ক টোয়েন হার মেনে যাবে। তুমি সাধারণ কেউ হতে পারো না!
– বইগুলো আমি নিজের টাকায় কিনেছি। আর বই পড়ে আঁতেল হওয়া যায় আর চোখে ছানিও পড়ে। এর মধ্যে আবার অসাধারণত্ব কী দেখলে?
– আর অতগুলো পেইন্টিং? তোমার পুরনো অকেজো ডেস্কটপ আমি অন করতে পেরেছিলাম।
– এই সেরেছে! তুমি আবার ইঞ্জিনিয়ার কবে থেকে?
– দেখ! শর্ট-সার্কিট হয়ে তার ফিউজ হয়ে গেছিলো আর আমি মাত্র সেটা ঠিক করেছিলাম। তার জন্য ইঞ্জিনিয়ার হবার মত কী দেখলে?
– আচ্ছা, তারপর? শার্লক হোমসের মত গোয়েন্দা হয়ে আমায় ইনভেস্টিগেট করা শুরু করে দিলে? বাহ্! তা কোন কোন ফোল্ডার ওপেন করেছিলে?
– ‘আমার লেখা’ নামক ফোল্ডার। আর সেখানে তোমার ১০০টির বেশি উপন্যাস রয়েছে!
– ওহ্! ওসব আমার পুরনো কিছু লেখা। খুব বাজে।
– আমার তো সেরকম মনে হয়নি।
– ধূর! বাদ দাও। ব্যাথা করছে এই বাহুতে। আমায় একটু আরামে নিদ্রায় যেতে দাও সুন্দরী…
এই বলে আমি পাশ ঘুরে শুয়ে পড়লাম। স্নেহার মনে তখনও অনেক প্রশ্ন। আর আমি জানি এই কৌতুহল থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সে আমাকে যাচাই করতেই থাকবে। লেগে থাকবে আঠার মত করে। তাই এই সুচিন্তিত পদক্ষেপ। আর তা হলো, স্রেফ এড়িয়ে যাওয়া।
স্নেহার প্রস্থান ঘটতেই ফোনের স্ক্রিনে মিসেস দত্তের নাম ভেসে উঠলো…
মিসেস দত্ত আমায় সহজে তলব করেন না। হোক সেটা সরাসরি বা ফোনে। তাই একটু মনের ভেতর কী সব চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো। কিন্তু ফোনটা রিসিভ করা জরুরী। নতুবা মিসেস দত্ত খুব অভিমান করবেন আমার ওপর।
সেটা হতে দেয়া যায় না, অনেক ভাগ্যে ওনার মত গুণী মানুষের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিলো। ফোনটা তুলেই বেশ সবুজ কন্ঠে বললাম,
– জি, মিসেস দত্ত… আদাব জানবেন। অনেকদিন পর কথা হচ্ছে… কেমন আছেন?
– আদাব, হাসান। আমি সুস্থ আছি। শোনলাম, পাড়ার কিছু বখাটে ছেলেদের মারধর করেছো?
– এসব কী বলছেন! স্নেহা ভুলভাল কিছু বলেছে নিশ্চয়।
– তোমার কি মনে হয়? তোমাকে এত গুরুত্ব দেবার একমাত্র কারণ আমার মেয়ে?
– না, না… ছিঃ ছিঃ… এভাবে কেন বলছেন?
– দুঃখিত হবার কিছু নেই। তোমার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আমার লোক আছে।
– মানে? স্পাই! আপনি স্পাই ঠিক করেছেন আমার জন্য?
– ঘাবড়ে যাবার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে গুরুত্ব দেবার চেষ্টা করছি, হাসান। একটা কথা মনে রাখবে, তিনটি বিষয়ে অন্য কাউকে বলার দরকার নেই।
– কি সেই তিনটি বিষয়?
– মাইনে, সম্পর্ক এবং নিজের পরবর্তী পরিকল্পনা… তুমি স্নেহার প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। এই পরীক্ষায় তুমি পাশ করলেও আমার তোমার কাছে একটি প্রস্তাব আছে।
– কি? এখনি স্নেহা কে বিয়ে করতে হবে! মিসেস দত্ত?
– আমার প্রস্তাব না শুনে তুমি বরাবর উপসংহারে চলে যাও। জীবনটাকে একটু বড় করে ভাবতে শেখো। ক্ষতি নেই তো ভাবায়।
– দেখুন, মিসেস দত্ত… আপনি এখন অবধি আমার কাছে একটা মিস্ট্রি। দয়া করে এই রহস্য ভেদ করুন।
– ঠিকাছে, এতদিন আমি তোমাকে নজরদারীতে রেখেছিলাম। তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি।
– কি পেলেন? অপদার্থ এক যুবক! তাই তো?
– না, না… আমি তোমার পটেনশিয়ালিটি দেখে তোমায় পলিটিক্সে আসার প্রস্তাব করছি।
– পলিটিক্স… মানে রাজনীতি। হাসান এখন রাজনীতি করবে!
– হ্যাঁ, করবে… তোমার পিছনের ইতিহাস তাই বলছে।
– মিসেস দত্ত, আমার জীবন ইতিহাস আরো অনেক বক্তিতা পেশ করতে পারে কিন্তু সেটাকে মাপকাঠি ধরে আমায় রাজনীতিতে নামানো ঠিক হচ্ছে কি?
– দেখো, রাজবাড়ি শহরে মোট ৩০টি আসন আছে। আমাদের অন্তত এখানে ২০টি আসন চাই। তাহলে মিসেস দত্ত কে মূখ্যমন্ত্রী পদে যাওয়া থেকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
– আর আপনি মনে করছেন আমি এই ২০টি আসন আপনাকে এনে দিতে সক্ষম?
– তুমি ছাড়া আর কে সক্ষম হতে পারে? দেখো, আমাদের দেখে ডান মনে হলেও আমরা মূলত বাম ঘরানার রাজনীতি করি। এটাকে তুমি অতি-বাম বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারো।
– মোট কত আসনে জিতে যাবেন বলে মনে করছেন?
– এই না হলো, মি. হাসান… মোট ৮০টি আসনে কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু একক সংখাগরিষ্ঠ হতে গেলে আরো ২০টি আসনের প্রয়োজন।
“বিদায়” – জানিয়ে তিনি ফোনটা রাখলেন। আর আমি অদ্ভুত এক ঝটকা খেয়েছি কোনো এক অপ্রস্তুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে। মিসেস দত্ত তাহলে একজন রাজনীতিবিদ। ধূর! রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মানেটা দাঁড়ালো, আমি এই জালে আটকা পড়া স্রেফ একটা পুঁটিমাছ।
আর এই অতি-বাম মানেটা কী! নিউ ওয়ার্ল্ড নিউ অর্ডার! বামে সমস্যা কি? মানুষকে বুঝানোর জন্য এমন অদ্ভুত ছদ্মবেশ! মিসেস দত্ত তাহলে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে চান? এক টেলিভিশন তর্ক-বিতর্কে ওনাকে দেখেছিলাম। তাহলে প্রথম দিন কেন মনে হয়নি! ওহ্ শিট্! মদ খেয়েছিলাম।
কিন্তু এতবড় ক্ষমতাধর মহিলা আমাকে গুরু দায়িত্ব দিতে যাচ্ছেন কেন? ইম্পর্টেন্স থেকে ইমপোটেন্ট হয়ে যাবো অবস্থা। যদিও রাজবাড়ী আমার ঘিঞ্জি লাগে তবুও ওটাই আমার প্রিয় শহর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক সংঘর্ষে একজন কে বাধ্য হয়ে খুন করতে হয়। পরে জেনেছিলাম ঐ ভদ্রলোক কোনো পার্টির নন। সে আফসোস নিয়ে আজও সময় সময় চোখে জল আসে। মৃত্যুর ঠিক আগের মূহুর্তে একজন মানুষের করুণ আর্তনাদ আজও আমার কানে বাজে। তারও তো একটা পরিবার ছিলো।
তারপর পার্টি ছাড়লাম, সদস্য পদ থেকে নিজের নামও মুছলাম। কিছু অতীত আমাকে তৃতীয় ব্রাকেটে আটকে রেখেছে। আমি এই “বঙ্গদেশ” এর জন্য কোনো বৈপ্লবিক নেতা হতে পারবো না। এখানে এত এত মত, এত ভেদাভেদ, এত দল, এত মতাদর্শ… মাথায় বিপ সংকেতে ভরে যাচ্ছে। এমনটা হয় যখন কেউ মারা যায়, তার হার্টবিটের সিগন্যাল।
বঙ্গদেশ নিয়ে আর পরিশ্রম করিনা। অথবা ইতিহাস ঘেঁটেও দেখিনা। হলিউডের অ্যানিমেটেড মুভি “মেগামাইন্ড” এ একটি সুন্দর বার্তা দেবার চেষ্টা করেছে, “যেখানে ভিলেন বড় হয়ে উঠে সেখানে হিরো হঠাৎ করে উদয় হয়, তাও সমান বা বেশি শক্তি নিয়ে হিরো সেই অঞ্চলের ভিলেনকে শেষ করে দেয়।”
হাস্যকর! আমার মত অপারগ এবং অপদার্থ এতবড় দায়িত্ব নিতে চলেছে? পিছন থেকে কেউ একজন আস্তে করে বলল, “হাসান, নিজের শক্রুকে চিনতে শেখো?”
‘দত্ত পরিবার’ উপন্যাসের ৮ম পর্ব পড়ুনঃ উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব – ০৮)